কাশ্মির বিস্ফোরণ : কাশ্মির কি ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে?

কাশ্মির বিস্ফোরণ : কাশ্মির কি ভারতের হাতছাড়া হচ্ছে?

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের জম্মু-শ্রীনগরের হাইওয়ের পুলওয়ামা জেলার অবন্তীপুরাতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ৪৯ ভারতীয় সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ) নিহত হয়। ভারতীয় মিডিয়ার সূত্রমতে, আদিল দার নামে ২১ বছরের এক কাশ্মিরি তরুণ এ আত্মঘাতী হামলায় আত্মহুতি দেন। কাশ্মিরি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সশস্ত্র আন্দোলনকারী সংগঠন জৈশ-ই-মুহাম্মেদ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। ১৯৮৯-তে সামরিক অভিযানের পর থেকে এটিই হচ্ছে স্বাধীনতাকামীদের সবচেয়ে বড় হামলা।

২০১৬ সালের ৮ জুলাই, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়া কাশ্মিরি স্বাধীনতা আন্দোলন নতুনমাত্রা লাভ করে। বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে সেখানে পুলিশ ও জনতার মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ লক্ষ্য করা গেছে। কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে কারফিউ উপেক্ষা করে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ হতে দেখা গেছে গত আড়াই বছর ধরে। এই আড়াই বছরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বুলেটে নিহত হয়েছে প্রায় ৬২৩ জন কাশ্মিরি যোদ্ধাসহ নারী, শিশু ও কিশোর।

সাম্প্রতিককালে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সাথে প্রধানত সংশ্লিষ্ট রয়েছে কাশ্মিরের শিক্ষিত তরুণেরা। আগের মুজাহিদিনের চেয়ে এরা অনেক বেশি র‌্যাডিক্যাল ও প্রত্যয়ী। এরা কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী। এসব তরুণের সংখ্যা আগের তুলনায় অভাবনীয়ভাবে অনেক বেড়েছে । এরা দক্ষিণ কাশ্মিরসহ পুরো কাশ্মির উপত্যকাকেই সশস্ত্র আন্দোলনের এক হটবেডে পরিণত করেছে। এরা ভ্রুক্ষেপহীনভাবে হামলা চালাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের ওপর। এই সশস্ত্র তরুণেরা ব্যাপক জনসমর্থনও পাচ্ছেন। আসলে ১৯৮৯ সাল থেকে এদের প্রতি জনসমর্থন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বাড়ছে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জন-আন্দোলনের তীব্রতাও।

কাশ্মিরে ভারতের প্রতি আস্থাহীনতার পারদমাত্রা যে বাড়ছে, তা আঁচ করা যায় নিহতদের জানাজায় মানুষের ঢল দেখে। নিহত বুরহান ওয়ানি এখন কাশ্মিরজুড়ে এক পোস্টারবয়। নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা যত বাড়ছে, ভারতবিরোধী মনোভাবের তীব্রতাও তেমনটি বাড়ছে। 

 

কাশ্মিরে ভারতের প্রতি আস্থাহীনতার পারদমাত্রা যে বাড়ছে, তা আঁচ করা যায় নিহতদের জানাজায় মানুষের ঢল দেখে। নিহত বুরহান ওয়ানি এখন কাশ্মিরজুড়ে এক পোস্টারবয়। নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা যত বাড়ছে, ভারতবিরোধী মনোভাবের তীব্রতাও তেমনটি বাড়ছে। নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানিও বাড়ছে। বিষয়টি নিরাপত্তাবাহিনীকেও চিন্তিত করে তুলছে। সরকার ততোধিক শক্তি প্রয়োগ করে কাশ্মিরিদের দমন করতে চাইছে। এতে পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত সরকার কাশ্মির সমস্যার শেকড় জানতে দিচ্ছে না ভারতবাসীকে। কাশ্মিরিরা কোন মুসলিম দেশের কাছে থেকেও দরকারি সাহায্য পাচ্ছে না!

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শুনে আসছি কাশ্মিরের লড়াই-পাল্টা হামলার কথা কিন্তু প্রজন্মের অনেকেই জানেননা কাশ্মিরের মূল সংকট কোথা থেকে শুরু হলো। ১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মির ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নামেমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য গঠন করা হয়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি’র সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করেন ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই রাজ্য ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে। তখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবে- পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এ দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর।

এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিট বাল্টিস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত। নিকট অতীতে জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট বলছে, জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়। ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলেছিলেন, ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’।

কাশ্মিরের জনগণ চায় আজাদি। চায় না ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্তি। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান নেহেরু প্রতিশ্রুত গণভোটের দ্রুত আয়োজন। বিগত ছয় দশকের ইতিহাস বলে, দমনপীড়ন চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিন হবে না। ঐতিহাসিক প্রতারণা ও ভারত রাষ্ট্রের অত্যাচারে আর কতকাল জ্বলবে পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মির।

 

এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া। সারকথা হল, কাশ্মিরের জনগণ চায় আজাদি। চায় না ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্তি। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান নেহেরু প্রতিশ্রুত গণভোটের দ্রুত আয়োজন। বিগত ছয় দশকের ইতিহাস বলে, দমনপীড়ন চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান কোনো দিন হবে না। ঐতিহাসিক প্রতারণা ও ভারত রাষ্ট্রের অত্যাচারে আর কতকাল জ্বলবে পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মির।

২০১১ সালে অনন্তনাগে ১৪ বছরের এক বালক পেলেট গানের আঘাতে আহত হয়। ভারতের নিপীড়নের শিকার স্বাধীনতার চেতনাকে আঁকড়ে ধরা এ শিশু হাসপাতালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে বলেছিল, “সেনাদের গুলিতে মরতে চেয়েছিলাম আমি। আমার শাহাদাত কাশ্মিরকে আজাদি এনে দেবে। আজাদি না দেখে যেতে পারলেও কোন আফসোস নেই। কারণ এতে অন্তত এ জীবন্ত কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারব।’ এখনও সে প্রতিশোধের নেশায় টগবগ করছে বলেও জানায়।

২০১৮ সালে ভারতীয় বাহিনীর হামলায় অন্তত ৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে বহু কাশ্মিরি শিশু-তরুণ-যুবক চোখ হারিয়েছেন। কাশ্মির সরকারের এক তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে আট শতাধিক কাশ্মিরি চোখে আহত হয়েছিলেন। তবে পেলেট ভিকটিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মতে, ২০১৭ সালে ১২০০-এর বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর চোখে ছররার গুলি লেগেছে। এর মধ্যে শতাধিক কাশ্মিরির এক বা উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালকে তো ‘গণ-অন্ধত্ব সাল’ বলা হয়ে থাকে। ওই বছরের ৮ জুলাই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতা বুরহান ওয়ানির হত্যায় উত্তপ্ত কাশ্মিরে ১১০০ জনের চোখে ছররা ঢোকে।

বিগত ৭০ বছরের ভারতীয় বর্বর নির্যাতন ও ব্লাডশেডকে ধামাচাপা দিতেই পুলওয়ামায় বিস্ফোরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের আয়তন হচ্ছে ২ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার যেখানে বসবাস করছেন ১ কোটি ১৮ লাখ কাশ্মিরি, যার মধ্যে ৭২% মুসলমান কাশ্মিরি। ৮৬ লাখ কাশ্মিরিদের জন্য ভারত তাদের পেটুয়া বাহিনী নিয়োগ করেছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ। কাশ্মির হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সামরিক শাসিত অঞ্চল যেখানে প্রতি দশ জন মুসলিম কাশ্মিরিদের জন্য ১ জন সৈন্য নিয়োজিত আছেন।

মোদি ও ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট চাচ্ছে সামরিক কায়দায় কাশ্মিরি আওয়ামকে দাবিয়ে রাখতে। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়— সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বাধীন চেতনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বন্দুকের নল দিয়ে দাবিয়ে রাখা যায়নি। কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ভারত কাশ্মির নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সামরিকপন্থা বেছে নিয়েছে তাতে ভারত সফলকাম হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছেনা। এতে ভারত থেকে কাশ্মিরের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রত্যয় আরও দৃঢ় হচ্ছে।