‘সোনালী কাবিন’ সন্ধানে কি অন্য গ্রহে পাড়ি দিলেন কবি আল মাহমুদ? বিগত কয়েক বছর রোগ-জর্জরিত হওয়ার ফলে প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি, শনিবার রাতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাজধানীর ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে সিসিইউ, পরে আইসিইউ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত্রি দশটায় ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়েও কবির আরোগ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা বিফল করল মৃত্যুর করাল গ্রাস! প্রায় এক ঘন্টা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস সচল রাখার পর রাত্রি ১১:০৫ নাগাদ কবি অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করেন, জানিয়েছেন কবির সাহিত্য সচিব আবিদ আজম। মৃত্যুকালে কবির বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। স্ত্রী সৈয়দ নাদিরা বেগম প্রয়াত হয়েছেন আগেই। রেখে গেলেন পাঁচ পুত্র, তিন কন্যা এবং নাতি-নাতনিদের।
বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলা কবিতা জগতে আধুনিকতা উন্মেষিত হয়েছিল যে কতিপয় কবিদের মাধ্যমে, আল মাহমুদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভূ। মৌলিক কাব্যভাষা সহযোগে চিত্ররূপময়তা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং গ্রামীণ শব্দপুঞ্জ প্রয়োগ তার রচনাশৈলীর বিশেষ গুণ। বাংলাদেশি কবিতার ঘরানা এবং মেজাজ বুঝতে আল মাহমুদ রচিত কবিতা পাঠ করা অপরিহার্য। বিখ্যাত অধ্যাপক এবং সমালোচক শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন, “সমকালীন যে-দু’জন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করে, তাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশের আল মাহমুদ এবং অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।” আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসাবে আল মাহমুদ নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য নাম।
ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে এক মোল্লা পরিবারে আল মাহমুদ জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতা এবং মাতা যথাক্রমে মীর আব্দুর রব এবং রওশন আরা মীর। কুমিল্লা জেলার দাঊদকান্দি থানার সাধনা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে সীতাকুণ্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। ছাত্রকাল থেকেই তিনি বৈষ্ণব পদাবলি, মধ্যযুগীয় প্রণয়-উপাখ্যান, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ রচিত গ্রন্থ পড়তেন। ১৯৫৪ সালে আল মাহমুদ ঢাকা এসে আব্দুর রশীদ ওয়াশেকপুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘কাফেলা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে আব্দুর রশীদ ‘কাফেলা’ থেকে বিদায় নেওয়ার পর সম্পাদক কুর্সিতে বসেন আল মাহমুদ। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ কবি হিসাবে তাকে পাঠকসমাজে পরিচিতি দেয়। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ বাংলা সাহিত্য জগতে বিপুল সমাদৃত হয়। গায়ক অনুপম রায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘সোনালী কাবিন’ তার প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। বহু কাব্যপ্রিয় বাঙালি পাঠকের মনের মণিকোঠায় আসীন ‘সোনালী কাবিন’। আল মাহমুদ রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘কালের কলস’ (১৯৬৬), ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ (১৯৬৯), ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘পানকৌড়ির রক্ত’। ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ এবং ‘কালের কলস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। ভাটি বাংলার জনজীবন, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের যাপনরীতি, নরনারীর প্রেম-বিরহ তার কাব্যে স্বকীয় ঘরানা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নরনারীর যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা, ভোগ-লালসা তার কবিতায় অনবদ্য শিল্পমণ্ডিত। আধুনিক বাংলা কাব্যরীতি এবং কাঠামো তিনি অনেকটা ভাঙাগড়া, নীরিক্ষা করেছিলেন অনন্য স্বতঃস্ফূর্ততায়। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদ রচিত প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। বহু অসাধারণ গল্পও লিখেছেন তিনি। পাশাপাশি রচনা করেছেন নিবন্ধ, উপন্যাস, আত্মজীবনী।
১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। সরকার-বিরোধী অবস্থানের জন্য তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল এক বছর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে নিয়োগ করে, পরে তিনি পরিচালক হন, ১৯৯৩ সালে কর্মজগৎ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি বলতেন, “বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না।” প্রচুর অধ্যয়ন করতেন তিনি, তার ছাপ পাওয়া যায় তার রচনায়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: “মৃত্যুচিন্তা আছে আমার। তবে মৃত্যুকে সমাপ্তি মনে করি না। মৃত্যুর ওপারে আরেকটা জীবন আছে— এটা বিশ্বাস করি। কিন্তু মৃত্যু আমার মধ্যে বেদনা তৈরি করে। কারণ, মৃত্যু মানে বিচ্ছেদ, চূড়ান্ত বিচ্ছেদ।” ৮২ বছরের জীবনে আমাদের বহু মূল্যবান লেখা উপহার দিয়েছেন তিনি। বহু সৃজনশীলতায় ঋদ্ধ তার জীবন, তার নিকট মৃত্যু নিশ্চয় আক্ষেপজনক হবে না! সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার এবং সম্মাননা; উল্লেখযোগ্য: জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), একুশে পদক (১৯৮৬), ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪), লালন পুরস্কার (২০১১) ইত্যাদি। এবং এক আশ্চর্য সমাপতন: ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হয়েছিলেন প্রথিতনামা উর্দু কবি মির্জা গালিব।