• অনুবাদ : সংযুক্তা সিংহ
গোড়ার কথা
বাংলায় আমার লেখা বেশি ছাপা হয়নি, অনেকে হয়ত জানেন না, অনেকে হয়ত প্রথমবার আমাকে শুনছেন এবং হয়ত এই শেষ বার। সতরাং শুরু করার আগে দু-চার কথা আমি বলে নিতে চাই। কারণ ব্যাপারটা পরিস্কার হওয়া উচিত।
আমি আধুনিকতার সমালোচক। আমরা আধুনিক যুগের সন্তান। আধুনিকতা। সুতরাং আমাদের ঘিরে রয়েছে। আমাদের মজ্জায় মজ্জায় আধুনিকতা। সুতরাং সমালোচনা যদি করতেই হয় আধুনিকতারই করা উচিত, কারণ তাতেই তাতেই সাহস এবং বীরত্ব আছে। ঐতিহ্যকে সমালোচনা করলে, প্রাচীন সংস্কৃতিকে সমালোচনা করলে, ট্র্যাডিশানকে সমালোচনা করলে তাতে কোনো সাহস বা বীরত্ব নেই, কারণ আমরা জানি, আমাদের মধ্যে এবং আমাদের চারপাশে ট্র্যডিশান হেরে গিয়েছে। কিন্তু ট্র্যাডিশান কিছু লোকের মধ্যে সামান্য বেচেঁ আছে। তারা সংখ্যালঘু সারা পৃথিবীতে। পৃথিবীর অধিকাংশ লোক এখন শহরের বাসিন্দা। গ্রামের সমালোচনা, আমাদের পূর্বপূরুষেরা অনেকে করেছেন। গ্রাম ছিল ভারতের তিন-চতুর্থাংশ। এখন সেটা বোধহয় কমে ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। ৬৫-ই ধরে নিন। সুতরাং আমাদের দেশেও গ্রাম ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু হওয়ার দিকে যাচ্ছে। এই যে আধুনিকতার মধ্যে আমরা রয়েছি, সে বিষয়ে আমাদের সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গী খুব কম। যা আছে তার অধিকংশই হাস্যকর এবং আমর মনে হয়ে আজকের দিনে সেটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমি আপনাদের একটা উদাহরণ দিচ্ছি, আমার বক্তব্যের মূল সূত্র কী তা বুঝিয়ে দেবার জন্য।
বিংশ শতাব্দীতে সাড়ে ২২ কোটি লোক গণহত্যার শিকার হয়েছে। একমাত্র শতাব্দী, যার উপর সম্পূর্ণ ডেটা পাওয়া যায়। এটাও সম্পূর্ণ নয়, আমার হিসেবে আর একটু বেশি লোক মারা গেছেন। কিন্তু যাই হোক, ওইটাই ধরে নেওয়া যাক, সাড়ে ২২ কোটি, গণহত্যার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে নিজের দেশের সরকারের হাতে মারা গেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক। সুতরাং আধুনিক সরকার আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে হয়ত খুব ভাল নয়, অন্তত তাদের রেকর্ড, আজকের টেররিস্টদের চেয়ে কোনো অংশে ভাল নয়— এটা বললেও আপনাদের ততটা খারাপ লাগবে না। যদি আপনারা তার সঙ্গে তুলনা করেন ধর্মভিত্তিক হিসাব মাসুল কত লোককে দিতে হয়েছে, তাহলে দেখবেন সেখানে সেই সংখ্যাটা এক কোটির কম। এই ডেটা আমি সৃষ্টি করিনি, সবাই জানে এই ডেটা, তাদেঁর যারা গণহত্যার উপর কাজ করেছে। আপনি যদি না জানেন বা না বিশ্বাস করেন, তা হলে ইন্টারনেট খুজলেও পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমি যদি সেকুলারিজিমের বিপক্ষে কথা বলি বা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কথা বলি, তা হলে লোকে সেটাকে ভয়ংকর, তাকে বিজেপি-ও সমর্থন মনে করে এখন। আমরা এটাও জানি যে, এই ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা ইংরেজি Original, সেকুলারিজম্। সে কথাটার অর্থ আমাদের দেশে শতকরা আড়াই ভাগ লোক যারা ইংরেজি জানে তারাও অধিকাংশই জানে না। সুতরাং এই কথাটার অর্থ কী। এই কথাটার মূল্য কী! কেন আমরা ভাবতে পারলাম না সেই ধরনের চিন্তার কথা বা তত্ত্বর কথা, যেগুলো নিয়ে আমরা যাদের সেকুলার বলি তারা ভেবেছিলেন, – অশোক বা আকবর বা কবীর, তারা তো কেউ সেকুলার ছিলেন না। তাদের বক্তব্যের কী কোনো মল্য আছে? সেকুলারিজম শব্দটাকে বাদ দিলেও? বা সেকুলারিজমের দর্শনটা বাদ দিলেও? তাদের সেকুলারিষ্ট বলে চালানোর অর্থটা কী তাদের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দেশের কাছ থেকে একটা আর্টিফিশিয়াল দূরত্ব সৃষ্টি করা? এগুলো লোকের ভাল লাগে না, ভাল ভাবে নেয় না। অথচ ধর্ম ও হিংসার উপর কাজ করার সময় আমি দেখেছি (আমি ৪০ বছর ধরে হিংসার উপর কাজ করছি, হিংসা আর সৃষ্টিশীলতা- Violence and Creativity, এই দুটোতেই আমার প্রধান কাজ) দেখেছি যে, পূর্বে জাপান থেকে শুরু করে পশ্চিমে আফ্রিকার পশ্চিম কথাটার একটা প্রতিশব্দ আছে স্থানীয় ভাষায়। Religion শব্দটার অর্থ ধর্ম নয়। ধর্ম, Religion —এর প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আর শুধু এখানে নয়, জাপানেও কোনো শব্দ পাবেন না ধর্মের। চীনের পাবেন না। Religion-শব্দটার সত্যিকারের কোনো পরিভাষা নেই এশিয়ার কোনো ভাষায় প্রায়। এটি একটি নতুন বস্তু। ইউরোপেও নতুন বস্তু। প্রোটেস্ট্যান্টদের সময় শুরু হল। Reformation থেকে শুরু হল। সুতরাং ওখানেও যে খুব পুরোনো তা নয়। এই Religion বর্তমানে অর্থে। আমাদের ধর্ম কী সেটা বুঝতে হলে আপনি জাপানের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন। শতকরা ৯৫ ভাগ জাপানি শিন্দো, শতকরা ৯৫ ভাগ জাপানি বৌদ্ধ। বৌদ্ধ আর শিন্দোদের মধ্যে আপনি Riot করাতে পারবেন না। আমাদের Riot expert যাঁরা আছেন বিভিন্ন পর্টিতে, তাঁরাও পারবেন না। আমি সেই বস্তাপচা পশ্চিম-বিরোধী কথা বলবার চেষ্টা করছি না। আমি আমাদেরই নিজেদেরই আত্মসংজ্ঞা, Self-definition, তার একটা অংশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি যে, আমরা এখনও অবধি স্বীকার করিনি, আমরা এক অর্থে নতুন ধরনের সামাজিক মানসিকতার খোঁজে রয়েছি। এটা তারই একটা চেষ্টা। এই চেষ্টার অন্যতম টার্গেট সমালোচনা যদি বলেন, তা হল দুটো। একটা ইতিহাসের বিরুদ্ধে আর একটা প্রগতির বিরুদ্ধে। ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা হল, ইতিহাস অতীতের হয়, বর্তমানের হয় না ভবিষ্যতেরও হয় না। কিন্তু অতীতকে অন্যভাবেও আপনি জানতে চেষ্টা করতে পারেন। ডাক্তাররা যখন Case history খোঁজেন, তাঁরা ইতিহাস খোঁজেন না। ডাক্তাররা চিকিৎসা করার সময় যখন জিজ্ঞাসা করেন, তার অতীতে কী ধরনের শারীরিক কষ্ট ছিল ইত্যাদি, সেটা history নয়, Case history। কিন্তু কীভাবে সেই বক্তব্য নিংড়ে, Case history বানানো হয়, সেটা ডাক্তারের উপর নির্ভর করে। অতীতকেও নানাভাবে গড়া যায়, নির্মাণ করা যায়। কবিরা এককভাবে করেন, যাঁরা ছবি আঁকেন তাঁরা অন্যভাবে করেন, আর যাঁরা Epic নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন Epic–এও অতীতকে এককভাবে ব্যবহার করা যায়। ইতিহাস এখন অতীত নিয়ে কাজ করার একচেটিয়া ব্যবসা করে ফেলেছে। আমি তার বিপক্ষে। আর প্রগতি আমি মনে করি একটা বিষাক্ত শব্দ। আমি Social chang -এর বিপক্ষে নই, প্রগতির Ideology-র বিপক্ষে। কারণ এখন যদি আপনি দেখেন, দেখবেন প্রগতির নামে যত হিংসা হয়, যত নিষ্ঠুরতা হয়, বোধহয় আর কোনো আদর্শেও নামে তা হয় না।
ইতিহাসবিদদের নতুন মহাফেজখানার জোগান দেওয়া, সামাজিক মেলবন্ধন সুনিশ্চিত করা বা জাতীয় সংস্কৃতির সংজ্ঞা নির্ধারণ, আমাদের সময়ে সমূহ স্মৃতির মূখ্য কাজ নয়। Collective Memories অর্থাৎ সমূহ স্মৃতির কাজ হল রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বাইরে একটা পরিসর তৈরি করা, যা স্বশাসিত এবং অলঙ্ঘনীয়। অতীত নির্মাণের যে আধিপত্যবদী ইতিহাস, তার বাইরে এই পরিসর, আদর্শগত দাবি, রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার দায়, কখনো সখনো এমনকি বিশ্বাসযোগ্য, সরকারী গবেষণালব্ধ তথ্যভাণ্ডার হয়ে ওঠার বাধ্যবাধকতায় ভারাক্রান্ত নয়। আমার মনে হয়, নীতিবাদী রাষ্ট্র পছন্দ করে এমনভাবে অতীত নির্মাণের ইতিহাসকে ঘোর সন্দেহের চোখে দেখার সময় এসেছে। মনোবিশ্লেষকের ভাষায় যাকে বলে Screen Memories, স্মৃতি আসলে ভ্রান্ত, তার ভেতরে নিহিত থাকে অন্য সত্য। মানুষের স্মৃতি আসলে ভ্রান্ত, আবছায়া, এটা যদি আপনি মেনেও নেন, তাহলেও বলব, সেই স্মৃতি অংশত অসত্য, কিন্তু মনোবিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, ঠিক মতো ধরতে পারলে তা থেকেও সত্যে পৌঁছানো যায়। ডাক্তারের মতো আপনার বিষয়টিকে দেখার চোখ থাকতে হবে। রোগী যখন তার শারীরিক অবস্থার অতীত নিয়ে কিছু বলে, সেই বলার ওপর ডাক্তারের আস্থা থাকে না। কারণ সে ডাক্তার নয়। ডাক্তারের ভাষায় সে কথা বলতে পারে না। কিন্তু যেভাবে সে বলে, তা থেকে ডাক্তার তার অতীত বুঝে নেয়। একইভাবে মানুষের স্মৃতি থেকে আমাদের অতীত নির্মাণ শিখতে হবে। কেননা আপনি যদি ইতিহাসে খুব বেশি আটকে থাকেন, তাহলে ইতিহাস আপনার জন্য অতীত নির্মাণ করে দেবে। অতীতকে আপনি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবেন না। সামিল হবার সুযোগ এতে পাওয়া যায় না। দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ আছে। নৃতত্ত্ববিদ আর নৃতত্ত্ববিদদের বিষয়, আমি তাদের কথা বলছি। তাদের চিন্তা, তাদের স্মৃতির মাধ্যমে নির্মাণের কথা বলছি। সেই স্মৃতি, অনেকটা খেরোরখাতার মতো। একটি জনগোষ্ঠী তাতে তার ভাবাবেগের খতিয়ান লেখে। সেটা সম্মানজনক হতে পারে বা জোড়াতালি দেওয়া, ন্যায্য হতে পারে বা অন্যায্য, গোপন হতে পারে বা খোলামেলা। যারা পড়বে, তারা সেটা গ্রহণ করবে না বিরোধিতা করবে, সেটা তাদের ব্যপার। কারণ আপনি যদি Screen Memories বা আবছা স্মৃতির ধারণাটিকে মেনে নেন, তাহলে দেখবেন প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজেস্ব স্মৃতিকল্প রয়েছে এবং সেগুলির একটি অন্যটির সঙ্গে মেলে না।
এই যে অমিল, এর প্রতি সহিষ্ণু হওয়া আমাদের শিখতে হবে, সমূহ স্মৃতির মধ্যে এত অমিল, অমিল, অতীত নির্মাণে বা অতীত নিয়ে ধারণায় এমন ভিন্নতা সত্ত্বেও তারা পরস্পরের বাস করতে পারে কেন? বহু বছর আগে আমি কোচিনের একটা মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস লিখেছিলাম। লম্বা প্রবন্ধ। কোচিনের ইতিহাস তিন হাজার বছরের, কিন্তু সত্যিকারের ইতিহাস ছ’শো বছরের। আগের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস অর্ধেক স্মৃতি। আধুনিক ঐতিহাসিকরা সেগুলি বিশ্বাস করবেন না। কোচিনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, যেজন্য আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কোচিনে বড় দাঙ্গা কোনোদিন হয়নি। সত্যিই গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, হয়নি। ছিটে- ফোটা মারামারি হয়েছে। একটা-দুটো লোক মারা গেছে। বসে,ওই অবধি। ছশো বছরে সেই ওদের দাঙ্গার ইতিহাস। সত্যিকারের দাঙ্গা একটাও হয়নি। যেহেতু আমি হিংসার ওপর কাজ করি এবং দাঙ্গার ওপর বহু বছর ধরে কাজ করছি, সেহেতু আমার শ্রীলঙ্কার একজন বন্ধু আমাকে খুব চাপ দিয়েছিল এটা করার জন্য। প্রথমেই আমি গিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলতে আরাম্ভ করলাম। জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম, কেন এখানে দাঙ্গা হয় না। উত্তরগুলো সবই, যাকে বলে আটপৌরে। কেন দাঙ্গা হয় না? কারণ কোচিন হচ্ছে কেরালার অংশ। এখানে শিক্ষিত। অশিক্ষিত কেউ নেই। মহিলারও শতকরা একশো ভাগ শিক্ষিত। কেন দাঙ্গা হয়না? কারণ আমরা এখানেই সবাই সেকুলার। আমরা উত্তর ভারতের লোকদের মতো নেই। আমরা আলাদা। কেন দাঙ্গা হয় না? না, আমাদের পুরোনো ট্র্যাডিশান আছে। ওই সবই খুব প্রেডিক্টবেল উত্তর। কিন্তু ভবেশবাবু (ভবেশ দাশ) আমার পরিচয় দিয়েছেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। আমাদের একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে আমরা একটা ইন্টারভিউ করি না। দিনের পর দিন একটা লোকের সঙ্গে কাটাই। দশ/বারো দিন, পনেরো দিন। পনেরো কুড়ি ঘন্টা ইন্টারভিউ করতে হয়। আমি তখন তাদের বলতাম যে, ঠিক আছে, ও ব্যপারটা বুঝেছি। এখন আপনি আপনার নিজের জীবনের কথা বলুন। আপনার বাবা-মা কী করতেন, আপনি কোন স্কুলে পড়েছিলেন, বন্ধু-বান্ধবকে ছিল ইত্যাদি। ধীরে ধীরে দেখলাম, আগের উত্তরগুলো কেউ নাকচ করল না, কিন্তু অন্যরকম বলতে আরম্ভ করল। তাদের কথা বুঝতে পারলাম না যে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। কোচিনে সবাই মনে করে যে তাদের কমিউনিটিটাই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য কমিউনিটিগুলো তাদের তুলনায় পশ্চাদপদ এবং ওদের ইতিহাস থেকে জানে, ওরাই ভালো। আমি এও দেখলাম যে, প্রত্যেকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের জাতিপুরাণ আছে। সেই জাতিপুরাণে অন্যান্য কমিউনিটিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখানো হয় যে, কী অর্থে তারা, যাদের জাতিপুরাণ তাদের চেয়ে নীচের স্তরের মানুষ। কিন্তু তারা নিজেদের কথা বলছে, তখন ধীরে পরিষ্কার হয়ে গেল যে তারা কোচিনের ইতিহাসকে অন্য সম্প্রদায়গুলিকে ছাড়া চিন্তাও করতে পারে না।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ওপরেই গণতন্ত্র গড়ে ওঠে। যে কথা বলছিলাম বতিল হয়ে যাওয়া, নিষিদ্ধ, প্রায়শই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে সেই যে স্বশাসিত পরিসর, তাকে খুড়ে বিপরীতমুখী ভাবনার সহাবস্থান কল্পনা করতে পারে এমন কোনো কাঙ্ক্ষিত সমাজের সন্ধান হয়তো পাওয়া সম্ভব। ভবিষ্যতের স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যেতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষি, মিশনারি, জাতি, রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট জগতের সুবৃহৎ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং নিরপেক্ষ হিসেব-নিকেশের অনুকূল জায়গার সন্ধান দিতে পারে এই পরিসর।
অন্য সম্প্রদায়গুলো শুধু বাইরে নেই, তাদেও মধ্যেই নিহিত রয়েছে। অনেকটা ঐ পুরাণের মতো। সত্য বলতে কি, যখন কেচিনের ওপর লেখাটা লিখলাম, নাম দিয়েছিলাম Epic Culture সংস্কৃতি। আমাদের পুরাণে দেব-দেবীরা ক্রটিহীন নন, আবার অসুরদেরও সবটাই খারাপ নয়। সেখানে সবসময়ই দেব-দানবের মধ্যে খেলা। জটিল তাদের সম্পর্ক কিন্তু গল্পের মধ্যে দেব এবং দানবের মধ্যে খেলা চলে। জটিল তাদের সম্পর্ক। কিন্তু গল্পের মধ্যে দেব এবং দানব দু-পক্ষকেই থাকতে হবে, নাহলে সে গল্প সম্পুর্ণ হবে না। কোচিনে কেন গত ৬০০ বছরে বলার মত কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটলো না, তার অন্যতম মূল সূত্র পাওয়া যাবে এখানেই অন্যদের প্রসঙ্গ না এনে তারা নিজেদের ব্যাখ্যা করতে পারে না। মানবিক সম্পর্কের যে প্রেক্ষাপট, তার মধ্যেই এই বিষয়টা রয়েছে। সেখানে কেউ বর্জনীয় নয়। কেউ অপ্রাসঙ্গিক নয়। নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, আপনাকে বলতে হবে ওদের চেয়ে আপনি উন্নতর। ওরা নিজেদের ভাবমূর্তিকে আপনার চেয়ে উন্নতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। প্রত্যেকেই কিন্তু জানে, ওদের একটা ভিন্ন, ইতিহাস তো বলতে পারবো না, উপকথা বা পুরাণ, যাই বলুন, সেটা আছে। এরই নাম আমি দিয়েছিলাম পুরাণ সংস্কৃতি। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়াতে রয়েছে, পূর্ব এশিয়াতে রয়েছে, এবং বোধহয় এটা এককালে ইউরোপেও ছিল। এই যে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, এটা বোঝাতে এখন আমি যে শব্দ ব্যবহার করি, তা হল Silk-route cosmpolitalism জনগণের স্মৃতিনির্ভর এই যে বিশ্বজনীনতা, এখানে তা বহুত্ববাদের বিরোধী, আবার বহুত্বের প্রতি সহিষ্ণুতা গড়ে ওঠেছে এরই ওপর। এটাই আমাদের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। আমি দেশ ভাগের ওপর কাজ করছি। তাই এই নমনীয়তার অনেক উদাহরণ দিতে পারি। আমি একে বলি, চরম বৈপরীত্যের প্রতি সহিষ্ণুতা। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এক মহিলা, যখন তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, তখন তার বয়স ৮৫-র বেশি। হিংসায় পরিবারের অনেক সদস্যকে তিনি হারিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার শৈশবের, মুসলিম বন্ধুদের চেনাজানা মানুষেদের স্মৃতিচারণ করলেন পরম মমতায়। একটা গল্প ছিল এরকম, মূসলিম বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় বা তাদের বাড়ি যাওয়ায় তার পরিবারের আপত্তি ছিল না। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছু খেলে মায়ের কাছে পিটুনি খেতে হত। এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। সতীশ সবরওয়ালা একটা বই লিখেছে এর ওপর ভিত্তি করে। যাই হোক, তো একদিন তিনি এক মুসলিম বন্ধুর মাকে তার সমস্যার কথা বললেন। বললেন, ‘আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে খেলা করলে কারো কোনো অসুবিধে হয় না। তুমিও আমার মায়ের বন্ধু। অথচ তোমাদের বাড়িতে খেলে, মা আমায় মারে। এখন সমস্যা হল, আমার বাড়ির চেয়ে তোমার বাড়ির খাবার আমার বেশে ভালো লাগে।’ বন্ধুর মা বললেন, ‘এই ব্যাপারে! এর সমাধান তো খুব সহজ। তুই কোনো হিন্দু মন্ত্র জানিস?’ তিনি সম্ভবত ছিলেন আর্য সমাজ পরিবারের মেয়ে। গায়ত্রী মন্ত্র জানতেন । বন্ধুর মা বললেন, ‘গায়ত্রী জানলে তো কথাই নেই’। আমি তোকে কলমা পড়তে শিখিয়ে দিচ্ছি। মুখস্ত করে নে। তোর বাড়ি থেকে আমার বাড়ি আসার সময় কলমা বলতে আসবি। যখন আমার এখানে পৌছাঁবি, ততক্ষণে তুই মুসলিম হয়ে যাবি। তারপর আমার মেয়ের সঙ্গে খেলা কর। খাওয়া-দাওয়া কর। খাওয়া-দাওয়া কর। যখন বাড়ি ফিরবি, তখন গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে যাবি। ব্যস, আবার তুই হিন্দু হয়ে গেলি। তবে হ্যাঁ, মাকে এসব বলার দরকার নেই। একেই বলি চরম বৈপরীত্যের প্রতি সহিষ্ণুতা। এই যে, ভিন জাতের বা সম্প্রদায়ের কেউ খাবার ছুয়ে দিলে তা নষ্ট হয়ে যাবার ভাবনা, যারা এরকম ভাবে তাদের আমরা পশ্চাদপদ মানুষ বলে মনে করি। সাধারণ মানুষের প্রতি যদি আপনাদের সম্মানবোধ থাকে, তাহলে আমি আপনাদের ভাবতে বলব, অন্যভাবে বিষয়টাকে দেখা যায় কিনা। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ওপরেই গণতন্ত্র গড়ে ওঠে। যে কথা বলছিলাম বতিল হয়ে যাওয়া, নিষিদ্ধ, প্রায়শই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে সেই যে স্বশাসিত পরিসর, তাকে খুড়ে বিপরীতমুখী ভাবনার সহাবস্থান কল্পনা করতে পারে এমন কোনো কাঙ্ক্ষিত সমাজের সন্ধান হয়তো পাওয়া সম্ভব। ভবিষ্যতের স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যেতে পারে। উচ্চাকাঙ্ক্ষি, মিশনারি, জাতি, রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট জগতের সুবৃহৎ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এবং নিরপেক্ষ হিসেব-নিকেশের অনুকূল জায়গার সন্ধান দিতে পারে এই পরিসর। বহুত্ত্ববাদী ভবিষ্যতের পথ যদি নির্মিত অতীতের মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে সেই বহুত্ববাদের একটা জরুরি অঙ্গ হল, ইতিহাস স্থান পাওয়া সরকারি এবং অনুমোদিত অতীতকে অস্বীকার করা। এই কারণেই আমি আমার জীবনের এতটা সময় ব্যয় করেছি— সারা জীবন ধরে বেখাপ্পা বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে চলেছি। এই যে আপনি প্রথাগত, আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে শুধু নয়, উপকথা, পুরাণ এবং নানারকম শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে অতীত নির্মাণকে সমান বা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ফলে, অতীত আরো উন্মুক্ত হতে পারছে। তাই আপনি ভবিষ্যতের পাশাপাশি অতীতের এক কাঙ্ক্ষিত সমাজ, একটা কল্পনারাজ্যকেও দেখতে পাচ্ছেন। রামরাজ্য এর একটা উত্তম উদাহরণ। ভারতীয় এবং চৈনিক— উভয় সভ্যতাতেই ইউটোপিয়া বা কল্পরাজ্যের খোঁজ মেলে অতীতে, আবার ভবিষ্যতেও। এমন নয় যে, এর মধ্যে পৌরাণিকতা মহাকাব্য থাকতে পারে। পুরাণে, উপকথায়, জনস্মৃতিতে থাকতে পারে। অতীতকে উন্মুক্ত রাখার এটা একটা পথ। যাই হোক, সাংস্কৃতিক উপাদানের আকার পেয়ে সমূহ স্মৃতি যেটা দাড়াঁলো তাকে বলা যেতে পারে Mnemoculture Configurations। Mnemoculture- এর অর্থ স্মৃতিনির্ভর সাংস্কৃতিক রীতির সূচনা হল। দস্তয়েভস্কিও ভাষায় বললে, স্মৃতিনির্ভর সংস্কৃতি হল, নৃতত্ত্ববিদদেও বিষয়ের মতো। দস্তয়েভস্কিও ভাষায় বললে, স্মৃতিনির্ভও সংস্কৃতি হল, নৃতত্ত্ববিদদের বিষয়ের মতো। ওই নিয়েই তারা বাঁচে। নৃতত্ত্ববিদরা অবশ্য বাঁচে সংস্কৃতি নিয়ে। এই সংস্কৃতি পুথিসংক্রান্ত বা সাক্ষর। আমরা সবাই সাক্ষর সংস্কৃতি বাস করি। পুথি নিয়েই আমরা বাঁচি। পুথি আমারদের কাছে প্রামাণ্য। পুথি আমাদের নিশ্চয়তা দেয়। অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের কিছুটা নিশ্চিত করে। আবার পুথি আমাদের অতীত এবং ভবিষ্যতকে উচ্চবাচহীন, বৈচিত্রহীনও করে দেয়। সে কথায় পরে আসব। আমি বিশ্বাস করি, পুথিভিত্তিক জ্ঞান, স্মৃতিনির্ভর সাফল্যের সঙ্গে পুরোপুরি মুছে দিতে পারে না। সম্ভাবনা এবং প্রলোভন হয়ে স্মৃতিনির্ভর সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে থেকে যায়। আমরা কখনো স্বপ্নে, কখনো কবিতায় বা সঙ্গীতে বা চিত্রকর্মে তার মুখোমুখি যদি না হই, তাহলে একাকিত্বের, ব্যক্তিগত সংকটের কিছু মুহুর্তে তার সঙ্গে আমাদের মোলাকাত ঘটে। ভুলে গেলে চলবে না, মহত্তম, পবিত্র পুথি হিসেবে যা আমরা জানি প্রায়শই তা স্মৃতিনির্ভর শ্রুতির মাধ্যমে এসেছে। যা স্মৃতির বিরোধী। আর প্রাত্যহিক জীবনের যে সংস্কৃতি, তার অনেকটা জুড়ে থাকে স্মৃতি। একইসঙ্গে যা অধিগম্য এবং অনধিগম্য, প্রকাশিত অথবা সংগোপন, ভঙ্গুর অথবা বলশালী এবং অবশ্যই সচেতন ও অচেতন। স্মৃতিকে আমরা করে দিতে পারি না। এর ওপর দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করে। সেই জীবনের সবকিছুকে পুথির রূপ দেওয়া যায় না। ডিজিটাইজও করা যায় না। ইতিহাসের রূপ দেওয়া যায় না। একে ইতিহাসের রূপ দেওয়া যায় না, কারণ স্মৃতির সঙ্গে মানুষের অনুভুতি, আবেগ, সুখ-দুঃখ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, আশা-উচ্চাকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে থাকে। ইতিহাসে এসবের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস মহাফেজখানার দাস। ইতিহাসের পরিপূরক হিসেবে আপনাকে অতীত নির্মাণে, ইতিহাস নয়, এমন রূপগুলির সাহায্য নিতে হবে। আমাদের মনুষ্যত্বেও অন্যান্য অংশকে জায়গা দেবার এটাই একমাত্র পথ। ইতিহাস সম্বলিত পুঁথি লেখার যা আমরা ভুলে যাই। কারণ আমাদের মানুষ হয়ে ওঠা অংশত নির্ভর করে, আমাদের অনুভুতি, লক্ষ্য, ক্রোধ, ঘৃণা, ভালোবাসা, আবেগের ওপর। এগুলো নিয়েই মানুষ। সুচিত্রা সেনও এই কারণেই মানুষ হয়ে ওঠেন যখন তিনি নিশ্চিত করে যান, মৃত্যুর পরেও তার প্রকৃত চেহারাটা কেউ দেখতে পাবে না। এটা অবশ্য এক ভিন্ন বিষয়। কেউ বলতেই পারেন, নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার উচিত ছিল, ৮২ বছর বয়সে তিনি দেখতে কেমন হয়েছিলেন সেটা প্রকাশ করা। তার মনুষ্যত্বের সেটাও একটা অংশ। নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে, আত্মগোপন করে দোকান-বাজারে গিয়ে অথবা কফিনবন্দী দেহটা কেউ দেখতে পাবে না- এটা সুনিশ্চিত করে জীবনের সেই অংশটা মুছে ফেলা যায় এটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে আমার মনে হয় সেটা হল সুচিত্রা সেন হবার জন্য নিজের মনুষ্যত্বের একটা অংশকে অস্বীকার করতে হয়, এই বিষয়টা মেনে নেওয়া। সুচিত্রা সেন খুবই ভালো অভিনেত্রী ছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু অভিনয়টা তিনি যদি করে যেতেন পাবার সুযোগ যদি তিনি আমাদের দিতেন, তাহলে তিনি একজন মহীয়সী অভিনেত্রী হতে পারতেন। আমার মনে হয়, নিজের সৃজনশীলতার ওপর বিশ্বাস এবং মানসিক সুস্থতার এটা একটা ইঙ্গিতও বটে। আজকে মতো দিনেও [১৭ই জানুয়ারি ২০১৪, সুচিত্রা সেন প্রয়াত হন ] আমি একথা বলছি। হয়তো বলাটা ঠিক হচ্ছে না। যাই হোক, স্মৃতি হল এমন একাটা জায়গা, যেখানে আমাদের অভিজ্ঞতা, কল্পনা আর মূল্যবোধ সঙ্গে আমাদের উৎকণ্ঠার এবং গোপন সত্তার দেখা হয়। এই একটা জায়গায় সরকারি, আধিপত্যবাদী এবং সম্মানিতদের মাপকাঠিতে সবকিছু মাপা হয়না। তাই সমূহস্মৃতির কেবল স্মৃতি হওয়া ছাড়া আর কোনো দায় নেই। কশ্মীরী কবি আগা শাহিদ আলির কথায় বলি- তোমার ইতিহাস আমার স্মৃতির পথ আগলে দাড়ায়। আমি সেইসব কিছু, যা তুমি হারিয়েছ। (এখানে আমি-ও অর্থ স্মৃতি এবং তুমি হল ইতিহাস) তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি সেইসব কিছু, যা তুমি হারিয়েছ। তোমার যোগ্য শত্রু।’ কারণ জনস্মৃতি এমন অনেক কিছু আবার বলে, যা ইতিহাস হয়তো বলবে না। গণহত্যার ওপর আমি পনেরো বছর কাজ করেছি। আমি জানি, গণহত্যাতেও শ্রেণিভেদ থাকে। এই শ্রেণিবিন্যাসে বাংলাদেশের গণহত্যার কম অগ্রাধিকার পাওয়ার করণেই যে যুদ্ধোত্তর গত ৪১ বছরের বেশি সময় এক জটিল ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে, এই সত্য আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। কারণ বাংলাদেশের সেই গণহত্যা স্পনসরড তো বলব না, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর মহান প্রফেসর হেনরি কিসিজ্ঞারের মতো ব্যক্তিদের দ্বারা অংশত অনুমোদিত বলা যায়। সেই গণহত্যার স্মৃতি কখনোই অন্যান্য গণহত্যার সমান গুরুত্ব পায়নি। একই কথা বলা যায় ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যার সম্পর্কও। এ কোটি মানুষ যেখানে খুন হয়েছিল।আর তার তালিকা জুগিয়েছিল সিআইএ। নতুন একটা ছবি হয়েছে এর ওপর। The Act of Killing খুবই বিচলিত করার মতো ফিল্ম। সুযোগ পেলে অবশ্যই দেখবেন। ছবিটা যারা বানিয়েছে, তাদের প্রায় ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে, ছবির শেষে টাইটেল দেখানোর সময় লেখা ছিল, Anonymous, অজ্ঞাত। কারণ এরকম একটা ছবি বানানোর ঝুঁকি কতটা তা তারা জানে। কিন্তু সেই গণহত্যা থেকে কোনো অপরাধীর জন্ম হয়নি। সেটা মানব ইতিহাস। গণহত্যাতেও একটা জাতিভেদ প্রথা রয়েছে। কিছু গণহত্যা অচ্ছুৎ, আর কিছু ব্রাহ্মণের মতো। এর বেশি না ঢোকাই ভালো। সমুহ স্মৃতি আগলহীন, শৃঙ্খলমুক্ত। ব্যক্তির নীতিবোধ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই কারণেই সমূহ স্মৃতির জোরালো উপস্থিতিকে মুছে ফেলা বা শাসন করা যায় না। কল্পনাশক্তি তৈরি হয় ঐ স্মৃতির গাথনিতেই। সামাজিক সমালোচনার এক নিস্ক্রিয় অথচ স্থিতিস্থাপক রূপ হিসেবে এর গঠন হয়। এই সব স্মৃতির অস্তিত্বই টিকে থাকে সামাজিক সমালোচনার আকারে। একজন মানুষের ক্ষেত্রে স্বপ্নের যে ভূমিকা, স্মৃতি কখনো কখনো একটি জনগোষ্ঠীতে সেই ভূমিকা পালন করতে পারে। Memory Work সিগমুন্ড ফ্রয়েড- এর Dream Work- এর মতো। এই বক্তৃতার শিরোনাম ফ্রয়েড এর কাছ থেকেই নেওয়া। Memory work বা স্মার্ত সংস্কৃতি সামাজিক রীতিনীতির বাইরে থাকা এক বহুস্তরীয়। একাধারে যা স্পষ্ট এবং সুপ্ত। এর মধ্যেও অনেক প্রক্রিয়া চলে, যেমন সংক্ষেপ করে ফেলা, স্থানচ্যূতি, অন্তর্দর্শন এবং আনুষঙ্গিক সংশোধন। আমি বলছি ফ্রয়েড Dream Work-এর কথা। এখানে কোনোমনো বিশ্লেষক থাকলে তিনি বুঝবেন, কি বলতে চাইছি। আপাতত সে কথা থাক। এই প্রক্রিয়াগুলির প্রতিটি বাস্তবকে বাকিয়ে চুকিয়ে তাকে বিকৃত করে। স্মার্ত সংস্কৃতির যাবতীয় প্রক্রিয় বিকৃত। এটা সেই ডাক্তারের কাছে রোগীর একের পর এক রোগের লক্ষণ বলে যাবার মতো। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তারকেই ভিন্ন রূপে সেই লক্ষণগুলিকে বুঝে নিতে হয়। ব্যাপারটা একই রকম।
স্মার্ত সংস্কৃতি যেমন একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সৃজনশীলতার সুলুক সন্ধান দেয়, তেমনই কখনো কখনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে গণনিধনের উদ্ভট কল্পনার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। ঐতিহাসিক আঘাতগুলি প্রতিশোধের অপেক্ষায় রয়েছে- এমন এক অতিরঞ্জিত ভাবনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারে।
কিন্তু আমরা জনগোষ্ঠীর কথা বলছি। শেষপর্যন্ত এইসব বিকৃতি যে সমষ্টিগত ব্যাখ্যা (collective hermeneutic act) হয়ে দাঁড়ায় সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কারণ সমূহস্মৃতির মতো স্মৃতি আসলে কী, এ সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের এক সহমত, এই সংঘাতের মধ্যে দিয়েই যে উঠে আসে, তা কেউই মানতে চায়না। ব্যাখ্যা করার যে অধিকার সভ্য সংস্কৃতির রয়েছে, অবনমিত সংস্কৃতিগুলির তা নেই। আমি বলতে চাইছি সাঁওতাল বা গোঁন্দদের সংস্কৃতির কথা। স্মার্ত সংস্কৃতি, সভা এবং অবনমতি সংস্কৃতির মধ্যে সেই বৈষম্য ঘুচিয়ে দেয়। সভ্যতা আমাদের শেখায়, আশাবাদী সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সভ্যতা শব্দটা ব্যবহার করা যায় না। ওদের সংস্কৃতি অবনমনযোগ্য, বর্জনীয়, সেকেলে। এই অসম্যেও যোগ্য জবাব দেয় স্মার্ত সংস্কৃতি। যারা সভ্যতার ধারক-বাহক, তারা জগন্য মন্তব্য করলেও মানুষ তাদের ক্ষমা করে দেয়। কারণ তাদের অন্য কিছু আছে। পুঁথি আছে, যা দিয়ে তারা সেই বক্তব্যকে ন্যায্য করে তোলে। হেগেল, কান্ট, মার্কস- তিনজনই জাতি বিদ্বেষী ছিলেন। এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ওদের লেখা পড়ে দেখুন। কিন্তু এ কথা বলার সাহস করে না কেউ। কাকে বলে বশ্যতা আর কাকে বলে ভিন্নমত পোষণ, তার প্রাচীন পশ্চিমী ইমারত কিন্তু তৈরি হয়েছে এই জাতিবিদ্বেষীদের ভাবনার ওপরেই। তাই মার্কস সহজেই পার পেয়ে যায় যখন তিনি এ্যাঙ্গেলসকে লেখেন, ফ্রান্স যে আলজেরিয়া দখল করে নিয়েছে, সেটা ভালো হয়েছে। এবার ওই দেশটা সভ্য হবে।’ অথচ মার্কস যে দেশটাকে নিজের করে নিয়েছিলেন, সেই জার্মানী সভ্য হবার অনেক আগে থেকে আলজেরিয়া অত্যন্ত সভ্য একটি দেশ। তার ইতিহাস আড়াই হাজার বছরের। কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার। যে ঘৃণা নিয়ে কান্ট কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি জাতিবিদ্বেষী কথাবার্তা বলেন, একমাত্র ইউরোপীয় হবার সুবাদে আপনি সেরকম কিছু বলে পার পেতে পারেন। বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রণেতা জেফারসনের বাড়িতে দাস ছিল। এইসব উদাহরণে তাঁদের খাটো করা যাবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, তাদের অপছন্দ, কুসংস্কারের জন্য পশ্চাদপদ, সেকেলে বা জাতি বিদ্বেষী হিসেবে বিবেচিত হবে। সেইসব মানুষ, কোচিনে আমি যাদের পছন্দ করিনি। এভাবেই ব্যাপারটা চলে আসছে। স্মৃতির গুণগান করার জন্য আমি কোনো এজাহার দিতে বসিনি। স্মার্ত সংস্কৃতি যেমন একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সৃজনশীলতার সুলুক সন্ধান দেয়, তেমনই কখনো কখনো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে গণনিধনের উদ্ভট কল্পনার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। ঐতিহাসিক আঘাতগুলি প্রতিশোধের অপেক্ষায় রয়েছে- এমন এক অতিরঞ্জিত ভাবনা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারে। ঐতিহাসিক মানে বুঝতেই পারছেন, ওরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এই করেছে, ওই করেছে, আমাদেরও তার প্রতিশোধ নিতে হবে এইসব আর কি। কিন্তু আমি একথা অন্যত্রও বলেছি যে, স্মার্ত সংস্কৃতি আবার আমাদের শীলিত, পরিমিত বিস্মৃতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই বিস্ময়রণের কারণ স্মৃতির অক্ষমতা নয়, এর পেছনে থাকে, যাকে বলা যায় ভুলে যাবার নিয়মনিষ্ঠ নীতি। দেশভাগের ওপর কাজ সময় আমি এটা আবিষ্কার করেছিলাম। কখনো কখনো আপনি নির্দিষ্ট কিছু স্মৃতি জীবন থেকে মুছে ফেলেন। যা ভোলা যায় না, তা-ই যেন আপনি ভুলে গেছেন। যেন গণহত্যা বাস্তুচ্যূত হওয়া, অত্যাচার, রক্তক্ষয়ী সংঘাতের যেসব স্মৃতি আপনাকে তাড়া করে নিয়েছেন। দেশভাগের সময়কার সময়কার হিংসা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যারা প্রাণে বেঁচে গেছে, যে দিনগুলো রোজ তাদের মনে পড়ত, তাকে আর তারা স্মরণ করতে চায় না। তারা বিশ্বাস করে, ওটা এমন সময়, যখন মানুষ তাদের মনুষ্যত্বের সবটুকু হারিয়ে ফেলেছিল এবং সেটা স্মরণ করলে সাপ বা ভুতের মতো ওই দিনগুলো ফিরে আসবে। অন্যদের বিশ্বাস, ‘সেইসময় ওরাও উন্মাদ হয়ে গেছিল, আমরাও।’ হিংসা থেকে যাওয়া একজনের মন্তব্য ছিল এটা। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের Interpretation of Dreams, স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমি যেখান থেকে Memory Work নামটা ধার করেছি, টুকেছিও বলা যায়, অনেকেই মনে করেন ১৮৯৫ সালে সেই বইটির প্রকাশে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল। Stephen Toulmin-এর বিখ্যাত বই Cosmopolis-এও কারণ, ফ্রয়েডের ওই বইটি প্রথমবার দেখালো যে, নিজেদের সত্তার প্রভু আমরা নই। আশা করি, স্মার্ত সংস্কৃতির চর্চা, আমাদের নিছক স্মৃতির মহান মহাফেজখানা এবং সংগ্রহশালা তৈরি করতে প্রাণিত করবে না, বরং সেইসব জনগোষ্ঠীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাবে, যারা স্মৃতি, অক্ষরহীন সংস্কৃতি আর স্মৃতিনির্ভর জ্ঞানচর্চা, শিল্পকর্ম এবং জীবনচর্যায় বেঁচে থাকে। প্রান্তিক ও বিস্মৃত মানুষদের আপত আটপৌরে, বর্জনীয় স্মৃতিভাণ্ডারের গোটা বিষয়টিকে উপেক্ষা করা, আমাদের যে বৌদ্ধিক কর্মকাণ্ড রেওয়াজে পরিনত করেছে, আমার আশা, তার পুনর্মুল্যায়নে স্মার্ত সংস্কৃতির চর্চা আমাদের বাধ্য করবে। আলোকপ্রাপ্তির গরিমায় অন্ধ কার্ল মার্কস আর ভক্তরা, ‘প্রলেতারিয়েৎ’ শব্দটির পুর্বতন বিনম্রতর গ্রিক অর্থ ভুলে গেছেন। প্রলেতারিয়েৎ হল তারা, যারা ছিল, কিন্তু হিসেবে যারা ছিল, কিন্তু হিসেবে যারা ঠাই পায়নিা স্মৃতি আমাদের বলে যে, তারা আছে কিন্তু হিসেবের মধ্যে নেই। তারা আমাদের প্রতিবেশি কিন্তু আমরা তাদের সম্পর্কে বলার সময় অতীতকাল ব্যবহার করতে চাই।তারা যদি ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়, আমাদের চারপাশে থেকে বিড়ম্বিত না করে, তাহলে আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব। আমরা তাদের নিয়ে অস্বস্তি বোধ করি। তাই আমরা চমৎকার সব সংগ্রহশালা বানাই, যেখানে ভারতের অতীত গরিমা উদযাপন করে আদিবাসী সংস্কৃতি। সাক্ষর সংস্কৃতি যেখানে থাকে না। অনেক বছর আগে আমি এক Holocoust Museum-এ গিয়েছিলাম। সম্ভবত Los Angeles– এ। ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে সেখানে আমি কিছু কাজ করা চিরুনি, ছোটো আয়না, হাতে তৈরি ছিমছাম বাসন- কোসন আর লেসের কাজ, একটা কোনায় দেখেছিলাম। ওইরকম গোরামভারী পরিবেশে জিনিসগুলো একেবারে বেমানান লাগছিল। তখন একটা লেখা আমার চোখে পড়ল। লেখা আছে, এইসব হাতের কাজ নাৎসিরা সংগ্রহ করেছিল, বিলুপ্ত একজাতির ভবিষ্যত সংগ্রহশালায় রাখার জন্য। অবশ্যই ইহুদি সমস্যা চিরতরে মেটাতে বিশ্বের সমস্ত ইহুদিকে নিকেশ করার পর তারা সেই সংগ্রহশালা তৈরি করতে চেয়েছিল। স্মৃতিকে কায়দা মতো ব্যবহার করা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক অপরিহার্য অঙ্গ। ভারতের আদিবাসীদের কথা যদি ভাবি এবং আরো অনেক ক্ষুদ্র সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পরিস্থিতিবিশেষ বদলেছে বলে আমার মনে হয় না।
একটি সংস্কৃতির এবং মানুষের টিকে থাকা, তাদের স্মৃতির আনুষ্ঠানিক সংরক্ষনের ওপর নির্ভর করে না। Mexico City-র বিশাল নৃতত্ত্ববষিয়ক মিউজিয়ামটি বিশ্বের সর্বোত্তম সংগ্রহশালাগুলির একটি হিসেবে ধরা হয়। সেখানে আ্যজটেক, ইনকা, মায়া সভ্যতা যেভাবে টিকে রয়েছে, তা বাইরের চেয়ে ঢের ভালো। আমাদের প্রিয় প্রগতির তত্ত্বকারের পিছিয়ে পড়া অনেক জনগোষ্ঠী, এখন যাদের গালভরা নাম উন্নতিশীল সমাজ, তাদের একগুয়েমিতে প্রায়মই ভারী অসন্তুষ্ট হন। এরা শারীরিক অথবা সাংস্কৃতিক মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদর্শনশালায় বা ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে সংরক্ষিত হতে মোটেই রাজি নয় । যে স্মৃতি ইতিহাস আর তার নিয়মানুবর্তী পরস্পর অস্বীকার করে, সেই স্মৃতিতে আমার আগ্রহ। ইতিহাসের ধারণাকে আমি বাতিল করছি না, কিন্তু ঝাড়পোছ করা সব স্মৃতির চূড়ান্ত সম্মানজনক গন্তব্য হবার, ইতিহাসের যে ভান, তাকে খারিজ করছি। আমি বিশ্বাস করি, স্মৃতির টিকে থাকা আর বহমানতার অভিজ্ঞতার সবটাই প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে ছন্দে ধরা থাকে। নাৎসিবাদ এবং লেনিনবাদেও মতো হন্তারক অদর্শবাদের অবলুপ্তির পর এখন উন্নয়নের ধারণা নতুন এক আদর্শের জামা গায়ে দিয়েছে। এই বলিদান চায়। এর জন্য কোটি কোটি জীবন আর হাজার হাজার জীবনযাপনের বলিদান ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। কেউ সেজন্য ক্ষমা চায়নি। আমরা এই ক্ষতির জন্য দুঃখ করলে বলা হবে, এটা একধরণের পশ্চাদমুখী, রোমান্টিক অতীত বিলাসিতা (নষ্টালজিয়া)। ভয়ঙ্কর মহামারীর চেয়ে যা ভালো কিছু নয়। বিচিত্র নানা দিক থেকে স্মৃতি আক্রান্ত।
আমাদের চারপাশে স্মৃতিসমূহ শুধু যে তার নিবেদিতপ্রাণ বহিঃশত্রুর হাতে ধ্বংস হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী, ক্ষমতায় মত্ত স্বৈরাচারী এবং আমাদের ত্রুটিপূর্ণ, পশ্চাদমূখী সত্তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক সত্তা দিয়ে তার পরিপুরণ করতে চায় এমন উদ্ধত, আমূল সংস্কারবাদী সাংস্কৃতিক উদ্যোক্তারাই যে শুধু তাকে ধ্বংস করছে, তা নয়। আমাদের নিজেদের জাতি রাষ্ট্র, যে আমাদের ভালো চায়, অনুন্নত, গোঁয়ো, নড়বড়ে সবকিছুকে যে ঘৃণার চোখে দেখে তার হাতেও স্মৃতি ধ্বংস হচ্ছে। বিশ্বের এক বিরাট অংশের বৃহৎ সংখ্যক মানুষকেও সেকেলে, আর বাতিলযোগ্য হিসেবে নতুন আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের তিন বৃহৎ কৃষক সম্প্রদায়- রুশ, চীনা এবং ভারতীয়- মাত্র এক শতাব্দী আগেও যাদের ভয়ঙ্কর তেজী, হার না মানা আর অনড় বলে মনে হতো এখন তারা বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, বিশ্ববাজার আর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর ওপর বারাবরের মতো নির্ভরশীল, নুয়ে পড়া বাধ্য মানুষ। মেরূদণ্ড ভেঙে গেছে।
জনজীবনে এক অভিন্ন কর্মসুচী হিসেবে উন্নয়নের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতে আমরা আক্ষেপ করতাম যে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতাদেরই কেবল বেছে নেওয়া যায়, জনগণকে নয়। অশিক্ষিত, অলস লোকগুলোকে যদি বাদ দেওয়া যেত তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বোত্তর জার্মানী আর জাপানের মতো আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ভেল্কি দেখা যেত। আজকাল আমাদের উচ্চকাঙ্ক্ষা আরো বেড়েছে। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ বেছে নেবারও অধিকার চাইছি। বিশ্বে এখন গ্রিকরাই বৈধ পূর্বপুরুষের স্বীকৃতি পাচ্ছে। ইউরোপীয় enlightment বা আলোকপ্রাপ্তির প্রেরণা এসেছিল গ্রিকদের কাছ থেকে। অধুনিকতা বলতে এখন আমরা যে সংজ্ঞা দিই, তাও গ্রিকদেরই অবদান হিসেবে স্বীকৃত হতে চলছে। কিন্তু আমাদের পূর্ব পুরুষরা গ্রিক ছিলেন না। তাদের সঙ্গে গ্রিসের যোগাযোগ অবশ্য আজকের চেয়ে বেশি ছিল। আজকাল যাদের যাদের সবচেয়ে বড় গ্রিক অনুরাগী বলে ধরা হয়, তাদের নাম কেউ জানে কিনা, আমরা সন্দেহ আছে। মিশর, পারস্য ভারত এবং হতভাগা একটি দেশ- আফগানিস্তানের সঙ্গে গ্রিকদের ভালো যোগাযোগ ছিল। গান্ধার শিল্পে গ্রিক ভাষ্কর্য বেঁচে রয়েছে। চিকিৎসার গ্রিক পদ্ধতি বেঁচে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে। কিন্তু আমাদের স্বার্থে গ্রিকরা এখন এক ভিন্ন শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, ভাস্কর্য, সিনেমা, চিত্রকলা (Plastic art), প্রসেনিয়াম মঞ্চে অভিনয়, সংগীত, পর্যটনস্থল, জাতিগত বিবরণ এবং প্রদর্শশালায় পর্যবসিত যে শিল্প, স্মার্ত সংস্কৃতি তাকে নাও মানতে পারে। এটাই সব সংস্কৃতির ভবিতব্য। এইসব ক্ষেত্রে আটকে রাখা গেলে আপনার পক্ষে সংস্কৃতিকে জানা সহজ হবে। আপনি একজন কসমোপলিটান। ভিন্ন সংস্কৃতি, খাবার দাবার সঙ্গে আপনি পরিচিত। আপনি শনিবার চীনা খাবার খেতে পারেন। সোমবারগুলোয় ফরাসী ছবি দেখতে পারেন। নামী ইউনিভর্সিটিতে ethno medicine নিয়ে পড়তে পারেন। মেডিসিন বিভাগে এই পাঠ দেওয়া হয় না। দেওয়া হয় নৃতত্ত্ববিভাগে। আপনি সেক্ষেত্রে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেই মানুষটি হতে পারবেন না, যে Ethno Medicine প্র্যাক্টিস করে, অথবা যাদের নিজস্ব জাতিগত বিজ্ঞান রয়েছে অথবা পরস্পরাগত খাবার-দাবার যারা নিজেরাই বানায় ইত্যাদি। আমাদের চারপাশে স্মৃতিগুলোকে ভেঙ্গেচুরে তার নির্মাণ চলছে। ইভান-ইলিচ বলেছিলেন, নিজেদের স্বল্পোন্নত হিসেবে দেখতে শিখতে ২০০ কোটি মানুষের বিশ বছর লেগেছিল। আমার মনে হয়, এখনকার পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাকে নিজেদের ভবিষ্যত হিসেবে দেখতে শিখেছে বিশ্বের অন্তত ৩০০ কোটি মানুষ। যদি অনুমতি দেন তো আমার নিজের বহুব্যবহৃত কথাগুলো বলতে পারি, আড়াইশো সুশিক্ষিত, সুভদ্র গুণী ভারতীয় এবং চীনা নাগরিক, আজকাল মৃত্যর পর New York যেতে চায়। আমাদের চারপাশে স্মৃতিসমূহ শুধু যে তার নিবেদিতপ্রাণ বহিঃশত্রুর হাতে ধ্বংস হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী, ক্ষমতায় মত্ত স্বৈরাচারী এবং আমাদের ত্রুটিপূর্ণ, পশ্চাদমূখী সত্তার অবলুপ্তি ঘটিয়ে রাজনৈতিকভাবে সঠিক সত্তা দিয়ে তার পরিপুরণ করতে চায় এমন উদ্ধত, আমূল সংস্কারবাদী সাংস্কৃতিক উদ্যোক্তারাই যে শুধু তাকে ধ্বংস করছে, তা নয়। আমাদের নিজেদের জাতি রাষ্ট্র, যে আমাদের ভালো চায়, অনুন্নত, গোঁয়ো, নড়বড়ে সবকিছুকে যে ঘৃণার চোখে দেখে তার হাতেও স্মৃতি ধ্বংস হচ্ছে। বিশ্বের এক বিরাট অংশের বৃহৎ সংখ্যক মানুষকেও সেকেলে, আর বাতিলযোগ্য হিসেবে নতুন আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের তিন বৃহৎ কৃষক সম্প্রদায়- রুশ, চীনা এবং ভারতীয়- মাত্র এক শতাব্দী আগেও যাদের ভয়ঙ্কর তেজী, হার না মানা আর অনড় বলে মনে হতো এখন তারা বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, বিশ্ববাজার আর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর ওপর বারাবরের মতো নির্ভরশীল, নুয়ে পড়া বাধ্য মানুষ। মেরূদণ্ড ভেঙে গেছে। আত্মবিশ্বাস চলে গেছে। শত শত বছর ধরে যে অজস্র ছোটো ছোটো সংস্কৃতির তারা জন্ম দিয়েছে, তাকে লালন করেছে, সেগুলির কি কোনো ভবিষ্যত আছে? আমার মনে হয় না।
এবার শেষ পর্বে আসি। স্মৃতিরা কি আবার গেয়ে উঠবে ? আমি এখানে ভারতের দিকে তাকাব এবং দেখব, সংগঠিত স্মৃতিসমূহ জনপরিসরে কী করে টিকে থাকে। কী তদের ভবিতব্য। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি গত ৬০ বছরে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের দুটি মুখ্য ধারার বয়ে চলা যখন দেখি, তখন আবার আমার মনে আশার ছোয়া লাগে। এই সময়কালে সংগীতের এই দুই ঐতিহ্যকে বিধিসম্মত করে, আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে তাকে শিক্ষণোপযোগী করে তোলার চেষ্টা বার বার হয়েছে। ৫০টির বেশী ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শাস্ত্রীয় সংগীত শেখানো হয়। আপনি সেখান থেকে হিন্দুস্তানী বা কর্নটকি মার্গ সঙ্গীতে পি এই ডি করতে পারেন। সমীহ জাগানো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি এখন সংগীতে ডক্টরেট করে যথাযথ সংগীত বিশারদ বা সংগীত সমালোচক হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এখানো পর্যন্ত একটিও বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বড়মাপের শিল্পী বা সুরকার তৈরি করতে পারেনি। হাতে গোনা যে ক’জনের ক্ষেত্রে আমার এই মূল্যায়ন প্রযোজ্য নয় বলে মনে হচ্ছে, দেখেছি অবধারিতভাবে তারা দু-জায়গাতেই নাম লিখিয়েছেন। সংগীতবিদ্যার পাঠ তারা নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সংগীতের পরস্পারাগত তালিম তারা গ্রহণ করে গুরুর কাছ থেকে। তারা জানে গুরুর কাছে ব্যক্তিগত তালিম তাদের এমন কিছু দিতে পারে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখা যায় না। সৃজনশীল সংগীত শিখাতে গেলে, তাদের ফিরে যেতে হবে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক গুরুর কাছে। যাদের অনেকেই নিরক্ষর বা কেবল অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। ঐতিহ্যের তারা ধরে রাখেন স্মৃতিতে। সুতরাং সমাজের নীচু তলায় ক্ষুদ্র সংস্কৃতি, অসংখ্য স্মৃতিনির্ভর সংস্কৃতি নানা আকারে যা করে চলেছে, তাতে যেভাবেই হোক সমাজের উঁচু তলাতেও কিছু ঐতিহ্য টিকে গেছে। স্মৃতিনির্ভর এই ঐতিহ্যকে পুথিগত, সাক্ষর ঐতিহ্যের মধ্যে ধরে রাখা যায় না। গত ছয় দশকে ভারতের মধ্যে এবং বাইরে ভারতীয় মার্গ সংগীতের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে। আমার সেই সব দিন পেরিয়ে এসেছি, যখন আরতুরো তোসকানিনি (Arturo Toscanini) যথেষ্ট অবজ্ঞার সঙ্গে খোলাখুলি বলেছিলেন, ভারতীয় সংগীত, কোনো সংগীতই নয়। কারণ ভারতীয় সংগীতশিল্পীরা জানেন না কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ করতে হয়। এমনকি Max Mueller, সারা জীবন যিনি ভারত চর্চা করেছেন, তিনিও তাঁর ভারতীয় বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুরকে বলেছিলেন, ভারতীয় সংগীত তিনি সুর, ছন্দ কিছুই খুঁজে পান না। ভারতে এমনকি সমসাময়িক জনপ্রিয় শিল্পীরাও নিজেদের পেশাগত পাঠের জরুরি অঙ্গ হিসেবে মার্গসঙ্গীত শিক্ষা চালিয়ে গেছেন। বিশ্বের অনেক জায়গায়তেই এটা দেখা যায় না। আর যদি সৃজনশীলতার দিক থেকে দেখেন, তাহলে এই ঐতিহ্য সবচেয়ে বেশি স্মৃতির ওপর নির্ভশীল। এই সময়কালের সমস্ত মহান কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সূরকার, সংগীত শিক্ষকের ভূমিকা ছিল সপ্রাণ গ্রন্থাগার এবং চলমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। আমি শুরু করেছিলাম বিনম্রতর সংস্কৃতি দিয়ে। শেষও করতে চাই এই সংস্কৃতির একটি উদাহরণ দিয়ে। নৃতত্ত্ববিদ্ Stephen D. Thomas তার The last Navigator বইয়ে এক সংস্কৃতির কথা বলেছেন। আমাদের মতো একশো কোটি মানুষের তার ধারক নয়। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের প্রত্যন্ত দ্বীপ সাতাওয়ালে বসবাসকারী ছোট্ট এক জনগোষ্ঠী, যারা পুরুষাণুক্রমে নাবিক, তারা সেই সংস্কৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে। এই উদাহরণ হঠাৎই আমার নজরে আসে। বছর তিরিশেক আগে পিএইচডি-র ফিল্ড ওয়ার্ক হিসেবে Stephen Thomas সাতাওয়ালার একজনের কাছে শিক্ষানবিশী করেছিলেন। Mau Piailug নামে নাবিকটির কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন, কিভাবে সেই বৃদ্ধ জলের টান, ঢেউ, বাতাস, মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলির দৃশ্যপটে বদল, সমুদ্রের রঙে পরিবর্তন, আকাশ, সূর্যের অবস্থান, চাদ, গ্রহ, নক্ষত্র, পাখির উড়ে যাওয়া, মাছের ঝাঁকের গতিবিধি, ভেসে বেড়ানো জলজ উদ্ভিদ এবং এ রকম আরও অসংখ্য বিষয় পড়তে পারেন। এই দক্ষতায় ভর করেই প্রায় ছ’শো বছর আগে Piailug –এর পূর্বপুরুষেরা উত্তাল, ভয়ঙ্কর, প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দ্বীপে বসবাস শুরু করে। প্রজন্ম তারা এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি নিশ্চিত, আধুনিক নৌচালন প্রযুক্তির পাশে ওই বুড়ো নাবিকের জ্ঞান ভয়ানক সেকেলে ঠেকবে। কিন্তু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, গভীর পর্যবেক্ষণ আর অনুমান দক্ষতার মিশেলে যে বিপুল জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন, তার কী হবে? অশান্ত দরিয়ায় ভাসতে, পাকা নাবিকের সহজাত বিশ্লেষণী ক্ষমতার উৎস সেই জ্ঞান ভাণ্ডার, প্রথাবহির্ভূত নানা ভাবে যা মনের ভেতরে গেথে যায়, কী হবে তার? এর মধ্যে কোন্ স্মার্ত সংস্কৃতি রয়েছে? স্মৃতির দুনিয়ায় কী কী থাকা উচিত, সে সম্পর্কে আমাদের ধ্যান ধারণার সীমা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে Piailug-এর স্মৃতি কি আমাদের কিছু বলে? কোন কোন স্মৃতি নষ্ট করে ফেলা উচিত, আর কোন কোন স্মৃতি রক্ষা করার যোগ্য, তা স্থির করার যোগ্য, তা স্থির করার মাপকাঠিকে সে কি চ্যালেঞ্জ জানায়? থার্ড রাইখের মতো স্মৃতির কুলগৌরব নির্ধারণের কোনো অধিকার কি আমাদের আছে ? স্মৃতি হবার অযোগ্য স্মৃতিকে ধ্বংসের অধিকার? এই প্রশ্নগুলি দিয়েই আমি আমার বক্তব্য ইতি টানতে চাই। আশা করি, আমি তুলেছি বলে আপনারা আমার কাছে প্রশ্নগুলির জবাব চাইবেন না। ধন্যবাদ, নমষ্কার।
উৎস : প্রণবেশ সেন স্মারক বক্তৃতা সংগ্রহ ২, কলিকাতা লেটারপ্রেস, ২০১৭