বহাল ব্যর্থতার ইতিহাস

বহাল ব্যর্থতার ইতিহাস

অনেকটা অনুমিতভাবেই ব্ল্যাক ক্যাপসদের বিপক্ষে বড় পরাজয় দিয়ে সিরিজ শুরু করলো বাংলাদেশ। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ২৩২ রানে গুটিয়ে যাবার পর প্রত্যাশিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি বোলাররাও। আলোচনা-সমালোচনা চলছে স্কোয়াড নির্বাচন থেকে অথর্ব ব্যাটিং এবং নির্বিষ বোলিং নিয়ে। একটু গভীরে গিয়ে দেখতে চাই বিষয়টি।

দল নির্বাচন 

পয়লা ম্যাচে যে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে তা হলো রুবেলের জায়গায় সাইফুদ্দিন কেন? কিউই কন্ডিশনে রুবেলকে না দেখাটা স্বভাবতই সাওয়ালের জনম দেয়। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটি ভুল ছিলো না। আট উইকেটের বড় পরাজয়ের পরেও আমার এ অবস্থান অনেকের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে। যে কথাটি জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, ২৩২ ডিফেন্ড করতে গিয়ে আট উইকেটে আমরা হারতাম না যদি রুবেল থাকতো। সেটা অনুমান। বাস্তবতা হচ্ছে দলের স্কোর যে ২৩২ হয়েছে তাতে সাইফুদ্দিনের বেশ বড় অবদান রয়েছে। তিনি থাকা মানে দলের ব্যাটিং গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়া। বিষয়টি আসলে গোলমেলে হয়ে গিয়েছে। এমন কন্ডিশনে রুবেলের থাকা বাড়তি শক্তি যোগাবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু ব্যাট বল দু হাতেই ভূমিকা রাখতে পারায় সাইফুদ্দিনের দিকে পাল্লাটা বেশি ঝুঁকে যাচ্ছে। এখন একটি উপায় হতে পারে মিরাজকে ড্রপ করে রুবেলকে নেয়া। যদিও এটি কার্যকর হবার কোনো সম্ভাবনা আমি অন্তত দেখি না। হ্যাঁ, কিউই কন্ডিশনে স্পিন ততটা ধরে না। কিন্তু তাদের মাটিতে তাদের বিপক্ষে পুরো পেস অ্যাটাক নিয়ে খেলাটা হবে আত্মঘাতী। আরেকটি যা করা যায়, তা হলো মিরাজকে লিটনের জায়গায় নিয়ে এসে রুবেলকে জায়গা করে দেয়া। এটিও খুব একটা কাজে দিবে বলে মনে হয় না। নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে মেকশিফ্ট ওপেনার খেলানো খুব একটা স্বাভাবিক চিন্তার মধ্যে পড়ে না। ফল পক্ষে না আসলে অনেক ধরনের চিন্তাই মাথা আসে, সেটা স্বাভাবিকও। তবে, সব দিক বিবেচনায় আমার মনে হয় না সাইফুদ্দিনকে খেলানো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।

ব্যাটিং 

পয়লা ম্যাচে বাংলাদেশের পরাজয়ের পুরো দায় নিঃসন্দেহে ব্যাটসম্যানদের। মাশরাফিও ম্যাচ শেষে সেটা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন। ম্যাচের আগের একটি লেখায় আমি বলেছিলাম যে, কিউই সফরে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের যে সমস্যাটা প্রকটভাবে প্রকাশ পায় তা হলো স্ট্রাইক রোটেট করার অক্ষমতা। আপনি যদি ভালো ভাবে খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন যে পয়লা ম্যাচেও এ ধারাটি দেখা গিয়েছে। স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের প্রত্যেকেই রান তোলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন উচ্চাভিলাষী শট। এটি যতটা শট খেলার প্রবণতা ঠিক ততটাই সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে রানের চাকা সচল রাখার অক্ষমতা। যার ফলে খুব দ্রুতই সাজঘরে ফিরেছেন সকলে। অথচ, ক্রিজে ব্যাটসম্যানদের জন্য অনেক কিছুই ছিলো। যা মিথুনের ব্যাটিং দেখেই বোঝা গিয়েছে। উইকেটে থাকতে পারলে রান আসবেই, এটা ক্রিকেটের বেসিক বিষয়। এটা জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা জানেন না বলে মনে করার কিছু নেই। জানা জিনিস মাঠে প্রয়োগ করতে না পারাটাই এখানে সমস্যা।

আরেকটি বিষয়টি যা মনে হয়েছে তা হলো আমাদের ব্যাটসম্যানরা নিজেদের উইকেটের গুরুত্ব বুঝতে অক্ষম। তামিম যে বলটিতে আউট হয়েছিলেন সেটি বাদে বাকি স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের প্রায় প্রত্যেকেই আউট হয়েছেন অহেতুক শট খেলতে গিয়ে। লিটন, মুশফিক বাইরের বল উইকেটে টেনে এনে বোল্ড হলেন। মাহমুদুল্লাহকে স্বাচ্ছন্দ্য মনে হলেও তিনিও উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন। সাব্বির যে ঠিক কি করতে চেয়েছিলেন সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। দুটো শট খেলার পরে সটান শুয়ে পড়াটা আশ্চর্য বললেও কম বলা হয়। স্পিন খেলে অভ্যস্ত একটি দেশের ব্যাটসম্যান সাধারণ টার্নেই যদি ধরণীতল হন তাহলে ঠিক কি বলা উচিত নিশ্চিত নই। এদের মধ্যে সৌম্যকে দেখে আশা জাগছিলো ভালো কিছুর। যেভাবে তিনি খেলছিলেন তাতে মনে হচ্ছিলো সমস্ত সমালোচনার জওয়াব তিনি দিয়ে দেবেন। সেটি যে ক্ষণিকের মতিভ্রম তা তিনি বুঝালেন অহেতুক শট খেলে। ঐ অবস্থায় শট খেলার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকা জরুরি ছিল, এটা ক্রিকেট সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখা আদমিও বোঝেন। শুধু বোঝেন না নির্বাচকদের প্রিয়পাত্ররা। যারা নিশ্চিত যে, যাই করুন দলে জায়গা পাক্কা।

সবার মধ্যে সবচেয়ে অনভিজ্ঞ আদমিটিই এদিন নিজ কাধে তুলে নিয়েছিলেন দলকে টানার জোয়ালা। এর আগের সফরেও তিনি এটি ভালো করেই করে দেখিয়েছেন। মিথুনের এমন দায়িত্ব নিতে পারাটা দলের জন্য বেশ ইতিবাচক। সমস্যা যেটি তা হলো ষাটের ঘরে গিয়েই তিনি আটকে যাচ্ছেন বারবার। নতুন অবস্থাতেই যে পরিপক্কতা তিনি দেখাচ্ছেন তাতে সময়ের সাথে ইনিংস বড় করাও শিখে যাবেন বলে আশা করা যায়। তিনি রান পেয়েছেন বলেই শুধু না আমাকে মুগ্ধ করেছে তার রান করার ধরন। বাকিরা যেখানে শট খেলাকেই সমাধান মনে করেছেন তিনি সেখানে ছিলেন বেশ ধীর স্থির। এ উইকেটে রান পাওয়ার জন্য যার জরুরাত ছিল, টিকে থাকা; সেটি তিনি বেশ বুঝেছিলেন।

ব্যাটিংয়ে যে বিষয়টি ইতিবাচক লেগেছে তা হলো টেইল এন্ডারদের রান পাওয়া। বর্তমান প্রেক্ষাপটে টেইল এন্ডারদের কাছেও ব্যাট হাতে দলের প্রত্যাশা থাকে। ভারতের দিকে যদি আমরা খেয়াল করি, দেখা যাবে যে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাফল্যের অন্যতম কারণের একটি শেষের দিকের ব্যাটসম্যানদের রান পাওয়াটা। মেহেদি এবং সাইফের ব্যাট ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিপর্যয়ের সময় তারা যে দায়িত্বটি পালন করেছেন তা থেকে ব্যাটসম্যানদেরও শেখার আছে।

বোলিং

বোর্ডে ২৩২ নিয়ে বর্তমানে জেতাটা খুব কঠিন। কিন্তু সেটিও বাংলাদেশের বোলিং ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য যথেষ্ট বলে আমার মনে হয় না। মাশরাফি যদিও বোলিংয়ের প্রশংসা করেছেন। ব্যাটিংয়ের সাথে তূলনা দিলে সেটি করাও যায়। কিন্তু বোলাররা এদিন খুব একটা ভালো করেননি। আউট করতে পারেননি সেটা তো স্কোরকার্ডেই স্পষ্ট, গাপটিলদের সে অর্থে পরীক্ষাও নিতে পারেনি মাশরাফি এন্ড কোং। যার বোলিংয়ের দিকে বাংলাদেশ তাকিয়ে থাকে সে মোস্তাফিজকেও এদিন মনে হয়েছে সাদামাটা। একদম সাদা চোখে ধরা গিয়েছে সাকিবের শূন্যতাটা। এখানে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো সাকিবের জায়গায় বল হাতে মাশরাফি সাব্বিরের ওপর ভরসা করলেন কেন? ব্রেক থ্রু দেবার জন্য মাহমুদুল্লাহ বরাবরই বেশ ভালো একটি অপশন। তাকে ব্যবহারে কেমন যেন একটা অনীহা প্রকাশ পাচ্ছিলো। তবে, বোলিংয়ের সাথে এদিন ক্যাচিংও খারাপ হয়েছে। বিরুপ অবস্থায় ক্যাচ ড্রপ বোলারের আত্মবিশ্বাস তলানীতে নিয়ে যায়। সেটিই দেখা গিয়েছে এদিন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে ২৩২ করে জিতার স্বপ্ন দেখাটা অলীকই বলা যায়।

আসলে সিরিজ শুরু হবার সপ্তাহখানেক আগে গিয়ে নিউজিল্যান্ডে মানিয়ে নেয়াই কঠিন। এবারের প্রস্তুতিটা আদর্শ প্রস্ততি হয়নি। টানা খেলার ধকলও স্পষ্ট। এ বিষয়টি চিন্তায় নিলে খুব বড় বিপর্যয় হয়েছে বলা যাবে না, বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অতীত বিবেচনায় নিলে। আরেকটি দিক নজর কেড়েছে আমার। সাম্প্রতিক সময়ে যা কিছু নৈপুণ্য আমরা দেখেছি তা সিনিয়রদের কাছ থেকেই। এ ম্যাচে নতুনরা বেশ উজ্জ্বল ছিলেন সে তুলনায়।