কিউবা বিপ্লবে ফিদেল কাস্ত্রোর পরপরই যার নাম উঠে আসে তিনি আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। তাকে বিপ্লবের স্মারক বলাও ভুল হবে না। তার মত বিপ্লবীও সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতমালায় চলতেন, লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতেন ক্লান্তিভরে। তার লেখা বিপ্লবের হ্যান্ডবুকে ‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’এ তিনি তরুণ বিপ্লবীদেরকে সতর্ক করে লিখেছিলেন “একজন গেরিলা সেনার জীবনের অনেকটা সময় কাটে একঘেয়েমি সময় পার করে।” তাই অবসাদ কাটানোর জন্য তিনি পড়ার পরামর্শ দিতেন। বেশিরভাগ বিপ্লবীই সে সময় উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। চে ছিলেন একজন ডাক্তার, কাস্ত্রো ছিলেন আইনজীবী এবং বেশিরভাগই কলা বিভাগে স্নাতক। জঙ্গলে ক্যাম্প চলাকালীন তাদের অধিকাংশ সময়ই কাটতো জ্ঞান আহোরণে এবং সাহিত্যবিলাসে। এমন কি সেই ক্যাম্পে সবচেয়ে পৌরুষপূর্ণ যোদ্ধাটিও ছিলেন বই পাগল। পড়তে ভালোবাসতেন তারা।
গেরিলা যোদ্ধাদের অকেজো বোঝা না নিয়ে নানা রকম মননশীল ও ননফিকশন পুস্তক সঙ্গে নেওয়ার পরামর্শ দিতেন গুয়েভারা। তিনি বিশ্বাস করতেন অতীতের বীরদের জীবনি, ইতিহাস, অর্থনৈতিক ভূগলে এ সকল জ্ঞান মানুষকে জুয়াখেলা, মদপানের মত পাপ কাজ হতে বিরত রাখবে। ১৯৫৭ সালে সিবিএস টিভির সাংবাদিক রবার্ট তাবের গিয়েছিলেন বিপ্লবীদের ক্যাম্পে। সেখানে তিনি রিডার্স ডাইজেস্ট এর একটি স্প্যানিস ম্যাগাজিন দেখেছিলেন যা ছিল সবার মাঝে খুব জনপ্রিয়। ম্যাগাজিনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক মানুষদের জীবনি ছিল। ম্যাগাজিনটি প্রতিনিয়তই একেক জনের হাতে হাতে ঘুরতো। উপন্যাসও তাদের মাঝে ছিল বেশ জনপ্রিয় পাঠবস্তু। ইতালিয়ান ঔপন্যাসিক কুর্জিও মালাফার্তে রচিত ‘দ্যা স্কিন’ ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি উপন্যাস। ‘দ্যা স্কিন’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নৃশংসতার উপর লেখা অনবদ্য একটি সৃষ্টি। ফিদেল কাস্ত্রো বিশ্বাস করতেন যদি কখনো বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং তারা কিউবা দখল করতে পারে তবে পড়া শোনার এই অভ্যাস তাদের কাজে দেবে। তার লোকেরা এই অভ্যাসের বসেই কিউবার মঙ্গল নিয়ে আসবে। ফিদেল কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রো। ফিদেল’র মৃত্যুর পর কিউবার রাষ্ট্রপতি তিনি। বিপ্লবের সময় টগবগে এক গেরিলা যোদ্ধা। তার ডায়েরিতে তিনি এক স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, এক সকালে সময় ৮টা পাঁচ অ্যাম্ব্যুস করার সময় ছিল। তিনি অ্যাম্বুসের কথা ভুলে গিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এক উপন্যাস নিয়ে। উপন্যাসটি ছিল এমিলি জোলার সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘দ্যা বিস্ট উইথ ইন’। শুধু রাউলই নন, এমন গ্রন্থপ্রেমিক গুয়েভারাও ছিলেন। একবার তিনি বিমান আক্রমনে মারা পরতে যাচ্ছিলেন কারণ তখন তিনি এডওয়ার্ড গিব্বনের লেখা ‘দ্যা হিস্টরি অফ দ্যা ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দ্যা রোমান এম্পায়ার’ বইটির মধ্যে ডুবে ছিলেন!
রাতে চলত আড্ডা। আড্ডা বলা ভুল হতে পারে। গল্পের আসর। গল্প শুনে অনেক রাতও পার করেছেন বিপ্লবীরা। তাছাড়া কবিতা ছিল জমজমাট! এদেশের ঐতিহ্যের মত সেই বিপ্লব বসতিতেও চলত কবিতা পাঠ ও শ্রুতির আসর। এ অঞ্চলে ঠিক যেমন পুঁথিপাঠ হত তেমনটা। তাদের ভেতর একজন চাষী ছিলেন। নাম, জস ডি লা ক্রুজ। বিপ্লবী নাম ছিল ‘ক্রুসিটো’। তিনি তো নিজেকে ‘মাউন্টেইন নাইটেঙ্গেল’ দাবি করতেন। গোউয়াজিরা (পাহাড়ি গেয়ো) নামের ১০ পঙ্কতির একটি গাঁথাও রচনা করেছিলেন তিনি। গাঁথাটি ছিল সে সময়কার দুঃসাহসিক বিপ্লবী জীবন নিয়ে রচিত। জঙ্গলে হোমারের মত পাইপ টানতে টানতে আবৃত্তি করতেন তিনি। চলত কাব্যযুদ্ধ! তিনি যুদ্ধে শহিদ হন। তার লেখা কিউবাতে সংরক্ষিত আছে।
বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রো স্প্যানিশ সাংবাদিক ইগনাসিয়ো রামোনেট’র কাছে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি ১৯৪০ এ লেখা আর্নেস্ট হেমিঙওয়ের ‘হুম দ্যা বেল টোলস’ বইটি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন “এই উপন্যাসটি আমাকে এবং আমার লোকদেরকে বুঝিয়েছে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে আমাদের সংগ্রাম কতটা অনিয়মিত এবং ভিন্ন ছিল।” তিনি আরও বলেন “বইটি আমার জীবনের অংশ হয়ে আছে। এখনো আমরা বইটিকে নিয়ে আলাপ করি। নতুন অনুপ্রেরণা পাই আমরা।”
আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে ছিলেন আমেরিকান লেখক। তাকে নিয়ে কিউবাও প্রচুর চর্চা হত। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক। পেশার খাতিরে ১৯৩৭ সালের স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ দেখেছেন স্বচক্ষে। তার অভিজ্ঞতার খাতিরেই তিনি উপন্যাস লেখেন। সেখানকার অনিয়মিত যুদ্ধের ধরনটাই উঠে আসে তার লেখায়। পুরাতন হাভানার একটি হোটেল কলোনিয়াল অ্যাম্বোস। ওই হোটেলের ৫১১ নম্বর রুমে বসেই আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে তার উপন্যাসের খসড়া টাইপ করেছিলেন। কে জানতো একদিন এই ভূমিতেই অমনই একটা যুদ্ধ হবে! আর তার বইটা হবে অনুপ্রেরণা! বইটা যখন বের হয় তখন ফিদেল আর তার সহযোদ্ধারা ছিল ছোট্ট। হলিউডে সিনেমাও হয়েছে ঐ গল্পে। তবে ফিদেল বলে ঐ সিনেমা আসার আগেই ফিদেল তা দুইবার পড়ে ফেলেছিলেন।
গেরিলা যুদ্ধের বিশেষ কার্যপদ্ধতি যেমন অ্যাম্ব্যুস এর ধরন, সাপ্লাই নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সম্পর্কে আর্নেস্তোর বইয়ে পূর্ণ ধারণা না থাকলেও নানা কিছু নিয়েই দেওয়া ছিল বিশেষ ধারণা। কিভাবে পার্টির গোপন জায়গা খুজতে হয়, গ্রেনেড কত দূর থেকে ছুড়তে হয় ইত্যাদি ভালোমতো দেওয়া ছিল বইটিতে। তবে বিশেষ করে বইটিতে যেটা দেওয়া ছিল তা হল গেরিলা যুদ্ধের মত একটি অনিয়মিত যুদ্ধ সম্পর্কে মানসিক ধারণা।
যদিও আর্নেস্ট হেমিঙওয়ের লেখা বই কিউবার বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল। তবে লেখক নিজে কিউবার বিপ্লব সম্পর্কে ছিলেন নিশ্চুপ। তিনি তার জন্মভূমি আমেরিকার সাথেই তাল মিলিয়েছিলেন অনেকটা। তবে তার মৎস্য শিকার জাহাজের কাপ্তান গ্রিজারিও ফুয়েন্টেস বলেছিলেন বিপ্লব চলাকালীন আর্নেস্তো ফিদেলের জন্য তার জাহাজে অস্ত্র পাঠিয়েছিলেন তবে তা প্রমাণিত হয় নাই। তবে তিনি কিউবার স্বৈরশাসক ফুলগেন্সিও বাতিস্তার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তবে জনসম্মুক্ষে বিপ্লবের পক্ষে তার পদক্ষেপ ছিলো এই যে তিনি তার নোবেল পুরস্কার কিউবার জনগণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
বিপ্লবে আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে নিরেপক্ষ অবস্থানে থাকলেও কিউবার বাতিস্তা কখনই তা বিশ্বাস করেন নি। কিউবার গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তিনি ভালোই হেনস্তা করেছিলেন আর্নেস্ট হেমিঙওয়েকে। হাভনায় তার বাড়ি ‘লা লিন্সা ডি ভিজিয়া’য় অস্ত্র আছে এমন অভিযোগে অনেকবারই তল্লাশি করা হয়। এমনকি বাতিস্তা বাহিনী তার বাড়িতে তল্লাশি করার সময় তার প্রিয় কুকুর ব্ল্যাককে তার চাকরদের সামনে নৃশংসভাবে খুন করে। বন্দুকের বাট দিয়ে কুকুরটিকে মারা হয়। আর্নেস্তো তখন ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কুকুরটিকে সুইমিংপুলের পাশে কবর দেওয়া হয়। ওই জায়গাটিতে আর্নেস্ত কুকুরটিকে পায়ের কাছে নিয়ে বসে থাকতেন। হাভানায় ফিরে সব ঘটনা শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে যান আর্নেস্তো। তার কিউবান বন্ধুদের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তিনি বাতিস্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় মামলা করতে যান। সাধারণ কোন মানুষ অমন কাজ করলে হয়ত তাকে নির্ঘাত মরতে হত তবে একজন আমেরিকান লেখককে কিছু বলার সাহস পায়নি বাতিস্তা প্রশাসন। তবে তিনি তার মামলার বিচার আর পাননি। ঐ বাড়িতে এখনো ব্ল্যাকের কবরটি রয়েছে যদিও সে বাড়িতে কোন পর্যটক গেলে তাদের বলা হয় না কবরটি কার?
পুরো বিশ্ব যখন ফিদেল কাস্ত্রোর জয়ে মাতোয়ারা তখন আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে ছিলেন সাহিত্যের আলো জ্বালাতে ব্যাস্ত। হাভানায় ‘দ্যা প্যারিস রিভিউ’র তরুণ সম্পাদক জর্জ প্লিমটন ও ইংরেজ সমালোচক কেনেথ তাইয়ানের সাথে আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে ব্যস্ত ছিলেন তার প্রিয় বার এল ফ্লোরিডিটায়। তখন তার কাছে বাতিস্তার কাছের দোসরদের মৃত্যুদণ্ড নিজ চোখে দেখা নিমন্ত্রণ আসে। তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন কিভাবে সবার সামনে তাদেরকে গুলি করা হয়েছে। যদিও কিউবার পক্ষেই তিনি ছিলেন তবে তিনি ব্যাপারটাকে মোটেও সহজভাবে নেননি। প্লিমটন তার স্মৃতিকথায় বলে ছিলেন “একজন লেখকের কাছে সকল কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় বিশেষ করে মানব ব্যবহার। এটা সহজ হয় তখনই যখন আবেগগুলোকে ধরা যায়।”
ঐদিনের ওই মৃত্যুদণ্ড কিছুটা সময় পিছিয়ে যায়। ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয় সেখানে। তবে আর্নেস্ট হেমিঙওয়ে ভাবছিলো অন্যকিছু। সেখানে সেদিন ধারণাতীতভাবেই সাহিত্যের পরাজয় হয়েছিল।