খেলাধুলা কে না পছন্দ করে! নিজের পছন্দের খেলোয়াড়ও দলকে সমর্থন দেওয়া থেকে শুরু করে নিজের পছন্দসই দল কিংবা খেলোয়াড়কে সেরা প্রমাণ করার জন্য আমরা বন্ধুদেরকেও তর্কে হারিয়ে দিতে চাই। আমরা অতীত পরিসংখ্যান ব্যবহার করি যাতে ভালো খেলোয়াড়কে আলাদা করে সেরা প্রমাণ করা যায়। খেলাধুলা আমাদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে খানিকটা রঙের ছোঁয়া লাগায়, সারাদিনের অবসাদ আমরা মুহূর্তেই ভুলে যাই। তবে যখন ট্রাজেডি খেলাধুলা জগতকে আঘাত করে তখন আমরা প্রায়ই মনে করিয়ে দিই যে, দিন শেষে এটি শুধুমাত্র একটি খেলা। যে অ্যাথলেটদের কসরত দেখে আমরা এতো করতালি দিয়ে উৎসাহিত করি, তারাও তো মানুষ। তারা এমন মানুষ, যারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য তাদের সমগ্র জীবন ব্যয় করেছে। একটি দুর্ঘটনা বদলে দিতে পারে তাদের জীবনের সকল হিসেব, মুছে দিতে পারে লালন করা স্বপ্নগুলো।
আসুন জেনে নিই ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন ১০ টি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবন কতই না মূল্যবান!
১. বজ্রপাতে ১১ ফুটবলারের মৃত্যু :
১৯৯৮ সালের অক্টোবরে বেনা তশাদি ও বসঙ্গার মধ্যে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের কাসাই প্রদেশে একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হঠাৎ বজ্রপাতে বেনা তশাদির ১১ জন খেলোয়াড় মৃত্যুবরণ করেন যাদের বয়স ছিল ২০-৩০ এর মধ্যে। বজ্রপাতে আরো ৩০ জন মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছিলেন। তবে অদ্ভুতভাবে বাসঙ্গার পুরো দল অক্ষত অবস্থায় মাঠ ত্যাগ করতে পেরেছিল।
পরবর্তীকালে বাসাঙ্গা এই ঘটনায় জাদুবিদ্যার জন্য অভিযুক্ত হয়েছিল। কেননা অনেক কেন্দ্রীয় ও পশ্চিম আফ্রিকান দল তাদের বিরোধীদের অভিশাপ দেওয়ার জন্য তখন ডাক্তারদের নিয়োগ দিতো। ওই এলাকায় গৃহযুদ্ধের পরিমাণ এতো বেশি ছিল যে এই ঘটনা আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনের মুখ দেখেনি।
২. মাতাল ড্রাইভার দ্বারা নিক অ্যাডহেন্ট খুন :
নিকোলাস জেমস অ্যাডহেন্ট ছিলেন একজন আমেরিকান ডানহাতি বেসবল খেলোয়াড়। ২০০৪ সালে সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে অ্যাডহেন্ট একজন সেরা ও সম্ভাবনাময় বেসবল খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি কাঁধের ইনজুরিতে পড়েন। লজ এঞ্জেলসে টুর্নামেন্টে তিনি ১৪তম নির্বাচিত হন এবং তিনি মেজর লিগের পথে বেশ ভালোভাবেই অগ্রসর হতে থাকেন। বেশ সম্ভাবনাময় এই তরুণের ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই মাত্র ২২ বছর বয়সে ২০০৯ সালে একজন মাতাল ড্রাইভার দ্বারা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
৩. হকির মাঠে ডন স্যান্ডারসনের মৃত্যু :
২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর অন্টারিও হকি অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র লিগের খেলা অনুষ্ঠিত হয় ব্রেন্টফোর্ড ব্লাস্ট এবং হুইটবি ডানলপসের মধ্যে। খেলার মাঝে স্যান্ডারসন প্রতিপক্ষের দ্বরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বরফের উপর পড়ে যান। তিনি মাথায় বাজেভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এই ঘটনায় স্যান্ডারসন কোমায় চলে যান এবং ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারিতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোমাতেই থাকেন। ডন স্যান্ডারসনের মৃত্যু হকিতে যুদ্ধের মানসিককতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি করে।
৪. গাড়ী দুর্ঘটনায় নিহত ড্যান স্নদার :
ড্যান স্নদার ছিলেন কানাডিয়ান হকি খেলোয়াড় যিনি এনএইচএল এর আটলান্টা থ্রেশার্সের হয়ে ৪৯ টি গেমস খেলেছিলেন। ২০০৩ সালে স্নদার বন্ধু ও সহপাঠী ড্যানি হিটলের ফেরারি গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন হিটলে। প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮০ মাইল গতিতে গাড়িটি চলছিল। হঠাৎ গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং একটি লোহার বেড়াতে বিপর্যস্ত হন। স্নদার কোমায় চলে যান এবং ছয় দিন পরে ৫ অক্টোবর ২০০৩ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান।
৫. লেন বিয়াসের ওভারডোজ :
লেন বিয়াস ম্যারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তাকে ধরা হতো স্কুল ইতিহাসের সেরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে। এমনকি তাকে মাইকেল জর্ডানের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হতো। ১৯৮৬ সালে বিয়াস আগের বছরের শিরোপাধারী বোস্টন সেলটিসকে হারিয়ে দেন। এই জয়ের ৪৮ ঘন্টারও কম সময়ে বিয়াস ডর্ম রুমে কোকেইনের ওভারডোজের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বিয়াসের এমন দুঃখজনক মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ১৯৮৬ সালেই অ্যান্টি ড্রাগ অ্যাবিউজ অ্যাক্ট পাস করা হয়।
৬. হকি ইনজুরিতে বিল মাস্টারটনের মৃত্যু :
বিল মাস্টারটন ডেনিভার ইউনিভার্সিটিতে চার বছর কলেজ হকি এবং মিনেসোটা নর্থ স্টারে ৬ বছর ছোটো-খাটো লিগ খেলতেন। এনএইচএল ক্যারিয়ারে মাত্র ৩৮ টি ম্যাচ খেলার পর ১৯৬৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি ক্যালিফোর্নিয়া সিলের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে বরফের উপর পড়ে যান। মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার দুই দিন পর ২২ বছর বয়সে মাস্টারটন মারা যান। এনএইচএলের ইতিহাসে তিনি একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বরফের আঘাত থেকে মারা যান।
৭. মিউনিখে বিমান দুর্ঘটনা :
১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবল দল যুগোস্লাভিয়া রেড স্টার বেলগ্রেডের বিপক্ষে ৩-৩ গোলে ড্র করার পরে ম্যানচেস্টারে ফিরে আসছিল। প্রচণ্ড তুষারের কারণে বিমানটি গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। বিমানটি রানওয়ে অতিক্রম করার সময় ঘর-বাড়ি ও গাছপালার সাথে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় ২৩জন যাত্রী নিহত হয় যাদের মধ্যে আট জনই ছিল ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়।
৮. ডেল আর্নহার্ডের মৃত্যু :
ডেল আর্নহার্ড ছিলেন একজন রেসিং গাড়ির ড্রাইভার যিনি তার ক্যারিয়ার জুড়ে সাতটি চ্যাম্পিয়নশীপ জিতেছেন। ডেটোনায় ২০০১ সালে আর্নহার্ড স্টার্লিং মার্লিনের গাড়িটি আঘাত করে এবং গাড়িটি একটি প্রাচীরে বিধ্বস্ত হয়। ক্র্যাশটি ফিনিস লাইন থেকে মাত্র অর্ধেক মাইল দূরে ঘটে যেখানে আর্নহার্ডের ছেলে ডেল আর্নহার্ড জুনিয়র মাত্রই ফিনিস লাইন শেষ করে। ডেল জুনিয়র তার বাবাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। ৪৯ বছর বয়সী আর্নহার্ড মাথায় মারাত্মক আঘাতের কারণে মারা যান।
৯. মার্শাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমান দুর্ঘটনা :
১৯৭০ সালের ১৪ নভেম্বর উত্তর ক্যারোলিনা থেকে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে যাওয়ার পথে মার্শাল ইউনিভার্সিটি ফুটবল দলকে বহনকারী একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ট্রাই-স্টেট এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র দু’মাইল দূরে পাহাড়ের পাশেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ৭৫ জন যাত্রীর সবাই মারা যান যাদের মধ্যে ফুটবল খেলোয়াড়, কোচ, টিম ডাক্তার, মার্শাল ইউনিভার্সিটির অ্যাথলেটিক পরিচালক এবং দলের সহায়তাকারীরা ছিলেন।
১০. এমিলিয়ানো সালার বিমান দুর্ঘটনা :
আর্জেন্টিনার উঠতি তারকা ফুটবলার এমিলিয়ানো সালার বিমান দুর্ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ফুটবল দুনিয়া। ফ্রান্সের নঁতে খেলা এই ফুটবলার প্রিমিয়ার লিগ খেলার স্বপ্নকে পুঁজি করে কার্ডিফ সিটিতে যোগ দেন। ফ্রান্সকে বিদায় জানিয়ে কার্ডিফের পথে যাত্রা করে সালাকে বহনকারী বিমানটি। ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি সোমবার রাতে ফ্রান্স আর কার্ডিফের মাঝে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের সময় রাউডারের বাইরে চলে যায় সালাকে বহনকারী বিমানটি। এরপর আর বিমান কিংবা সালার হদিস পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিন পরে বিমানের ধ্বংসাবশেষ ও সালার মৃতদেহ উদ্ধারে সক্ষম হয়েছে উদ্ধারকারী দলটি।