লোপেতেগুই এর রিয়াল, সোলারির রিয়াল

লোপেতেগুই এর রিয়াল, সোলারির রিয়াল

দু’সপ্তাহ আগেও সোলারির রিয়াল সম্মানের সাথে মৌসুমটা সমাপ্ত করতে পারলেও বর্তে যাবে, ভাবনাটি ছিলো এমন। লিগ তো দুর, যে আসরে রিয়াল বরাবরই সফল সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই কতটা কি করতে পারবে তা নিয়ে সকলে ছিলো সন্দিহান। নিজেদের সর্বশেষ দুটো ম্যাচে ব্লাঙ্কোসরা বদলে দিয়েছে সকল হিসাব-কিতাব। বার্সার সাথে ক্যাম্প ন্যুতে ক্লাসিকো ড্র করার পরের ম্যাচেই নগর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলেটিকোকে তাদেরই মাঠে হারিয়েছে ৩-১ গোলে। যার ফলে নয়া করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন মাদ্রিদ সমর্থকরা।

রিয়ালে যেন এক নয়া রাওয়াইয়্যাত চালু হয়েছে। হাই প্রোফাইল কেউ ব্যর্থ হলেই দায়িত্ব বর্তাচ্ছে কাস্তিয়ার কোচের ওপর। এবং ধ্বংসস্তুপ থেকে তারা টেনে বার করছে মাদ্রিদকে। রাফায় বেহাল রিয়ালকে উদ্ধার করেছিলেন জিদান। এবার লোপেতুগুইয়ে সম্ভ্রম হারাতে বসা রিয়ালের রক্ষাকর্তা রুপে আবির্ভুত সোলারি। জিদানের দায়িত্ব নেয়ার সময়টাতে অনেকেই সংশয়ে থাকলেও সমর্থক বড় কম ছিলো না। এর পিছনে ছিলো তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার এবং রিয়ালেই কার্লো অ্যাঞ্চেলত্তির সহকারি হিসাবে থাকা। খেলোয়াড় হিসাবে জিদানের মাপের না হলেও সোলারি অংশ ছিলেন প্রজেক্ট গ্যালাক্টিকোস এর। তবু, তার উপর ভরসার করাটা বেশ কঠিনই মনে হচ্ছিলো শুরুতে।

লোপেতেগুই কিন্তু দলকে পেয়েছিলেন একটি দারুণ অবস্থায়। হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের ফলে দলের পরিবেশ ছিলো দারুণ। রোনালদোর বিদায় তাতে ধাক্কা দিলেও তা সামলানোর মতন যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন তিনি। তারপরেও লোপেতেগুই কে বিদায় নিতে হয়েছে খুঁব বাজে ভাবেই। তার অধীনে দলের অবস্থাও হয়ে পরেছিলো সঙ্গীন। সমস্যাগুলো আসলে কি ছিলো? আর সোলারিই বা কি করেছেন?

লোপেতেগুই এর সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো রিয়ালের প্রথাগত ধরনটি বদলে ফেলার চেষ্টা। কাউন্টার এবং গতিতে খেলা রিয়ালকে তিনি চেষ্টা করেছিলেন পাসিং এবং পজিশনাল ফুটবল খেলাতে। আরো মারাত্মক ছিলো ইস্কো কেন্দ্র করে দল সাজানোর চেষ্টা। পয়লা এল ক্লাসিকোতেই আমরা যেটি দেখেছিলাম। তার সামর্থ্য নিয়ে ফুটবল বিশ্লেষকদের মধ্যে সংশয় না থাকলেও ফ্রি রোলে তিনি বলার মত কোনো কিছু করতে পারেননি এটাই সত্য। সে সাথে লোপেতেগুই বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিয়েও ছিলেন সন্দিহান। যাদের উপর আস্থা রাখেছিলেন তাদেরও সঠিক ভাবে ব্যবহারে ব্যর্থ ছিলেন তিনি। তার সবচেয়ে বড় ভুল, যা এখন দৃশ্যমান স্পষ্টভাবেই; তা হলো ভিনিসিয়াসকে পরখ করতে না পারা।

রিয়ালের মত দলকে সামলানো এমনিতেই কঠিন। সেটি যদি হয় স্বল্প অভিজ্ঞতায় এবং বিরূপ পরিস্থিতিতে তাহলে হালত কতটা কঠিন হয় তা সহজেই অনুমেয়। সোলারি যখন দায়িত্ব নেন তখন দলের আত্মবিশ্বাস ছিলো তলানীতে। জয়ের জন্য যাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে রিয়াল তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলো অফ ফর্মে। পয়েন্ট টেবিলে যে অবস্থায় ছিলো তাতে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে রিয়াল সরাসরি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ালিফাই করতে পারবে কি না? যে দলটিকে সব সময়ই শিরোপার লড়াইয়ে ফেভারিট বিবেচনা করা হয় তাদের নিয়ে এরুপ আলোচনাই তো স্পষ্ট করে দেয় কোথায় পৌঁছেছিলো রিয়াল।

সোলারির দায়িত্ব নিয়েই জয়ের মুখ দেখেছিলেন বটে তবে আস্থা ফেরানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো না। সোলারিও কিন্তু স্থির হতে পারছিলেন না। প্রায় নিয়মিতই একাদশে বদল আনছিলেন, বদলাচ্ছিলেন ফর্মেশনও। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা ছিলো, ঐরকম পরিস্থিতে প্রয়োজন ছিলো সাহসী কিছু সিদ্ধান্তের। যা নেবার ক্ষেত্রে সোলারির অস্বস্তিটা ছিল স্পষ্ট। যেমন অফ ফর্মে থাকা মার্সেলোকে বসানো কিংবা লোপেতিগের সময়ে মূল মুখে পরিণত হওয়া ইস্কোকে ব্যবহার করার বিষয়টি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিলো আক্রমন। রোনালদোর অনুপস্থিতিতে যেন আত্মবিশ্বাসই হারিয়ে ফেলেছিলো পুরো ইউনিট।

বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে সোলারি কিন্তু ফিরেছেন সেই প্রথাগত ৪-৩-৩ এই। এ ফর্মেশনে সাফল্যের জন্য যে বিষয়টি অপরিহার্য ছিলো তা হলো দুই উইংগার এবং উইংব্যাকদের পারফর্ম করা। সোলারি এখানে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেটি বেশ কার্যকরই প্রমাণিত হয়েছে। দুপাশে ইস্কো এবং বেলের পরিবর্তে সোলারি খেলাচ্ছেন ভিনিসিয়াস এবং লুকাস ভাস্কেজকে। লুকাসের কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকলেও বেলের পরিবর্তে তাকে প্রথম একাদশে জায়গা দেয়াটাকে বেশ সাহসী বলা যায়। তবে সবচেয়ে বড় জুয়াটা নিঃসন্দেহে ছিলো ভিনিসিয়াসকে শুরু থেকে খেলানোর সিদ্ধান্তটি।

মাত্র আঠারো বছরের একজনকে রিয়ালের জার্সিতে নিয়মিত শুরু করতে দেখাটা বিস্ময়কর। কিন্তু ভিনিসিয়াস রিয়ালের জন্য যেন হয়ে এসেছেন এক মুক্ত বাতাস হয়ে, যা রিয়ালের জন্য খুবই প্রয়োজন হয়ে পরেছিলো। সোলারির পক্ষে বাড়তি হিসাবে এসেছে নতুন রুপের বেনজেমা। বাড়তি দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়ে বিগ বেনজু অসাধারণ এক জুটি গড়ে তুলেছেন ভিনি এবং লুকাসের সাথে। মাঝ থেকে বেনজেমা যেন প্লেমেকারের ভূমিকা নিজ কাধে তুলে নিয়ে দুই তরুণকে সুযোগ করে দিচ্ছেন স্বাধীনভাবে নিজেদের খেলাটা খেলার। রোনালদোর বিদায়ের পর এমন একজনকে দরকার ছিলো রিয়ালের। খেলানোর পাশাপাশি দরকারের সময় গোল করার দায়িত্বটাও পালন করে চলেছেন তিনি।

সেই সাথে স্বমহিমায় মাঠে ফিরেছেন ফিফা বর্ষসেরা মদরিচ এবং ক্রুস। মৌসুমের শুরু দেখে যারা এ যুগলের সমাপ্তি টেনেছিলেন তাদের কড়া জওয়াবই দিচ্ছেন এ দু’জন। সাথে কাসেমিরো তো রয়েছেনই। আর পিছনে ফাদার ফিগারের ভূমিকায় রামোস। রিয়ালের রক্ষণ অন্যান্য দলের মত কখনোই ইস্পাত কঠিন না। রামোসকে তো প্রায়শই দেখা যায় উপরে চলে যেতে, সেটির ফলে যে শূন্যতার সৃষ্ট হয় ভারান যেন সময়ের সাথে সাথে শিখছেন তা কাভার করা। রেগুলন মার্সেলোর মত টানা ওভারল্যাপ না করায় তিনিও সহায়তা করতে পারছেন। সমস্যা যা, তা হলো কর্তোয়ার রিয়ালের জার্সি গায়ে এখনো নিজ নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারাটা। এক্ষেত্রেও সোলারির হাতে রয়েছে নাভাসের মত দারুণ এক বিকল্প।

সোলারি আরো একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উইংব্যাকদের নিয়ে। মার্সেলোর জায়গায় রেগুলন কে খেলানোটা। এটা অবশ্যই খুব সাহসী সিদ্ধান্ত ছিলো। কেননা, রিয়াল সমর্থক এবং ম্যানেজমেন্ট উভয়ের কাছেই মার্সেলো খুবই প্রিয় একজন। এমন একজনকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেয়া মানেই এক বিশাল হৈ চৈ। সেটি সোলারি করেছেন খুব সাবধানের সাথে। একবারেই মার্সেলোকে সরিয়ে না দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িয়েছেন রেগুলনের প্লেয়িং টাইম। এ জায়গাটায় বলতেই হয় তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। ধীরে ধীরে কার্ভাহালের জায়গায় অদ্রিওজোলাকেও তিনি প্রস্তুত করে নিচ্ছেন।

সোলারির আরো একটি বিষয় জিকরের দাবি রাখে। বেঞ্চটাকে লোপেতেগুই এর আমলে যতটা দুর্বল বলে মনে হচ্ছিলো এখন আর ততটা না। সোলারির আরো একটি বিষয় যেটি তার পক্ষে যাচ্ছে তা হলো তার নিয়মিত প্লেয়ার রোটেশন। প্রায়ই কাসেমিরোর জায়গায় তিনি খেলাচ্ছেন লরেন্তেকে। সাবেয়োস, ডিয়াজরাও মাঠে নামছেন নিয়মিত। যার ফলে, মূল কেও মাঠের বাইরে চলে গেলেও খুব বড় কোনো শূন্যতা জনম নিচ্ছে না।

সোলারি কিন্তু শুরু থেকেই বলছিলেন রিয়াল শেষ পর্যন্ত শিরোপার জন্য লড়াই করে যাবে, তখন কোনো পাড় সমর্থকও সেটি ইয়াকিন করেছে বলে মনে হয় না, কিন্তু এখন যেন সব কিছু অন্য রকম। অ্যাথলেটিকোর বিপক্ষে ম্যাচ শেষে রামোস কিন্তু জোড় দিয়েই বলেছেন শিরোপার জন্য লড়াইয়ের কথাটা।

এখন বিষয়টি হচ্ছে সোলারির এ মৌসুমের সাফল্যর নির্ণায়ক কি শিরোপা হবে? আমার অন্তত তা মনে হয় না। নানা কারণেই রিয়ালের জন্য মৌসুমটা ছিল প্রতিকুল। সে অবস্থায় দলকে কক্ষে ফেরানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যা জায়গায় তিনি বেশ সফল। এ মুহূর্তে যে মাদ্রিদ, তা শিরোপা জিতবেই এটি বলা কঠিন। তবে, সোলারি যেভাবে দলকে গুছিয়ে আনছেন তাতে রিয়ালকে শিরোপার জন্য খুব বেশি সময় যে অপেক্ষা করতে হবে না তা বলে দেয়াই যায়।

রিয়াল এবং সোলারির জন্য এ মাসের সূচিটা কঠিন হলেও এটিই মৌসুমেস বাকি সময়ের মোমেন্টাম গড়ে দিতে পারে। যেকোনো বিবেচনাতেই ক্লাসিকোর ফলের প্রভাব ব্যাপক। পরের দুটো ক্লাসিকোতেও যদি সোলারি পরাজয় এড়াতে পারেন সেটি রিয়ালের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ। আর যদি জয় আসে তবে তো কথাই নেই।

মানুষ শিখে জন্মায় না, সময় থেকে শিখে। সেটি সোলারি যে খুঁব ভালো পারেন তা তো স্পষ্ট। সামনে উদাহারণ হিসাবে রয়েছে এক সময়ের সতীর্থ জিদান। জিদানের কির্তীর পুনরাবৃত্তি করতে পারাটা কঠিন, সেটি যদি নাও পারেন খুব খারাপ কিছু হবে না। বরং, সোলারি ইতিহাসটা লিখুন নিজের মত করে। তাতে তার তো বটেই রিয়াল সমর্থকদের মুখেও ফিরে আসবে হারাতে বসা হাসি।