তাসমান সফরে ব্যাটিং অর্ডার এবং পরিসংখ্যান

তাসমান সফরে ব্যাটিং অর্ডার এবং পরিসংখ্যান

অতীতের বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড সফর মানেই হতাশার গল্প। নিজেদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে গিয়েও গেলোবার যা বদলাতে পারেনি টাইগাররা। এবারের প্রস্তুতি এবং প্রস্তুতি ম্যাচের ফল মাথায় রাখলে, পুরোনো সিলসিলা বদলে যাবে এটি ইয়াকিন করা বেশ কঠিনই ঠেকছে। তারপরেও স্বপ্ন দেখার তো শেষ নেই। তো সেই স্বপ্নের পথে যা চোঁখ রাঙাচ্ছে তা হলো পরিসংখ্যান, এবং যেটি স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে পারে তা হলো সঠিক কম্বিনেশন। এ দুটো বিষয়ের জিকর কেন করা হলো তাই ব্যাখ্যা করবো ক্রমান্বয়ে।

তাসমান সফরে বাংলাদেশের ব্যর্থতার মূল কারণ বরাবরই ব্যাটিং। প্রস্তুতি ম্যাচেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। টপ অর্ডার ধারা বজায় রেখে আরো একবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে প্রস্তুতি ম্যাচে। তামিমরা ফিরলে অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে সাধারণ ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে কিউইদের বিপক্ষে তামিমের অতীত।

গত কয়েক বছরে নিজেকে বিশ্বের সেরা ওপেনারদের একজন হিসাবে সাবুদ করা তামিমের ক্যারিয়ার গড় ৩৬.৬৪। বাংলাদেশের বিবেচনায় যাকে অনায়াসে অসাধারণ বলা যায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন নিউজিল্যান্ড তখন সে গড় কমে দাড়ায় ২৭.৮৯ এ। মজার বিষয় হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সে গড় হয়ে যায় ক্যারিয়ার গড়ের প্রায় সমান, অর্থাৎ ৩৬.১৮। এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তামিমের গড় বাড়াতে সাহায্য করেছে যে ইনিংসটি তা এসেছে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে গত বিশ্বকাপে। ক্যারিয়ারে এগারোটি সেঞ্চুরি থাকলেও একটিও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আসেনি। মারকুটে বলে পরিচিতি থাকলেও ব্লাক ক্যাপসদের বিপক্ষে তার স্ট্রাইক রেট মাত্র ৬৮.৪৭।

দলের মূল ব্যাটসম্যানদের একজনের এই অবস্থাই বলে দেয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থা কতটা সঙ্গীন। হতাশার বিপরীতে সবসময়ই আশার আলো থাকে। তামিমের ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে সদ্য সমাপ্ত বিপিএল’র ফাইনালে খেলা ইনিংসটি। কোনো সন্দেহই নেই বাংলাদেশের টি টোয়েন্টির ইতিহাসের সেরা ইনিংসটি তার আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দিবে। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের এই সিরিজটিতে তাই তামিমের সুযোগ থাকছে পুরোনো ইতিহাস বদলে দেয়ার।

সৌম্য নাকি লিটন? তামিমের সাথে ইনিংসের সূচনা কে করবেন সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বাংলাদেশ দলে নয়া কিছু না। কিন্তু, আমরা যদি পরিসংখ্যানের জিকর করি তাহলে তামিমের সাথে লিটনকে বেছে নেয়াই শ্রেয়। কেননা সাকিব না থাকায় সৌম্যকে যদি ওপেনিং এ নামানো হয় তাহলে লিটনকে খেলাতে হবে তিনে অথবা মিডল অর্ডারে। সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে যেসব জায়গায় তিনি ডাহা ফেল মেরেছেন।

স্পষ্ট করা যাক বিষয়টা। এমনিতেই তার ক্যারিয়ারের গড় ২১.৯৫, যা বর্তমান দলে বড্ড বেমানান। তিনে খেলা ইনিংসগুলোতে সেটি আরো কমে হয়ে যায় ১৫.৮৭। যা অনেক বোলারের চেয়েও কম। তিনে নেমে কখনো অর্ধশতকের দেখাও পাননি তিনি। সর্বোচ্চ ৪১। বিরূপ কন্ডিশনে এখন পুনরায় তাকে তিনে পরীক্ষা করা বিবেচকের কাজ হবে বলে মনে হয় না। ক্যারিয়ারে যে দু’বার তিনি পঞ্চাশের ঘর পেরোতে পেরেছেন তার দুটোই এসেছে ওপেনিংয়ে।

এখন আসা যাক সৌম্যকে কেন তিনে খেলানো যৌক্তিক সে বিষয়ে। তার ক্যারিয়ার গড় ৩৫.৯৪। ওপেনিংয়ে যেটি হয়ে যায় ৩৫.১৩ এবং তিনে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩.৪৪ এ। এমনিতেই সৌম্য নির্বাচকদের বদৌলতে অটো চয়েজ। সাকিব না থাকায় তাকে বাদ দেয়ার কোনো চিন্তাই যে থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মাথায় খেলবে না তা বলাই বাহুল্য। এমন অবস্থায় নয়া পরীক্ষায় না গিয়ে তাকে তিনে নামানোই বেহতার। যদিও মাত্র নয় ম্যাচের পরিসংখ্যান বিবেচনায় কোনো উপসংহারে আসা কঠিন, তারপরেও এটি বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, মিডল অর্চারের যে কয়েক জায়গায় তিনি একাধিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন কোনো জায়গাই তার গড় বিশও না। যেহেতু লিটনকে নিচে নামালে তার অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে পরে তাই সৌম্যকে তিনে রাখাই বেহতার হবে।

যে স্কোয়াড নিয়ে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছে তাতে সব যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে মিডল অর্ডারের থাকবেন মিথুন, মাহমুদুল্লাহ এবং মুশফিক। মাহমুদুল্লাহ এবং মুশফিককে নিয়ে তেমন ভাবনার কিছু আপাতত নেই। মুশফিক তো বিপিএল থেকেই রানে রয়েছেন, প্রস্তুতি ম্যাচে মাহমুদুল্লাহও দিয়েছেন রানে ফেরার ইঙ্গিত। এছাড়া বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কিউইদের বিপক্ষে মাহমুদুল্লাহর রেকর্ডই সবচেয়ে ভালো। তার ক্যারিয়ারের তিনটি সেঞ্চুরির দুটিই এই তাসমান দ্বীপপুঞ্জের দলটির বিপক্ষে। এশিয়া কাপে মিডল অর্ডারে নেমে সফলতা দেখিয়েছেন মিথুন। তাই তাকে নিয়েও টানা হেঁচড়া ঠিক হবে বলে মনে হয় না।

মাহমুদুল্লাহ এবং মুশফিককে নিয়ে একটি মজার সমস্যা আছে। দুই ভায়রাই চার নাম্বারে দারুণ খেলেন। চারে নেমে মুশফিক খেলেছেন ৮০টি ম্যাচ। ক্যারিয়ারে ছয়টি সেঞ্চুরির সব কটিই তিনি করেছেন চারে নেমে। গড়ও চল্লিশের উপরে, ৪২.২১। অপরদিকে মাহমুদুল্লাহ চারে নেমেছেন ১৮ ম্যাচে। সেখানে নেমে করেছেন দুটো সেঞ্চুরি। গড়ও দেখার মতো, ৫০.২১। যেহেতু দুজনকেই চারে নামানো সম্ভব না তাই দুজনের মধ্যে একটা ব্যল্যান্স খুঁজে বার করতে হবে। সেক্ষেত্রে মুশফিককে চারে নামিয়ে মাহমুদুল্লাহকে ছয়ে খেলালে খুঁব একটা খারাপ হবে না। দুজনের মাঝে থাকতে পারেন মিথুন।

স্পেশালিস্ট ব্যটসম্যানদের মধ্যে বাকি থাকে একটি জায়গা, সেটিতে সাব্বিরই অটো চয়েজ। প্রতিভাবান বলে পরিচিতি থাকলেও এখনো সে অর্থে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। তিন, ছয় এবং সাতেই তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে তাকে। তিনের নামা একজন ব্যাটসম্যান এবং ছয়ে নামা একজন ব্যাটসম্যানকে বিচার করার মানদণ্ড কিন্তু এক না। তিনের সাফল্য যেখানে মাপা হয় গড় দিয়ে সেখানে ছয়ের বা সাতের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আসে স্ট্রাইক রেটও। বিষয়টি যে তার কাজটি কঠিন করে তুলেছে বলাই বাহুল্য।

সাব্বিরের নিজের জন্যই শুধু না, দলের জন্যও তার একটি নির্দিষ্ট জায়গা বার করা প্রয়োজন। তার খেলার ধরণ মাথায় রাখলে তাকে সাতে নামানোই বেহতার। গড় ঠিক রেখে শট খেলতে গিয়ে তিনি যে সাফল্য পাননি তা তার ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিনায়ক যেহেতু তার উপর আস্থা রাখেন, তাই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে যে কাজে তিনি ভালো; অর্থাৎ শট খেলা, সেটি তাকে অবাধে করতে দিয়ে দেখা উচিত।

আরেকটি বিষয় একটু জিকরের দাবি রাখে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রায় সবার স্ট্রাইক রেটই ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের চেয়ে ভালো। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি ইতিবাচক মনে হলেও গভীরে প্রবেশ করলেই দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বিরূপ কন্ডিশন এবং সুইং বোলিংয়ের সামনে পিচে পড়ে থাকার চেয়ে পাল্টা আক্রমণে সালাহ খোঁজার সাবুদ এই স্ট্রাইক রেটগুলো। নিউজিল্যান্ডের মাঠগুলো কিছুটা ছোট হবার ফলেও দেখা যায় শট খেলার প্রবণতা। সেই সাথে বিরূপ পরিস্থিতিতে স্ট্রাইক বদল করে খেলার অনভ্যস্ততাও এখানে চলে আসে। এগুলো কাগজে কলমে স্ট্রাইক রেটটাকে বাড়ালেও আক্ষরিক অর্থে কাজে আসে না তেমন। এখানে পিচে টিকে থাকার চেষ্টা না করে শুধু যদি বাউন্ডারির ওপর নির্ভর খেলা খেলার চেষ্টা করা হয় তাহলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে মনে হয় না।

যে ব্যাটিং ক্রমটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা পরির্তনে ভয়াবহ কোনো পাপ হবে না। ম্যাচের পরিস্থিতি মেনে পরিবর্তন হতেই পারে। তেমন কিছু না ঘটা পর্যন্ত এটাকেই আমার আদর্শ ক্রম বলে মনে হয়। যেহেতু পরীক্ষাটি কঠিন, তাই নয়া কোনো কিছু না করাই বেহতার। অপরদিকে সামনে যেহেতু বিশ্বকাপ তাই সঠিক কম্বিনেশনটাও এ মুহূর্তে খুজে পাওয়া আবশ্যক।