বিপিএল’র শেষটা মিশ্র হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। তামিমের অনবদ্য সেঞ্চুরি যেমন সকলের ঠোঁটে মুসকানের জনম দিয়েছিলো, সাকিবের ইনজুরির খবর সে মুসকান কেড়ে নিয়েছে মুহূর্তেই। এবার সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দিকে নজর ফেরানোর। যা শুরু হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ান ডে ম্যাচ দিয়ে।
বছরটি যেহেতু বিশ্বকাপের, তাই তার ঠিক আগে এই সফরটি পাচ্ছে বাড়তি গুরুত্ব। বলাই বাহুল্য সেটি কন্ডিশনের সামঞ্জস্যের জন্য। এছাড়া এবারের সফরে বিশেষ লক্ষ্য থাকবে বিশ্বকাপের আগে সাম্ভাব্য সেরা কম্বিনেশনটা খোঁজার। সময় যেহেতু খুব বেশি বাকি নেই, তাই ঘর সামলে নিতে হবে দ্রুতই। একটু দেখার চেষ্টা করবো আশার এবং আশঙ্কার দিকগুলো।
ব্যাটিং
বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের প্রধান পেরেশানি টপ অর্ডার। তামিম নিয়তই নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেও তার সাথে তাল মেলাতে পারছেন না বাকিরা। এবারের আসরে তামিমকে সঙ্গ দেবার জন্য নেয়া হয়েছে সৌম্য এবং লিটনকে। জিম্বাবুয়ে সিরিজে রেকর্ড গড়া সাফল্যের পরেও দলের সঙ্গে যাবার সুযোগ হয়নি ইমরুলের।
বিপিএল’র শুরুতে ছন্দে না থাকলেও শেষটা তামিম করেছেন প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ভাবে। ঢাকাকে যেভাবে তিনি কচুকাটা করেছেন এতটা বোধহয় কেউই আশা করেনি। পেরেশানির বিষয় হচ্ছে যার ফর্ম নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা ছিলো না সে আদমিই আসর রাঙালেন। যে দু’জনের রানে থাকা ছিলো পরমারাধ্য তাদের একজন কিছুটা ঝলক দেখালেও অপরজনের হালত হতশ্রী। রানে থাকা অবস্থাতেই উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের কঠিন পরীক্ষার মুখে পরতে হয় নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে। সেখানে রান-খরায় থাকা দু’জন কতটা কি করতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান হওয়াটা স্বাভাবিক।
সাকিবের অনুপস্থিতি মিডল অর্ডারে একটি বড় শূন্যতার জনম দিতে পারে। এটি মেটানোর জন্য বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে মুশফিক এবং মাহমুদুল্লাহকে। সাথে থাকবেন জাতীয় দলের হয়ে পয়লাবার নিউজিল্যান্ড সফর করা মিথুন। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র দুজন বাংলাদেশির গড় ত্রিশের ওপরে। সাকিব ছিলেন তাদের একজন। তার না থাকাটা তাই বাংলাদেশের জন্য বড় একটি ধাক্কা। মুশফিক বাংলাদেশের মূল ব্যাটসম্যান হলেও ব্লাক ক্যাপসদের বিপক্ষে তার রেকর্ড করুণ। অভিজ্ঞতা এবং সাকিবের অনুপস্থিতে রেকর্ড মাথায় রেখেই বলতে হচ্ছে এবার তার কাছে প্রত্যাশাটা থাকবে অনেক। সেটি যদি তিনি পূরণ করতে না পারেন তবে বাংলাদেশের জন্যই জনম নিবে কঠিন এক পরিস্থিতির।
সাব্বির ফিরে আসায় একজন পিঞ্চ হিটারের অভাব পূরণ হবে আশা করা যায়। সাব্বিরকে নিয়ে নয়া কোনো পরীক্ষার বদলে তাকে স্লগের জন্য রেখে দেয়াই যৌক্তিক হবে বলে আমার ধারণা। বর্তমান সময়ে একজন স্লগারের গুরুত্ব ব্যাপক। যেহেতু সাব্বির শুরু থেকেই দ্রুত রান তুলতে পারেন তাই তাকে নিয়ে টানা হেচড়া না করে স্বাধীনভাবে স্লগ করতে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার নিষেধাজ্ঞার সময়ে যারা সুযোগ পেয়েছেন কেউই যেহেতু তা কাজে লাগাতে পারেননি, তাই আপাতত সাব্বিরে ভরসা বৈ বিকল্প নেই।
বোলিং
বলাই বাহুল্য নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে স্পিনারদের পরিবর্তে পেসারদের দিকেই চেয়ে থাকতে হবে অধিনায়ককে। সাকিব না থাকার ফলে যে শূন্যতাটি সৃষ্টি হবে তা মেটানোর কাজও মাশরাফি-মোস্তাফিজদেরই করতে হবে।
বিপিএল বাংলাদেশের পেসারদের যেন এবার নতুন করেই চিনিয়েছে। যেখানে একজন পেসারের জন্য হাহাকার করে মরেছি আমরা সেখানে এ বিপিএল এই দেখা গেল যারা নিয়মিত খেলছেন তারা তো বটেই পাইপলাইনেও মানসম্পন্ন পেসারের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। রুবেল, তাসকিন, মাশরাফি এবং সাইফুদ্দিন তো সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকার শীর্ষ পাঁচেই জায়গা করে নিয়েছেন।
তাসকিন যেমন ছন্দে ছিলেন তাতে তাকে এ মুহূর্তে না পাওয়া তার জন্য যতটা দলের জন্যও ঠিক ততটাই হতাশাজনক। মাশরাফির নিয়ন্ত্রিত বোলিং এর সাথে উইকেট সংখ্যা বেশ ভালো মতই বুঝিয়ে দিয়েছে যে তিনি এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য যথেষ্ট ফিট। মাশরাফির নেতৃত্বে পেস অ্যাটাকের মূল সেনা মোস্তাফিজ। তার দল ব্যর্থ হলেও পুরো আসরেই মোস্তাফিজ ছিলেন দারুণ ছন্দে। কখনো রান আটকিয়ে চাপ সৃষ্টি করে, কখনো বা প্রয়োজনীয় সময়ে উইকেট তুলে নিয়ে সাবুদ করেছেন নিজের অপরিহার্যতা। মূল দুই বোলারের ছন্দ বাংলাদেশকে আশাবাদী করতেই পারে। আমি কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছি অপর পেসার রুবেলকে নিয়ে।
পুরো আসরে বিশটিরও বেশি উইকেট নেয়ার পরেও রুবেলে কেন আমি চিন্তিত তা বরং বলি এবার। ফাইনালে তিনি চার ওভারে রান দিয়েছেন প্রায় পঞ্চাশের মত। পুরো আসরের সাফল্যকে এক ম্যাচের নিক্তিতে পরিমাপ করে তাকে আমি ব্যর্থ বলছি না। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, খুবই প্রয়োজনের মুহূর্তে রুবেলের খেই হারানোর অভ্যাসটা এখনো বদলালো না। তার সামর্থ্য, অভিজ্ঞতা কোনোটা নিয়েই আমার প্রশ্ন নেই। ফাইনালে আমার কাছে যা স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, তার এ বিষয়টি পুরাটাই মানসিক। এ বিষয়ে দলের নজর দেয়া প্রয়োজন। কন্ডিশন বিবেচনায় আসন্ন সিরিজ এবং বিশ্বকাপে রুবেল হয়ে উঠতে পারেন তুরুপের তাস, তাই এ বাড়তি নজরের দাবি।
এ সফরটা যার জন্য বিশাল একটি সুযোগ হয়ে আসতে পারে তিনি হচ্ছেন সাইফুদ্দিন। নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই তৈরি করে নিচ্ছেন এ তরুণ। এ আগে যেমনটা বলেছিলাম, তার যে সামর্থ্য রয়েছে সেটিকে তিনি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন বাংলাদেশ একটি ভালো পেস বোলিং অল রাউন্ডার পাবে। বিপিএল এ নিয়মিত স্লগ ওভারে বোলিং করার সুযোগ পাওয়াটাও তার জন্য বেশ ইতিবাচক হয়েছে।
শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, কন্ডিশন পেসারদের অনুকূলে থাকলেও পেসের বিপক্ষে কিউই ব্যাটসম্যানদের সাচ্ছন্দ্যটি। ভারতের বিপক্ষের টি টোয়েন্টি সিরিজেই দেখা গিয়েছে স্পিনে তারা যতটা নড়বড়ে পেসে ততটাই শক্তিশালী। এমন অবস্থায় পেসারদের জন্যও অপেক্ষা করছে কঠিন পরীক্ষা। স্পিনারদের নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়া বোধহয় ঠিক হবে না। দেশের বা উপমহাদেশের কন্ডিশনে মিরাজ যতটা কার্যকর এর বাইরে এখনো ততটাই ভোতা। এবার তিনি কতটা কি করতে পারেন সেটাও দেখার বিষয়। মিরাজ যদি উইকেট না নিয়ে রান আটকানোতেও সফল হতে পারেন সেটিও হবে প্লাস পয়েন্ট। ভারতের স্পিনারদের সাফল্য দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হতে পারেন।
সফর শুরু আগে ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে মূল খেলোয়াড়দের ফর্মে থাকাটা। বিগত কয়েকটা সিরিজ; যেগুলোতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে তা খেয়াল করলে দেখা যায় যে অভিজ্ঞদের সাথে তরুণদের তাল মেলাতে না পারাটা। যে পঞ্চপান্ডবের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের সাফল্য ব্যর্থতা তাদের একজনের না থাকাটা বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও দূর্বল করেছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এখন তরুণদের সময় বাড়তি দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়ার। সেটি হলেই শুধু মাত্র সম্ভব পয়লাবারের মত কিউই সফরে হাসার সুযোগ পাবার।