কে কী খাবে, কে কী পরবে এবং কে কী বলবে- তা বলপূর্বক নির্ধারণ করতে সচেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতের কিছু বিকৃতমস্তিষ্ক সাম্প্রদায়িক মানুষ তথা সংগঠন। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী শক্তি বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরবর্তী সময়কালে সংখ্যালঘু, দলিত সম্প্রদায়ের উপর মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন এবং অত্যাচার উপর্যুপরি বৃদ্ধি পেয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তি কর্তৃক মুসলিম এবং দলিত হিন্দুদের প্রতি তর্জনী উঁচিয়ে হুঙ্কার দেওয়া থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের ঘটনা বর্তমান ভারতে দৈনন্দিন ব্যাপার! সম্প্রতি আরও একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রে। স্বনামধন্য সুরকার এ. আর. রহমানের কন্যা খাতিজা রহমান বোরখা পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ চলচ্চিত্রের অস্কার জয়ের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুম্বইয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান মঞ্চে বাবার সম্বন্ধে অল্প কথায় বক্তব্য রাখেন খাতিজা রহমান। সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের গীতিকার গুলজার এবং অভিনেতা অনিল কপূর উপস্থিত ছিলেন ওই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান মঞ্চে খাতিজা শাড়ি এবং বোরখা পরার জন্য সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও, ছবি দ্রুত ভাইরাল হয়। বহু আঁতেল নেটিজেন প্রশ্ন তোলে- এ. আর. রহমান বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়ান, অথচ মেয়েকে বাধ্য করেছেন রক্ষণশীল জীবনযাপনে। রহমানকে আক্রমণ করে বলা হয় ‘ভণ্ড’ (হিপোক্রিট) এবং ‘দ্বিচারী’ (হ্যাভিং ডাবল স্টান্ডার্ডস)। আরও অনেক কটুকাটব্য দ্বারা রহমানকে অপমান করতে কসুর করেনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বহু নেটিজেন। খাতিজার পক্ষ নিয়েও কিছু মুক্তমনা এবং সেকুলার নেটিজেন সওয়াল করেন। “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান” যে-দেশের চিরন্তন ঐতিহ্য, সেই দেশে পরিধানকে কেন্দ্র করে ভার্চুয়াল জগতে শুরু হয় তুমুল চর্চা।
এ. আর. রহমান মিতভাষী এবং নরম মেজাজের শান্তশিষ্ট মানুষ। বিতর্কিত মন্তব্য থেকে শতহস্ত দূরে থাকেন তিনি। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি অন্যান্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও দূরত্ব রেখে চলেন গণমাধ্যমের সঙ্গে। তবে, মেয়ের পরিধানকে কেন্দ্র করে তুঙ্গ তরজায় তিনি নীরব থাকতে পারেননি। বুধবার নিজস্ব টুইটার হ্যান্ডেলে তিনি স্ত্রী সায়রা বানু, দুই কন্যা খাতিজা-রহিমা এবং ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ অম্বানীর স্ত্রী নীতা অম্বানীর একটি যৌথ ছবি পোস্ট করেন। সেই ছবিতে খাতিজা বোরখা পরে থাকলেও সায়রা বানু এবং রহিমা বোরখা পরেননি। এমনকী, সায়রা বানু ইসলামী রীতি অনুযায়ী মাথায় ওড়না নিলেও রহিমা ছিলেন খালি মাথায়। রহমান এই ছবি দ্বারা বার্তা দিলেন, স্ত্রী-কন্যাদের পরিধানে তিনি কোনও নির্দেশনামা জারি করেননি, ব্যক্তিগত পছন্দে খাতিজা বোরখা পরেন। সবিশেষ তাৎপর্যবাহী ‘ফ্রিডমটুচুজ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তিনি ক্যাপশন লেখেন, “নীতা অম্বানীজির সঙ্গে আমার পরিবারের তিন মূল্যবান রত্ন মহিলা খাতিজা, রহিমা এবং সায়রা। #ফ্রিডমটুচুজ”
The precious ladies of my family Khatija ,Raheema and Sairaa with NitaAmbaniji #freedomtochoose pic.twitter.com/H2DZePYOtA
— A.R.Rahman (@arrahman) February 6, 2019
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি তামিলনাড়ুর চেন্নাই শহরে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রথিতযশ সঙ্গীতশিল্পী, তখন তার নাম ছিল দিলীপ কুমার। যখন তার বয়স ২৩, সপরিবার তিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন, নতুন নামকরণ হয় আল্লারাখা রহমান। দু’টি অস্কার, দু’টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড, একটি গোল্ডেন গ্লোব এবং ছয়টি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। কিছুদিন আগে তার জীবনীমূলক গ্রন্থের (নোটস অফ এ ড্রিম: দ্য অথোরাইজড বায়োগ্রাফি অফ এ. আর. রহমান) মোড়ক উন্মোচনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ইসলাম আমাকে অনেক ভুল থেকে রক্ষা করেছে। কারণ, প্রত্যেক সালাতের পরে আমার মনে আসে যে, আমাকে পরবর্তী সালাতও আদায় করতে হবে। আর এভাবেই আমি ক্ষতিকর আচরণ থেকে বেঁচে থাকি।” তিনি যে ধার্মিক এবং গর্বিত মুসলিম, তা জানাতে দ্বিধান্বিত হন না এ. আর. রহমান। কন্যা বোরখা পরার জন্য তাকে অহেতুক ‘রক্ষণশীল’ বলে দেগে দেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হলেন স্বভাবসিদ্ধ মার্জিত ভাষায়।