ফেসবুকের নীলে হারালো রঙ খেলার সুখ!

ফেসবুকের নীলে হারালো রঙ খেলার সুখ!

সময়ের স্রোতে বদলে যায় সব। প্রতিনিয়ত চলে ভাঙা গড়ার খেলা। যান্ত্রিক এই শহরে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়া দায়। তাই মন হয়ে পরে স্মৃতিকাতর। ফিরে যেতে চায় পুরোনো সেই দিনগুলোতে। যখন এ শহরের মানুষগুলোর মনকে গ্রাস করেনি ইট পাথরের গাঁথুনি। আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত।

এক পা দুপা করে হাটতে হাটতে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন শুধু হাটতেই না দৌড়াতেও শিখে গিয়েছে। নেটের যুগে সংবাদ বড় সহজলভ্য। তাই ম্যাচের খুটিনাটি সবই জানা হয়ে যায় মুহূর্তেই। স্ট্যাটাসে নীল হয় ফেসবুকের ওয়াল। কেন যেন মনে হয়, তাতে ফেলে আসা সময়ের সে আনন্দটা নেই। নেই নিখাঁদ আবেগের রাজ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভিতটা নিঃসন্দেহে গড়ে দিয়েছে ‘৯৭ এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সে সময় ঘরে ঘরে নেট তো দুর টিভিই ছিল না। পাড়া-মহল্লার অবস্থাসম্পন্ন ঘর গুলোই ছিলো মানুষের ভরসা। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারের চলও তখন ছিলো না তেমন। যার ফলে এমন উপলক্ষগুলোতে মানুষের ঢল নামতো সেসব বাড়িতে।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য অবশ্য ভরসা করতে হয়েছিলো রেডিওতে। মাঝে ঢাউস সাইজের রেডিও, তার চারিপাশে গোল হয়ে সবাই। একটি চার মাত্রই গগণ কাপানো উল্লাস, আউট মানেই পিনপিনে নীরবতা। জানি না কেন, সমীকরণটা কঠিন হলেও বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মধ্যপথেই চলছিল রঙের ইন্তেজামের আয়োজন। তাও কি, ঢাউস সাইজের সব ড্রামে। ম্যাচের রঙ বদলাচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণেই, দেখা মিলছিলো আলাদা সব অনুভূতির প্রকাশ ভঙ্গির।

সংখ্যার দিক দিয়ে খালেদ মাসুদের ইংনিসটি হয়ত তেমন কিছু না। কিন্তু ঐদিনের সাক্ষী হবার ভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা জানেন ইনিংসটির মাহাত্ম্য কতটা। মাসুদের একরানের পর সে দৌড় তো বাংলাদেশের ইতিহাসের স্থায়ী এক অংশ। সে খবরটি শোনা মাত্রই যে পরিস্থির সৃষ্টি হয়েছিলো তা বোধহয় আর কখনোই হবে না।

যে যাকে পাচ্ছে পাগলের মত জড়িয়ে ধরছে। উন্মত্ত স্বরে চিৎকার। চোখ বেয়ে নেমে আসা অবাধ্য, আবেগের অশ্রু। এরই মাঝে ভ্যানে করে একদল যুবকের রঙ সমেত পথে নেমে আসা। মুহূর্তটা লিখে বয়ান করা কঠিন। রঙের ফোয়াড়া ছুটছিলো যেন। বয়স্ক থেকে শিশু, কেউ বাদ পরেনি সেদিন। সাধের সাদা শার্ট লালে রঙিন, তবু মুখে বিরক্তির চিহ্ন নেই। প্রাণখোলা হাঁসিতে সবাই মিশে যাচ্ছিলো সে স্রোতে। এখনো মনে আছে, বয়সে যারা ছোট তাদের চুবানো হয়েছিলো রঙের ড্রামের মধ্যেই।

সে দিন বহুদিনের অপরিচিতও মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গিয়েছিলো খুব আপন। ইতিহাস সৃষ্টির সে ক্ষণের সাক্ষী হতে পারার আনন্দ মিটিয়ে দিয়েছিলো দুরত্বের দেয়াল। তখন কেই বা ভেবেছিলো আর তিন বছর পরেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে টেস্ট পরিবারের সদস্য? বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা স্বপ্নের সীমা ছাড়িয়েছিলেন কল্পনার চেয়েও দূরে। তাই ‘৯৯ এ পাকিস্তান বধ হলো, তার পরের বছরই আসলো টেস্ট স্ট্যাটাস।

বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশ বেশ সমীহ জাগানিয়া শক্তিই এখন। বাংলাদেশের ম্যাচ মানেই সরগরম ফেসবুক। কর্মব্যস্ত মানুষদের টিভির শো রুমের সামনে জটলা। কিন্তু সে আনন্দটা কোথায় যেন হারায়ে গেল। এখনো আনন্দ মিছিল হয়, কিন্তু আবেগটার শূন্যতা খুব অনুভব করি।

ইদানিং যে বিষয়টা খুঁব দৃষ্টিকটূ ঠেকে তা হলো ফেসবুক বা বড় কোনো ওয়েবসাইটের কমেন্ট বক্সে বাজে ভাষার বাহাস। প্রতিপক্ষকে ছোট করে দেখানোর এক অদ্ভুত চর্চা। আর খেলা যদি ভারত বা পাকিস্তানের বিপক্ষে হয় তাহলে তো কথাই নাই। যে সব বাক্যের দেখা মেলে তা গা গুলিয়ে দেয়ার মত। প্রতিপক্ষের প্রশংসাও যেন পাপ। সাথে সাথে জুটে যায় দালাল, রাজাকার খেতাব।

আমার কেন যেন মনে হয় আনন্দের সংজ্ঞাটা আমরা ভুলে গিয়েছি। আমরা এখন সুখ খুঁজে পাই বিদ্বেষ ছড়ানোর মধ্যে। ‘৯৭ এর জয়টা আমরা উপভোগ করেছিলাম নির্মল আনন্দে। কাউকে ছোট করার কোনো প্রয়াশ ছিলো না সেদিন। ইদানিং প্রতিপক্ষ তো বটেই অশ্রাব্য বাক্য থেকে রেহাই পাননা নিজ দেশের খেলোয়াড়রাই। আজব সে বসচায় অনেক সময় এসে পরে খেলোয়াড়দের স্ত্রীদের প্রসঙ্গও!

একসাথে বসে খেলা দেখার আনন্দটা এখন পাওয়া যায় না তেমন। আগে যেমন সমবেত সবাই নিজেদের মধ্যেই ঠাট্টা মশকরায় মজে থাকত, এখন সবাই এক হলেও দেখা যায়, সবাই নিজ নিজ মোবাইলেই ব্যস্ত! কেউ স্ট্যাটাস দিতে, কেউবা বাহাসে। সবার সাথে থেকেও যেন বিচ্ছিন্ন একেকটা দ্বীপ।

আজকে সে দিনটির কথা আরো বেশি করে মনে পরছে কারণ, আজকে সে ম্যাচটির অন্যতম নায়ক খালেদ মাসুদের জন্মদিন। বড় খুঁজে ফিরি হারিয়ে ফেলা সে দিনগুলো। স্ট্যাটাসের নীল যেন শুষে নিয়েছে রঙ খেলার সে আনন্দ। তর্কে জেতার মানসিকতায় মারা পড়েছে নির্মল আনন্দ উদযাপনের সুখ।

কখনো কখনো ইচ্ছে হয়, যদি চিৎকার করতে পারতাম! যদি ফিরে পেতাম সে রঙ খেলার আনন্দ! বাংলাদেশের জয়ে চিৎকার করে কাদতে পারতাম আরো একবার। হয় না, হয়ে উঠে না। নগরের যান্ত্রিকতায় যন্ত্র হয়ে গিয়েছি যেন। তাই জয় পরাজয়ের অনুভূতি শেষ হয়ে যায় ফেসবুকের নীলে!