পকেট হাতরে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো দেব। বহুদিনের অনাভ্যাসে প্রথম টানেই কাশির দমকে চোখে পানি চলে এলো। লতা কি ভাবে এ অসাধ্যটি সাধন করেছিলো ভাবতেই অবাক লাগে। চেইন স্মোকার দেব লতার এক কথায় সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলো কিছু না ভেবেই। একটু ধাতস্ত হয়ে বেশ একটা সুখ টান দিয়ে চোখ দুটো বুজলো দেব। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত শত স্মৃতি। লতার সে মুখটি। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখটি ভিজে গিয়েছে টেরই পায়নি ও। আচমকাই টিকেট চেকারের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙল যেন।
– টিকিট প্লিজ
– টিকিট ত সাথে নেই
– সাথে নেই মানে ? উঠেছেন কিভাবে ?
এরকম অজস্র প্রশ্নে দেবকে জেরবার করে ছাড়লেন টিকেট চেকার। দেবের নিজেরও জানা নেই ঠিক কোথায় যাচ্ছে ও।
ঘটনাটি একমাস আগের। উদীয়মান লেখক জাকারিয়া ইমতিয়াজ কি করে দেব হয়ে গেলো কেউই জানে না। পত্রিকায় প্রথম গল্পটি ছাপা হবার সাথে সাথেই চারিদিকে হইচই পরে গেলো। জাকারিয়া ইমতিয়াজ হয়ে গেলো দেব। নামটি কে, কবে, কোথায় দিয়েছিলো কিছুই দেবের মনে নেই। তবে, নামটি বেশ মনে ধরেছিলো। আর এ নামেই লিখেছিলো নিজের প্রথম গল্পটি। লতার সাথে দেবের বহুদিনের সম্পর্ক। এতদিন পর দেব নিজের পায়ে দাড়াচ্ছে, লতার খুশি দেখে কে? কত স্বপ্ন বোনা হয়ে যায় নিজের অজান্তেই। হানিমুনে কোথায় যাবে ঠিক হয়ে যায় সে যায়গাও।
সবই যদি সরল অংকের মত এক অথবা শূন্য হয় তবে খোদার আর কাজ কি ? দেব দিন দিন অসুস্থ হয়ে পরতে শুরু করে। প্রথম দিকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। শেষে লতার চাপাচাপিতে নিতান্ত অনিচ্ছায়ই ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে হাজির হয় দেব। বেশ কিছু টেস্টের ফিরিস্তি ধরিয়ে দিয়ে পরবর্তী তারিখে আবার দেখা করতে বলেন তিনি। এরই মাঝে লতার মা লতার জন্য একটি ছেলে পছন্দ করে ফেলেছে। বেশ সুদর্শন, শিক্ষিত মোট কথা সিকিউরড লাইফ যাকে বলে। দেবের এই অবস্থায় লতা দেবকে এ ঘটনাটি বলতেও পারছিলো না।
পরবর্তী দিন লতার চাপেই ডাক্তারের চেম্বারে রিপোর্ট নিয়ে হাজির হয় দেব। সব দেখে শুনে ডাক্তার যা বললেন তা শুনে দেব বেশ কিছুক্ষন স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তীব্র সে চাহনি ডাক্তার সহ্য করতে পারেনি। চোখ দুটো নামিয়ে নিয়েছিলো। বেশ অনেকক্ষণ পর ঠোঁটে একটি বক্র হাসি ফুটিয়ে ডাক্তারকে দেব বলেছিলো কত টাকা যেনো বললেন ডাক্তার সাহেব? অংকটা শুনে আর বসেনি ও। হাসি ঠোঁটে নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলো চেম্বার থেকে। ওর যা কিছু জমানো আছে তা ত বটেই স্থাবর অস্থাবর সব বিক্রি করলেও চিকিৎসার টাকা উঠবে না। হায়রে ভাগ্য, যখন সব নতুন করে শুরু করার কথা ভাবছিলো তখনি সব শেষের ঘন্টাটা বেজে গেলো ?
– স্যার, চা নিবেন ?
– দে এক কাপ। তোর নাম কি রে ?
– লোকমান
– তুই কি প্রতিদিনই এই ট্রেনে চা বিক্রি করিস ?
– হ, স্যার
– কামাই কেমন হয় ?
– খারাপ না
এসব টুকটাক কথা বলে চা হাতেই ট্রেনের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ায় দেব। পকেট থেকে বের করে আরো একটি সিগারেট ধরিয়ে নেয়। চোখের সামনে মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মাঠ, বিস্তীর্ণ জমি, নদী। এমন সময় ত লতা পাশে থাকার কথা ছিলো।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েই দেখে আকাশ মুখ ভার করে রয়েছে। মেঘ যেনো সর্ব শক্তি দখল করতে চাচ্ছে পুরো আকাশ। মুহুর্তেই ঝড় নামল। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দ্বিগবেদিক ছুটছে। অথচ দেব যেন স্থানু হয়ে গিয়েছে। নড়বার শক্তিটুকুও নেই। ওই দিকে মোবাইলে ক্রমাগত রিং বেজে চলেছে। লতা। কি বলবে দেব? কি বলার আছে?
নানা অজুহাতে লতাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে দেব। প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া লেগেই থাকত। শেষ পর্যন্ত জেদী লতা আর সহ্য করতে পারেনি। মায়ের পছন্দেই রাজী হয়ে গিয়েছিলো বিয়েতে। একটা বারের জন্যও দেব ওকে কিছু জানতে দেয় নি। শেষবার লতা যখন ফোনটা রেখে দিলে অঝোরে কেদেছিলো দেব। এমনটা ত হবার কথা ছিলো না।
ট্রেনটা থেমে গিয়েছে। সাতপাচ না ভেবে নেমে পরে দেব। অচেনা জায়গা। নামটা পর্যন্ত জানা নেই। শেষে একটা মসজিদ খুঁজে বার করে তার বারান্দায়ই শুয়ে পরে। না খাওয়া ক্লান্ত দেহ, শোয়া মাত্রই ঘুম চলে আসে দেবের। ভোর বেলা ঘুম ভাঙ্গে এক বৃদ্ধের ডাকে। মসজিদের ইমাম তিনি। কুশল আশয় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। কেনো জানি দেবকে ভালো লেগে যায় ইমাম সাহেবের। তার কোনো সন্তান নেই। স্ত্রীও গত হয়েছে গেলো বছর। তাই দেবকে তার ওখানেই নিয়ে চলেন। আমৃত্যু ওখানেই ছিলো দেব।
ভাগ্যের কি পরিহাস। যার জন্য পালিয়ে শহর ছেড়ে চলে এসেছে দেব সে গ্রামটি ছিলো সে লতার শ্বশুর বাড়ি। বিয়ের মাস খানেক পর লতা গায়ে আসে কোনো এক উৎসবে। ততদিনে দেবের শরীর আরো ভেঙ্গে পরেছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ই দেবকে দেখেছিলো লতা। দাড়ি গোফ আর চুলের জঙ্গলে পুরো চেহারা ঢাকা পরে গেলেও লতার চিনতে সামান্য কষ্টও হয়নি। যেমনি দেব ভালোবাসত দূর থেকে কিশোরের দস্যিপানা দেখতে ঠিক ওভাবেই দেখছিলো। ঘৃণায় চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিলো লতার।
ওদিকে দেবের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। তিনদিন ধরে দানা পানি কিছুই মুখে দেয়নি। বেশ চিন্তায় পরে যান ইমাম সাহেব। হাতের ইশারায় একটা কলম আর কাগজ চায় দেব। একটা নাম্বার লেখা, সাথে একটা মেয়ের নাম। দেব লিখেছে তার মৃত্যুর পর যেনো এই নাম্বারে ইমাম সাহেব একটা ফোন দেয়। বয়স্ক মানুষ। এমনিতেই দেবের এই অবস্থা সহ্য করতে পারছিলেন না, তার উপর এ চিঠিটি তার চোখ দিয়ে অঝোরে বর্ষণ নামালো যেন।
ইমাম সাহেব সহ্য করতে পারেননি। দেবের মৄত্যুর আগেই ফোন দিয়েছিলো লতাকে। চৌধুরী বাড়িতে এক নতুন বৌ এসেছে তিনি জানেন, দেখেছেনও দু একবার। কিন্তু, ইনিই যে লতা তা ইমাম সাহেবের দূরতম কল্পনাতেও ছিলো না। লতা ফোন পেয়েই চিনেছিলো। বেশ কিছুক্ষন দ্বিধায় ছিলো কি করবে। একদিকে তীব্র ঘৃণা অপর দিকে ভালোবাসা। শেষে ঠিক করলো যাবে দেবকে দেখতে। কিছু জবাব জানা দরকার। সবার চোখ ফাকি দিয়ে পৌছে গেলো ইমাম সাহেবের বাড়ি। দরজা খুলেই ইমাম সাহেব অবাক। আর যাই হোক চৌধুরী বাড়িক বৌকে তিনি তার বাসায় আশা করেননি।
– দেব কোথায়?
– দেব?
– মানে, ইমতিয়াজ। কোথায় সে?
নিতান্তই বাধ্যের মত কামরাটা দেখিয়ে দেয় ইমাম সাহেব। কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যে পরিমাণ রাগ আর ক্রোধ নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলো লতা দেবকে দেখা মাত্রই অর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। এ কি হাল হয়েছে দেবের? এ কদিনেই চেহারা ভেঙ্গে বিধ্বস্ত হাল। লতাকে দেখে দেবও চমকে গিয়েছে। বুঝল এটা ইমাম সাবেহের কাজ। একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে লতা। সর্বশক্তি দিয়েও তার জবাব দিতে পারছে না দেব। শেষে ইশারায় ব্যাগটি দেখিয়ে দেয়। ব্যাগ খুলেই দেবের রিপোর্টগুলো পেয়ে যায় লতা। এক এক করে স্পষ্ট হতে থাকে সব প্রশ্নের উত্তর। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। মুগ্ধের মত চেয়ে থাকে দেব।
– আমি কি এতই খারাপ ? একটা বার বলতেও পারলে না ? আমি কি চলে যেতাম তোমাকে রেখে?
দেব কোনো জবাব দেয় না। হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে ঠোটে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না লতা। অভ্যাস মত বুকে জড়িয়ে ধরে দেবকে। কতদিন পর, কতদিন পর সে ঘ্রাণ পেলো দেব। চোখ দুটে বন্ধ হয়ে আসছে। হায়রে খোদার লীলা, যার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য এতকিছু সে লতার বুকেই শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করলো দেব।
গায়ের মসজিদের পাশেই দেবের কবর হয়েছে। ওখানে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগিয়েছে লতা। রোজ ওতে পানি দেয় ও। দেব সব সময় বলতো, কথা দাও আমার কবরের পাশে একটি কৄষ্ণচূড়া গাছ লাগাবে। অনিচ্ছায়ই কথা দিয়েছিলো লতা। কে জানত সত্যিই দেব এভাবে চলে যাবে আর নিতান্তই কথাচ্ছলে দেয়া কথাটা বুকে পাথর বেধে রক্ষা করতে হবে লতাকে।
একমনে পানি দিচ্ছে লতা, আর অকটি শব্দই বের হচ্ছে মুখ থেকে, —‘নিষ্ঠুর!’