মুশফিকুর রহিমকে ডাকা হয় ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’। এ তো আর এমনি এমনিই নয়। বাংলাদেশ দলের দারুণ এক নির্ভরতার নাম মুশফিক। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি- যে কোনো ফরম্যাটেই দলে বেশ নির্ভরযোগ্য এই তারকা। খুব কঠিন মুহূর্তেও দলকে টেনে তুলেছেন খাঁদ থেকে। প্রথম সারির ব্যাটসম্যানরা যখন একের পর এক উইকেট বিসর্জন দিয়ে এসেছেন, তখন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মুশফিক দলের হাল ধরেছেন। দলকে পৌঁছে দিয়েছেন সম্মানজনক স্কোরের দিকে। এমন হয়েছে বহু ম্যাচে।
টাইগারদের ব্যাটিং জিনিয়াস যদি ধরা হয় তবে প্রথমেই আসে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসানের নাম। যদিও স্ট্রোক মেকার হিসেবে নেই মুশফিকের নাম, তবে দলের অন্যতম সফল ও ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান এই ৩১ বছর বয়সী উইকেটকিপারই। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮- এই চার বছর টি-টোয়েন্টিতে রান পেতে হাঁসফাঁস করেছেন মুশফিক। অন্য ফরম্যাটে ঠিক-ঠাক চললেও টি-টোয়েন্টিতে ঠিক যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ওই সময় খেলে ফেলেছিলেন ২৬ ইনিংস। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ২৬ ইনিংসের মাত্র একটাতে যেতে পেরেছিলেন ফিফটির কাছাকাছি। এই ফরম্যাটে আগের ৬১ ম্যাচে তাই তার গড় নেমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১৬.৮৪!
টি-টোয়েন্টিতে মুশফিকের দুঃসময়ে তখন বাংলাদেশ দলের দায়িত্বে ছিলেন শ্রীলঙ্কান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। মুশফিকের এমন হতাশাজনক পারফর্ম্যান্সে বেশ বিরক্তিই ছিলেন বর্তমান শ্রীলঙ্কার এই কোচ। বাজে পারফর্ম্যান্সের কারণে এমনকি তখন গুঞ্জন উঠেছিল সাবেক কোচ হাথুরুসিংহে টি-টোয়েন্টি থেকে তাকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন। দল থেকে হুট করেই ইস্তফা নিলেন হাতুরেসিংহে। তার বিদায়ে মুশফিক শেষ পর্যন্ত টিকেছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, ঘটনাচক্রে মুশফিকের প্রথম ঘুরে দাঁড়ানো ওই হাথুরুসিংহের দলের বিপক্ষেই। সর্বশেষ তিন ফিফটির দুইটাই হাথুরুসিংহের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
টি-টোয়েন্টিতে বড় শট খেলতে হয়। কিছুটা বাড়তি ঝুঁকিও নিতে হয়। ডানহাতি ব্যাটসম্যানরা ডানহাতের শক্তি কাজে লাগান বড় শট খেলতে। কিন্তু এর বাইরে শটের নিয়ন্ত্রণ রাখা, ফাঁকা জায়গা বের করে কম শক্তি ব্যবহার করেও রান বের করার সমন্বয় শিখেছেন মুশফিক। সেগুলো কাজে লাগিয়ে রান তোলার চেষ্টায় মনোযোগী এই উইকেটকিপার কাম ব্যাটসম্যান।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) প্রথম দুই আসরে ফ্রাঞ্জাইজি দলটির নাম ছিল চিটাগং কিংস। তৃতীয় আসরে কেবলমাত্র নাম পাল্টে চিটাগং ভাইকিংস হয়েছে কিন্তু সাফল্য আসেনি। এবারের আসরে দলটির নেতৃত্ব আসে মুশফিকের হাতে। তবে এই আসর থেকেও বিদায় নিতে হয়েছে মুশফিকের নেতৃত্বাধীন দলটির। তবে ভাইকিংসদের এবারের দলটা নিয়ে টুর্নামেন্টের শুরুতে খুব বড় কিছুর প্রত্যাশা ছিল না কারোই। কিন্তু প্রথম পর্বে তারা একেবারে চমকে দেয় সবাইকে। দারুণ কম্বিনেশন ও টিম স্পিরিটে টানা ম্যাচ জিতে সবার ওপরে থেকে ঢাকা পর্ব শেষ করলেও চট্টগ্রামে গিয়ে খেই হারায় দলটি। শেষ পর্যন্ত একটি ম্যাচ জিততে পারায় এলিমিনেটর পর্ব নিশ্চিত হয় তাদের। ব্যর্থতার মিছিলে মুশফিক নিজেও ছিলেন। কম রানের দলীয় স্কোরে আউট হয়েছেন মাত্র ৮ রান করে। কিন্তু ১৩ ম্যাচে ৪২৬ রান করে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান তারই।
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে শেষ কয়েকটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রানের খাতা তেমন সমৃদ্ধ করতে পারেনি বাংলাদেশের এই উইকেটকিপার। কিন্তু বিপিএলের এই আসরে দলের সাফল্যের সিংহভাগ দাবিদার জাতীয় দলের তারকা মুশফিকের। ভাইকিংসের শেষ ১০ ম্যাচের বেশিরভাগ ম্যাচেই ব্যাট হাতে দারুণ সফল ছিলেন মুশফিক। সেই সাথে উইকেটের পেছনে ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। তিনটি অর্ধ শতকের দেখা পেয়েছেন। বাকি ম্যাচগুলোতেও দলের প্রয়োজনে রেখেছেন কার্যকরী ভূমিকা। দলের এতদূর আসার পেছনে তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় অনেকটাই অবদান মুশির।
নিখুঁত টেকনিক আর ব্যাকরণ সম্মত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশে সবার আগেই আসে মুশফিকের নাম। সেকারণে টেস্টে দলের মূল ব্যাটসম্যানও ধরা হয় তাকে। শুধু টেস্ট নয়, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান তিনি। দলের ব্যাটিং জিনিয়াসরা এক ম্যাচে ভালো খেলে পরের ম্যাচে খেই হারিয়ে ফেললেও বেশ ছন্দেই হাঁটছেন মুশফিক। তবে টি-টোয়েন্টিতে আত্মবিশ্বাসে একটু ঘাটতি দেখা দিলেও এবারের বিপিএলের আসরে সেটা পুষিয়েও দিয়েছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। মার কাটারি ক্রিকেট টি-টোয়েন্টিতে বেশ পরিপক্ক হয়ে উঠেছেন তিনি। ব্যাট হাতে সামনে জাতীয় দলের জার্সিতে বিপিএলের এই ধারাবাহিকতারই প্রতিফলন ঘটাবেন, তেমনটাই প্রত্যাশা।