বিনা অপরাধে জেল খাটা পাটকলকর্মী জাহালমের বিষয়ে ‘দুদক’র গাফিলতির তদন্তভার দেয়া হয়েছে দুদক’রই উপর। আজ সোমবার দুপুরে দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের একথা জানিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, জাহালমের কারাভোগ ও হয়রানির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকলে দুদক থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মূলত যে দুদকের গাফিলতির জন্য জাহালমের জীবন থেকে চলে গেল ৩টি বছর, সেই দুদক’র উপরই আবার তদন্ত ভার দেয়াটা প্রহসনের শামিল।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রায় সাড়ে ১৮কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ঠাকুরগাঁওয়ের আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা দায়ের করে দুদক। এর মধ্যে ২৬টিতে টাঙ্গাইলের জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দায়ের করে দুদক। পরে ওই মামলায় ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ওই একই বছরের ২৭ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে এ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। তখন থেকেই কারাগারে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছিল জাহালম। আদালতে বারবার সে ‘আবু সালেক নন’ বলার পরও তা আমলে নেয়া হয়নি। কারাগারে ভালো খাবারের জন্য পরিস্কার করতে হয়েছে অন্যের কাপড়-চোপড়।
গত ৩০ জানুয়ারি জাতীয় একটি দৈনিকে ‘স্যারি, আমি জাহালম, সালেক না’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে জাহালমের সত্যিকার পরিচয় উঠে আসে; যার ভিত্তিতে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।
অবশেষে গতকাল রবিবার দিনগত রাত ১টার দিকে গাজীপুরের কাশিমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে মুক্তিপান জাহালম। অর্থজালিয়াতির ২৬টি মামলা থেকে জাহালমকে একদিনের মধ্যেই অব্যাহতি দিয়ে সকালে মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে কেটে গেছে জাহালমের ৩ বছরের ট্রাজেডিক জীবন।
কারাগার থেকে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জাহালম বলেন, “আমাকে বিনা বিচারে আটকে রেখেছে। আমি দুদকের বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই।”
জাহালাম মানসিক কিংবা হারানো সময় কখনোই ফিরে পাবেন না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি কোন আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবেন কিনা? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ ধরনের ক্ষতিপূরণের বিষয়ৈ নির্দিষ্ট কোন আইন নেই, তবে জাহালম ‘ফান্ডামেন্টাল রাইটসের (মৌলিক অধিকার) গ্রাউন্ডে মামলা করতে পারবেন। যেটা ড্যামেজ শ্যুটের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও তিনি দেওয়ানি আদালতেও যেতে পারেন।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে ভুল আসামি হিসেবে বিনা অপরাধে ১৭ বছর বন্দি ছিলেন রিচার্ডস অ্যান্থনি জোনস। নিরাপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর তিনি আর্থিক ক্ষতিপূরণও পেয়েছিলেন। দেখার বিষয়, জাহালমকে রাষ্ট্র কতটুকু সহযোগিতা করে।
জাহালম মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষত। পুলিশ, দুদক এবং এনআইডি কর্তৃপক্ষ সকলেই একই ভুল করেছে। আদৌ কি তাই। এটি কি সাধারণ ভুল নাকি এর পিছনেও রয়েছে সিন্ডিকেট। দুদক চেয়ারম্যান সেই সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করলেও তদন্তভার নিয়েছেন নিজেরাই। যারা অভিযুক্ত তারাই করবে তদন্ত! পুনরায় সুষ্ঠু তদন্তের আশা ছেড়ে দিতেই হয়। দুদক’র উচিত ‘জাহালম প্রহসন’র তদন্ত তৃতীয় কোন পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা।
জাহালম একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম বহুভাবেই বিনা অপরাধে কারাভোগ করছে অনেকেই। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে বর্তমান সরকারের আমলে রাজনৈতিক মামলাগুলোও একইরকম। গায়েবি মামলায় ধরে আনা হচ্ছে অনেক নিরাপরাধ ব্যক্তিকেই। যাদের পরিণতি আসলে জাহালম’র মতোই।