চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত সবার কাছে আর সেই সাথে বাংলা গানের স্রোতাদের কাছে ‘গানপাগল’ পপ, আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের রাজা -মহারাজাদের খনি এই চট্টগ্রাম। কারণ এখান থেকেই স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের আধুনিক, পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের রাজা-মহারাজারা উঠে এসেছেন এই চট্টগ্রাম থেকেই। তারা আজ সকলেই এক একজন জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন আমাদের সঙ্গীত অঙ্গনে। দিয়েছেন অনেক, মন জয় করেছেন কোটি কোটি স্রোতার। তারা সকলেই এক একজন সঙ্গীতের আইডল হিসেবে গানপাগল তরুণ প্রজন্মের অন্তরে বাস করছেন। তারা হলেন তপন চৌধুরী, নকীব খান, পীলু খান, নাসিম আলী খান, আইয়ুব বাচ্চু ও পার্থ। এবার নিশ্চয়ই আপনারাও আমার সাথে একমত হবেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গীতকে এরা সবাই আজ এতদূর নিয়ে এসেছেন এবং বাংলা গানকে করেছেন অনেক অনেক সমৃদ্ধ। আজ আমার স্মৃতি থেকে তাদের কিছু কথা বলবো যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
সোলস— স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর ১৯৭২’এ চট্টগ্রামের কিছু গানপাগল তরুণ সাজিদ উল আলম (গিটার), লুলু (গিটার) নেওয়াজ (পারকিউশন), রনি বড়ুয়া (ড্রামস) ও তাজুল (ভোকাল) মিলে বিদেশি গানের দলের অনুকরণে গানের একটি দল গঠন করে যার নাম দেয় ‘সোলস’ অর্থাৎ বাংলার যার অর্থ দাঁড়ায় ‘আত্মারা’। সেই ৭২ থেকে চট্টগ্রামে শুরু করে সময়ের বিবর্তনে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ২০১২ সালে উজ্জ্বল মহিমায় দীর্ঘ চার দশক নিজেদের ধরে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে অবদান রেখে চলেছে জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘সোলস’।
যেভাবে শুরু
১৯৭২ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলু ব্যান্ড ত্যাগ করার পূর্বে নকীব খান নামক এক তরুণ দলে যোগ দেয় যিনি পরবর্তীতে আমাদের প্রিয় ‘রেনেসাঁ’ ব্যান্ড’র প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকাল এবং বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন। নকীবের পথ অনুসরণ করে এরপর ব্যান্ডে যোগ দিলেন নকীবের বড় ভাই পীলু খান ও তপন চৌধুরী । শুরু হলো সব গানপাগল তরুণের একসাথে স্বপ্নবোনা আর গানবোনা । তখনও সোলস শুধু চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে ব্যান্ডে যোগ দেয় আরেক তরুণ নাসিম আলী খান এবং ১৯৭৮ সালে যোগ দেন বাংলা ব্যান্ডের আরেক ‘ক্ষ্যাপা’ তরুণ আজকের কোটি কোটি স্রোতা ভক্তদের ‘বাচ্চু ভাই’ অর্থাৎ আইয়ুব বাচ্চু। শুরু হলো বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা যেখান থেকে বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের আকাশে সমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছে একটি একটি নক্ষত্র। সেদিন তরুণ আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যান্ডের একজন গিটারিস্ট, ভোকাল, গীতিকার ও সুরকার। এবার উপরের সবগুলো নামগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে লিখুন – নকীব খান, পীলু খান, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান, আইয়ুব বাচ্চু, রনি বড়ুয়া, নেওয়াজ ও সাজেদ। প্রথম ৬ জনের নাম দেখলেই তো বুঝা যায় যে কতটা দুর্দান্ত ছিল তখনকার ‘সোলস’ । এমন সেরা লাইনআপ বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসে দ্বিতীয় আর কারো হয়নি। ১৯৮০ সালে বের হয় ‘সোলস’র প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’; যা ছিল বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের প্রথম কোন ব্যান্ডের অ্যালবাম। যেখানে পেয়েছিলাম বাংলা ব্যান্ডের কালজয়ী চিরসবুজ ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানটি আরও পেয়েছিলাম ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’, ‘ও পাগল মনরে’, ‘দরগায় মোম জ্বেলে কি হবে’, ‘প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত’, ‘চলো না হারিয়ে যাই’, ‘এই মুখরিত জীবন’র মতো গানগুলি। প্রথম অ্যালবামের সাফল্যর পর ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় ২য় অ্যালবাম, ‘কলেজের করিডোরে’। যেখানে পাই ‘কলেজের করিডোরে’, ‘ফরেস্ট হিল’, ‘ফুটবল ফুটবল’, ‘খুঁজিস যাহারে’ গানগুলি। এই অ্যালবামের পর নকীব খান ও পীলু খান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান এবং পরবর্তীতে রেনেসাঁ ব্যান্ড গঠন করেন। নকীব-পিলুর পথ অনুসরণ করে একক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য কুমার বিশ্বজিৎও ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান। তিনজন সেরা সদস্য হারিয়েও ‘সোলস’ থেমে থাকেনি। তখন সোলস ব্যস্ত হয়ে পড়ে লাইভ কনসার্টে। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ৩য় অ্যালবাম ‘মানুষ মাটির কাছাকাছি’; যেখানে পাই ‘এইতো এখানে বৃষ্টি ভেজা’, ‘এক ঝাঁক পাখী’ ও ‘মুঠোর ভেতর পদ্ম’ গানগুলি। তখন ব্যান্ডের ভোকাল তপনের পরেই ছিলেন নাসিম আলী ও আইয়ুব বাচ্চু। তিনজনেই সমান্তরালে গান গাইতেন। ইতিমধ্যে ‘সোলস’র পথ ধরে ‘চাইম’, ‘অবসকিউর’, ‘মাইলস’, ‘ঝিঙ্গা’সহ আরও কয়েকটি ব্যান্ড তাদের পথচলা শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে বাংলা গানে ‘ব্যান্ড সঙ্গীত’ নামের একটি ধারার শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করা শুরু করলো। সেই সময় আমি মাত্র শৈশব পার করে সদ্য কিশোর বেলায় পা দিয়েছি। সেই সময়ে ‘সোলস’ বাংলাদেশ টেলিভিশনের যে কোন অনুষ্ঠানে শুধু গিটার, ড্রাম, কিবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে কোন তরুণদের গান গাইতে দেখলেই দুটো চোখসহ পুরো মস্তিষ্কের মনযোগ থাকতো সামনে থাকা বাক্সের দিকে অর্থাৎ টেলিভিশনের দিকে। কি গাইছে সেইটা তখন আমাদের মূল বিষয় ছিল না, এতোগুলো ছেলে একসাথে হাসিমাখা মুখে যার যার বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে আর একজন হেলেদুলে গান গাইছে এই দৃশ্যটাই ছিল অনেক মধুর, অনেক আনন্দের। যেন সবগুলো তরুণ তারুণ্যর উচ্ছ্বাসের এক একটা প্রতীক।
উত্থান পতনের মাঝে পথচলা
যাই হোক, আমার স্মৃতি অনুভুতির কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ! আবার সোলস’র কথা ফিরে আসি। ‘মানুষ মাটির কাছাকাছি’র পর ১৯৮৮ সালে ‘সোলস’ বের করে ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’ শিরোনামের ৪র্থ অ্যালবাম, যেখানে ছিল ৬টি বাংলা ও ৬টি ইংরেজি গান। যা ছিল বাংলাদেশের অডিও জগতে একই অ্যালবাম এ দুই ভাষার সমান সংখ্যক গানের প্রথম অ্যালবাম। সেই সাথে ‘সোলস’ বাংলা গানের পাশাপাশি ইংরেজি গানও পরিবেশনা শুরু করে। উল্লেখ্য যে বাংলা গানের মত সবগুলি ইংরেজি গান লিখা ও সুর করা ছিল ‘সোলস’র। এই অ্যালবামের পরেই ১৯৯০ সালের শেষ দিকে আইয়ুব বাচ্চু ‘সোলস’ ত্যাগ করেন। আইয়ুব বাচ্চুর শূন্যস্থান পূরণ করতে তখন চট্টগ্রামের আরেক সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া গিটারিস্ট ও ভোকাল হিসেবে দলে যোগ দেয় পার্থ বড়ুয়া। শুরু হয় নতুন অ্যালবামের কাজ। ১৯৯২ সালে সোলস’র ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সারগাম থেকে প্রকাশিত হয় ‘এ এমন পরিচয়’ অ্যালবামটি। এই অ্যালবামটি ছিল সোলস’র সাথে তপন চৌধুরীর শেষ অ্যালবাম। এই অ্যালবাম পরেই তপন চৌধুরী পুরোপুরি একক অ্যালবামের দিকে নিজের পথ চলা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে সোলস’এ থাকাকালীন সময়েই ৮৫/৮৬ সালের দিকে তপন চৌধুরী তার প্রথম একক অ্যালবাম বের করেন। সেই অ্যালবামের ‘মনে কর তুমি আমি’, ‘অনাবিল আশ্বাসে’, ‘হারানো দিনকে যদি ’ গানগুলো আজো শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এছাড়াও ৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চু ‘রক্ত গোলাপ’ ও ‘ময়না’ নামে দু’টি একক অ্যালবাম বের করে শ্রোতাদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলেন এবং ৮৭ সালে নাসিম আলী খান সেলফ টাইটেলড একক অ্যালবাম বের করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ‘এ এমন পরিচয়’ অ্যালবামটি ‘সোলস’র জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই অ্যালবাম এর অধিকাংশ গান যেমন- এ এমন পরিচয় (তপন), কেউ নেই করিডোরে (তপন), এই তো সেদিন (পার্থ), কেন এমন হলো (নাসিম আলী), সাগরের ঐ প্রান্তরে (নাসিম আলী), এক চোখে শুধু স্বপ্ন (নাসিম আলী), ভালোবাসি ঐ সবুজ (নাসিম আলী) গানগুলো ছিল সবার মুখে মুখে যা আজো সেইদিনের শ্রোতাদের সোনালি স্মৃতি হয়ে আছে।
একে একে সব ভোকাল চলে গেলে দলের সবচেয়ে পুরনো সদস্য রনি বড়ুয়া ব্যান্ড লিডার ও নাসিম আলী খানকে মূল ভোকাল করে পার্থকে নিয়ে সোলস আবার নতুন রূপে শুরু করে। যার ফলাফল ‘আজ দিন কাটুক গানে’ নামক একটি অসাধারণ মেলোডিয়াস অ্যালবাম। সেই অ্যালবাম এর প্রথম গান ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’ গানের ব্যাপক সাফল্য দিয়ে পার্থ শ্রোতাদের নজরে আসেন। এই অ্যালবামটিও সোলস’র চরম একটি সফল অ্যালবাম যার রেকর্ড এর পরের সোলস’র কোন অ্যালবাম আজও ভাঙতে পারেনি। এরপর একে একে বের হয়— অসময়ের গান (১৯৯৫), আনপ্লাগড ‘মুখরিত জীবন’ (২০০০), তারার উঠোনে (২০০২), টু-লেট (২০০৫) (সাউনড ইঞ্জিনিয়ার মবিন এর মৃত্যুর পূর্বের শেষ কাজ), ঝুট ঝামেলা (২০০৮) এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে ‘জ্যাম’।
‘সোলস’ ইতিমধ্যে বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যান্ডগুলোর একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। এই ব্যান্ড থেকেই বাংলা সঙ্গীতের অনেক জনপ্রিয় কণ্ঠ ও কিংবদন্তির জন্ম। যা বাংলা গানকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে ‘সোলস’র অবদান কোনদিন ভুলবার নয়। আজকের প্রজন্মের ব্যান্ডগুলোর কাছে ‘সোলস’ হতে পারে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যারা বারবার প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে সদর্পে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে চিরস্থায়ী একটি সম্মানের আসন দখল করে আছে। শুধুমাত্র গান ও স্রোতাদের প্রতি ভালোবাসার একটি দায়বদ্ধতা থেকে গত চার দশক আমাদের অনেক সমধুর গান উপহার দিয়ে গেছে।