এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলে গত কয়েক বছর আমি বাংলা ভাষার শত্রু বলে বিবেচিত হয়ে আসছি। এই ভাষার একজন সামান্য কবি হিসেবে এটা নিয়ে আমার বক্তব্য পরিস্কার করে বলেছি। কিন্তু তথাকথিত পণ্ডিতদের দিল পরিস্কার না থাকাতে কোন কথা কানে গেছে বলে তো মনে হয় না। যাক ভণিতা বাদ দিয়া সহজ করে আজকের বিষয়টা বলবার চেষ্টা করি।
আমার ধারণা বিষয়টা আমার মতো আরও অনেকেরই চোখে পড়েছে। বাংলাদেশের বইমেলার একটা ‘চেতনাগত’ সমস্যা আছে। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়েন। আগেই ভুল বুইঝেন না। পরিস্কার করে কইতে দেন। আমি রেফারেন্স ছাড়া আগাম কোন কমেন্টারি করি না।
বইমেলা নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ‘বই ও বইমেলা’ নামে একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন গতবছর বই মেলার মৌসুমে প্রথম আলোতে। সেখান থেকে একটা অংশ আগে পড়ে নেই, “বাংলা একাডেমির বইমেলাটি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের মানুষের গভীর আবেগ, ভালোবাসা ও গ্রন্থপ্রীতিযুক্ত হয়ে মেলাটি ধীরে ধীরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ আর রুচি নির্মাণের এক অনন্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আমাদের এই বইমেলাটি অন্য কোনো বইমেলার মতো নয়, একেবারেই বাঙালির ভাষাপ্রীতি, ভাষার জন্য সংগ্রাম ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠার স্মারক হিসেবে চিহ্নিত।”
এই একই লেখাতে তিনি অন্য দেশের মেলার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু পরে চেতনার বৈধতার জন্য একুশের বইমেলাকে গায়ের জোরে ‘বিশিষ্ট’ বলে প্রচার করলেন। উনার লেখা পড়লে এটা পাঠক বুঝবেন। আমার সেটা নিয়ে কথা নাই। আমার কথা অন্য বিষয় ধরে আগাবে।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে আপনারা যতই উৎসব-উত্তেজনা, সাংষ্কৃতিক জাগরণ এইসব দেখেন না কেন; আমার কাছে- সাংষ্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে। তথাকথিত হাজার বছরের সাংষ্কৃতিক অহং প্রকাশের জন্য মাসব্যাপী বইমেলার যে আয়োজন তা সমাজের ‘ভিন্ন’ চিন্তা ও রুচির মানুষকে একীভূত করতে পারেনি, বরং বিচ্ছিন্নতাকে উস্কে দিতে সাহায্য করছে। খান যেমন বললেন, এটা হলো সাংস্কৃতিক জাগরণের আর রুচি নির্মাণের কসরত। মেলা তো বেচাকেনার জায়গা, রুচির পরীক্ষা কেন এখানে? এখন কথা হইল, সবার রুচি তো ভাই বাঙালিপনা দিয়ে মাপলে হবে না? আরও নানান রুচির মানুষ তো দেশে আছে। সেটা কেন হিসেবে থাকে না কেন? এমনকি এনজিও-বাজ বুদ্ধিজীবিরাও এটা নিয়ে কথা বলেন না। বিদেশি ফান্ড-খোর লোকজন সব সময় ভিন্ন সংষ্কৃতির কথা বললেও বই মেলার একটা একাট্টা ফ্যাসিবাদি চরিত্র তৈরি হলো। এখানে যে ভিন্ন সংষ্কৃতি, বিশ্বাস ও আদর্শকে শত্রু বা গণনায়ই ধরা হয় না, এই বিষয়ে কোনো দিন কথা বলতে শুনলাম না। বরং এই একাট্টা বাঙালি সংষ্কৃতি নামের পশ্চাৎপদ জিনিসটাকে বাংলাভাষার দোহাই দিয়ে, বায়ান্নর দোহাই দিয়ে আরও দানবীয় করে তুলতে ভূমিকা পালন করছেন। এর বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে প্রতিরোধ তৈরির বদলে ভিন্ন চিন্তা ও আদর্শের লোকজনের মধ্যে হীনমন্যতা বা ভয়ে কুকড়ে যাওয়ার দশা তৈরি হয়েছে। ফলে এরাও বাঙালি সংষ্কৃতির প্রেমিক সেজে বইমেলায় শামিল হয়ে ইজ্জত রক্ষা করতে প্রতিযোগিতা করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বইমেলাকে এরা বাঙালি সংষ্কৃতির দায়ভার দিয়েই বা কি করতে চান? আমি বলতে চাই, একটা মেলা করে সংষ্কৃতি রক্ষা করতে হইলে, সেই সংষ্কৃতি ধ্বংস হইয়া যাওয়াই ভাল। এতো কমজোর সংষ্কৃতি দিয়া এই গুগল দুনিয়ার প্রতিযোগিতার দিনে সুবিধা হবে না।
বাংলাদেশের বইয়ের বাজার আজও ফকিন্নি দশা থেকে বের হতে পারল না। যারা দুনিয়ার বইপুস্তকের বাজারের খবর রাখেন তারা আমার মতের সাথে দ্বিমত করবেন না আশা করি। বাংলা বই প্রকাশ এখনও ১৯ শতকের রেনেসার খাসিলত কাটাইয়া বাণিজ্য বা করপোরেট বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারছে না। এর জন্য অনেক কারণের সব চেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, চেতনার উত্তেজনায় আমরা বেদিক হয়ে যাই। আমরা ভুলে যাই এটা ২০১৯, ৫২ না
অন্যদিকে, বইমেলাকে বই প্রকাশ ও ব্যবসার দিক থেকে না দেখে চেতনার দিক থেকে দেখার আরেকটা সমস্যা হইল, যারা এই চেতনার বাইরে অবস্থান করতে চান তাঁদের জন্য কোন স্পেস থাকে না। এটাও আমার আসল কথা না। আসল কথা হইল, বইমেলার এই ‘চেতনাগত’ উম্মাদনা আমাদের অশিক্ষিত মানসিকতার ভেতর একটা ফাঁকা অহং এর জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। দেখবেন, প্রকাশকরা বই ব্যবসার চেয়ে নিজেদেরকে সাংষ্কৃতিক নারী/পুরুষ ভাবতে বেশি পছন্দ করেন। তাদের হাবভাব দেখলে মনে হয় জাতিকে উদ্ধারের দায়িত্ব নিয়ে নিছে এরা। তথাকথিত মুক্তচিন্তার নামে বিকারগ্রস্ত সাংস্কৃতিক (সবাই না অনেক প্রকাশক শুধু ব্যবসাই করতে চান; কেউ কেউ অসাধারণ মানুষও) পরিসরকে রসদ ও মদদ দিয়ে যান। এতে করে হয় কি তারা ব্যবসার চেয়ে চেতনার উত্তেজনায় বেশি মেতে থাকেন। ফলে বাংলাদেশের বইয়ের বাজার আজও ফকিন্নি দশা থেকে বের হতে পারল না। যারা দুনিয়ার বইপুস্তকের বাজারের খবর রাখেন তারা আমার মতের সাথে দ্বিমত করবেন না আশা করি। বাংলা বই প্রকাশ এখনও ১৯ শতকের রেনেসাঁর খাসিলত কাটাইয়া বাণিজ্য বা কর্পোরেট বাণিজ্যের ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারছে না। এর জন্য অনেক কারণের সব চেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, চেতনার উত্তেজনায় আমরা বেদিক হয়ে যাই। আমরা ভুলে যাই এটা ২০১৯, ৫২ না।
অন্যদিকে ২১ ফেব্র্রুয়ারী কেন্দ্রিক বই প্রকাশের উম্মাদনা পাঠক সংষ্কৃতির সর্বনাশ করে দিয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি, বই যদি জ্ঞানের বাহন হয়; তাইলে এই জ্ঞানের আবির্ভাব নিজেই একটা বড় ঘটনা বা ইভেন্ট। এর জন্য আলাদা কোন চেতনাগত ইভেন্ট দরকার নাই। ফলে একটা বই যদি বের হয় সেটাই একটা ঘটনা হওয়ার কথা পাঠকদের জন্য। সেটাই পাঠক বা জ্ঞান সাধকদের জন্য বড় ইভেন্ট। আর এই ধরণের ইভেন্ট যেকোন সময়ই ঘটতে পারে। লেখক যেকোন সময় ইন্টারভেন করতে পারেন। সারাদেশের বই বাজার ও রিডিং-সংষ্কৃতি মজবুত থাকলে প্রকাশকের বই বিক্রি নিয়ে বাড়তি টেনশনের দরকারও পড়বে না। কিন্তু এখন হয় কি, শখের লেখক থেকে শুরু করে সবার বই একটা চেতনাগত উত্তেজনার ভেতর হাজির হয়, তখন বইটার আর নিজের পক্ষে একটা ঘটনা হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। ফলে হুজুগে প্রচুর বই বের করা ও সারা বছর বাদ রেখে এক মাস জুয়ার আসরের মতো বিজি থাকে এরা। এতে পাঠক বেশ সিজনাল হয়ে যাচ্ছে। সারাবছর বই এর কোন খবর না থাকলেও মেলার সময় বৈধ-অবৈধ বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে হল্লা করা ও পরিবেশকে ধূলাময় করতে সাহায্য করার জন্য এরা খুব একটিভ থাকে। কিন্তু আয়োজক/প্রকাশদের আবার আছে খামাখা ভিড়ের প্রতি লোভ। বাট যারা আসে তারা তো খুব বই কিনেন না। ফলে এই বই বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের বইয়ের বাজার ও পাঠকসংষ্কৃতি তৈরিতে একটা বাঁধা হিসেবে হাজির হয়েছে।
এতক্ষণে আমি মনে হয় বাংলা ভাষা ও সংষ্কৃতির কঠিন শত্রু থেকে দন্ড পাওয়ার উপযুক্ত আসামীতে পরিণত হয়ে গেছি। যারা এমনটা মনে করছেন- খামোশ!
মনে রাখবেন, মূর্খতা কোন পাপ নয়। কিন্তু মূর্খতার অহং হইল ক্রাইম। কিসের আপনাদের ভাষাপ্রেম? বাংলাদেশে তো কোন ভাষাপ্রেম নাই। আছে ‘বর্ণমালা পূজার সংষ্কৃতি’। ভাষাপ্রেম থাকলে তো আমাদের বাচ্চারা অন্তত দুই-তিনটা ভাষা জানত। অন্যগুলো বাদ দিলাম, আরবী ও ইংরেজি তো অবশ্যই অল্প বয়সেই শিখে যাবার কথা ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষাটাও যে ভাল ভাবে পারে তারও তো নজির নাই। আছে কেবল কুৎসিত বর্ণমালা প্রেম। এটা ভাষাপ্রেম না। আর ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যারা বলেন তারা শুধু অশিক্ষিতই না, এরা রংবাজ, সন্ত্রাসী। দুনিয়া ও রাজনীতি সম্পর্কে কোন খবর নাই এদের।
মাদ্রাসার ছাত্রদের বই মেলাতে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের টুপি-দাঁড়িকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তাদের অনাহুত ভাবা হয়। গত কয়েক বছরে কয়েকটি পুলিশি হয়রানির খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে
ভাষার সাথে জাতীয়তার কোন সম্পর্ক নাই। এক আরবী ভাষা-ভাষী অঞ্চলে বহু জাতি তৈরি হয়েছে। ভাষার লেঙ্গুর ধরে সেখানে সবাই এক জাতি হয়ে যায় নাই। একাট্টা বাংলা ভাষা বলেও কোন ভাষা নাই। বাংলা ভাষারও বহু রূপ আছে। কিছু পণ্ডিত ভারতীয়(কলকাতার) বাংলাকে এখানে চাপিয়ে দিতে চান। এটার নাম দিছে তারা আবার ‘মান বাঙলা’, বাকিগুলার কি মান-ইজ্জত নাই তাহলে? এবং এরা ‘প্রাণের মেলা’ বলে যেভাবে বুক চাপড়ায়, আবেগে হাউকাউ করে, এটাকে কেবল ‘সরল সংস্কৃতি প্রেম’ হিসেবে দেখার সুযোগ নাই। এর সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক খুবই সরাসরি। এটাকে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদও বলতে পারেন। আজ আর কোন তাত্ত্বিক আলাপ করব না; শুধু ইশারা দিয়ে রাখব। বিখ্যাত দার্শনিক, জর্জিও আগামবেন, তাঁর ‘সেক্রামেন্ট অব ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইয়ে ভাষা নিয়ে যে ধরণের আলাপ তুলেছেন, সেইটা পড়তে গিয়ে মনে হলো, আমাদের দেশে ভাষা নিয়া কোন কথা এখনও শুরু হয়নি। আছে প্যাচপ্যাচা ইমোশনের চর্চা। এটা দিয়ে কোন কাজের কাজ হয় না। ভাষার সাথে আত্মপরিচয়, সত্তার একটা সম্পর্ক থাকে। থাকে বিশ্বাস ও ক্ষমতার রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক। কোন ভাষার চেয়ে কোন ভাষা বেশি পবিত্র বা বেশি প্রেমের জিনিস হতে পারে না। বাংলা একটা চিহ্ন ব্যবস্থা মাত্র। এই চিহ্ন-ব্যবস্থার প্রেমে গদগদ থাকলে খোদ ‘ভাষা’র আলাপটা আর নজরে পড়ে না। যা বলছিলাম, আগামবেন আলোচনা করতেছেন ‘সেক্রামেন্ট’ মানে সংষ্কার, শুধু সংষ্কার না, বিশ্বাস বা ধর্ম সংষ্কারের বিষয়টা বুঝতে এই শব্দ ব্যবহার করা হইছে। ভাষার বিকাশের সাথে বিশ্বাসের সংষ্কার বা রিফর্মের একটা সম্পর্ক আছে। আমি জটিল আলাপ বাদ রাখছি। কারণ ভাষা নিয়া আমার লম্বা করে আলাপ শুরুর নিয়ত আছে। তো এখন একটা ভাষার প্রকরণ চাপাইয়া দেয়ার ভেতর দিয়ে তারা আসলে একটা আদর্শ বা ধর্ম চাপায়ে দিতে চায়। এবং অন্য ধর্মকে তাদের ভাষার এলাকায় কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না। এই জন্য বাঙালি সংষ্কৃতিখোররা দেখবেন ভাষায় একটা আরবি-ফার্সি ঢুকলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। সো ভাষার সাথে রাজনীতি-ধর্ম ও ক্ষমতার সম্পর্ক খুবই জটিল ও সরাসরি। এই প্রসঙ্গ আজ তোলা থাক। কথা বলছিলাম বইমেলা ও চেতনার জুলম নিয়ে।
অন্যদিকে ‘অমর একুশে’র নামে মাস-ব্যাপি যে উম্মাদনা দেখেতেছেন এটা তো ভাষা আন্দোলনের একটা পার্টিজান ইতিহাসের বয়ানের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিাসের একটা আরওয়ামী ন্যারেশন তৈরি হয়েছে অথচ আন্দোলনটা দলীয় রাজনৈতিক এজেন্ডা আকারে হয় নাই। ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদের যে কলকাতাইয়া ধারণা আওয়ামী লীগ এডাপ্ট করছে এটকে জাসিটিফাই করতে এই ৫২ কে এরা একাত্তরের সাথে মিলায়ে একটা উদ্ভট রাজনৈতিক বয়ান দাঁড় করাইছে। ফলে এই দিক থেকেও বইমেলা এই দলটির রাজনৈতিক ইভেন্ট ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু কৌতুকের বিষয় হল, এই রাজনীতির সাথে দ্বিমত পোষক করেন এমন অনেকেই এটাকে সাহিত্যের মহা আয়োজন মনে করে একবুক খুশি নিয়ে এই মেলাতে হাজির হয়ে গদগদ হয়ে উঠেন। এমনকি অনেক জামাতপন্থি লেখকদের দেখেছি বুটিকের পাঞ্জাবী পড়ে বই মেলা আসলে জামাই সেজে মেলায় হাজির হয়ে যান। এবং তাদের বাড়তি আগ্রহ থাকে কি ভাবে মেলাকে ব্যাবহার করে আরও ভালোভাবে প্রগতীশীলদের দৃষ্টিতে আসা যায়। এই ইভেন্টের রাজনৈতিক চরিত্র উম্মোচনের কাজটি না করে সবাই দেখি এটাকে ভাষা-সাহিত্য উদ্ধারের পবিত্র মৌসুম ভেবে বসে আছেন! এই হীনমনন্যতা আমাদের লেখকদের রাজনৈতিক অশিক্ষা ও খ্যাতির জন্য মরিয়া হয়ে থাকার মানসিকতা থেকেই তৈরি হয়েছে। বই মেলার চেতনাবাদি-প্রগতীবাদি ও একটা রাবীন্দ্রীক আগ্রসনও আছে। এই আগ্রসনের চরিত্রকে সংষ্কৃতির নামে সবার উপর চাপায়ে দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আমরা এখনও কোন প্রশ্ন তুলতেছিনা। সাহিত্যের চরিত্র রাজনৈতিক -এটা নতুন করে বলার কিছু নাই। কিন্তু এই ধরণের একটি আয়োজনের যে রাজনীতি তা জাতি হিসেবে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। যেমন এই ধারার রাজনীতিই এটা অবৈধ ও ফ্যাসিবাদের ধারক-বাহক হয়ে পুরাপুরি মিথ্যার উপর দাঁড়ায়ে আছে। এদের সংষ্কৃতি চর্চার চরিত্রও এই রাজনীতির ভয়াবহ গ্রাস থেকে মুক্ত না। লেখকরা বে-আক্কেলের মতো এই আগ্রসনেকে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন। যাক এই দিকটি আগেও আলোচনা করেছি। আসল কথায় ফিরি।
তাই বলে আমি বইমেলা আয়োজন বন্ধ করার কথা কইতেছি না। বইমেলা একটা হতেই পারে। বাট এটার উদ্দেশ্য হবে, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের জন্য বেশি বেশি সুযোগ তৈরি করা। লেখকদের বড় বড় কাজের বিষয়ে চুক্তি হবে। নতুন নতুন লেখকদের বই বের করার একটা পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া চালু হবে। দেশি-বিদেশি লেখকরা ঘুরবেন, কথা বলবেন। একটা এমবিশাস বই লেখার জন্য লেখকরা ক্ষ্যাপা হয়ে উঠবেন। তার বইটাই একটা ঘটনা আকারে হাজির হবে এমন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এবং বছরের যেকোনো সময় বই বের হতে পারে সেটা। যেকোনো জায়গা থেকে পাঠক বই পাইতে পারেন। ফেব্রুয়ারিতে এই ভাষাভিত্তিক চেতনাসন্ত্রাস ও অশিক্ষিত ফ্যাসিবাদের আবাদ কেন এখনও করে যেতে হবে আমাদের বই মেলার ছুতায়?
এটার উদ্দেশ্য হবে, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের জন্য বেশি বেশি সুযোগ তৈরি করা। লেখকদের বড় বড় কাজের বিষয়ে চুক্তি হবে। নতুন নতুন লেখকদের বই বের করার একটা পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া চালু হবে। দেশি-বিদেশি লেখকরা ঘুরবেন, কথা বলবেন। একটা এমবিশাস বই লেখার জন্য লেখকরা ক্ষ্যাপা হয়ে উঠবেন। তার বইটাই একটা ঘটনা আকারে হাজির হবে এমন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন
এখনও কেন শাহবাগ ও নাস্তিক্যবাদি সংস্কৃতিই মূলধারায় প্রেজেন্ট করা হবে? হাজার হাজার মাদরাসার ছাত্র দেশে আছেন। কয়জন বইমেলায় আসতে পারে (এখন এরা লিখেন, বই বের করেন, এবং মেলায় আসেন) বাট সংখ্যাটা কম। মাদ্রাসার ছাত্রদের বই মেলাতে নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের টুপি-দাঁড়িকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তাদের অনাহুত ভাবা হয়। গত কয়েক বছরে কয়েকটি পুলিশি হয়রানির খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশের কুলাঙ্গার বুদ্ধিজীবিরা সবসময় তেলের মাথায় তেল দেয়। অলরেডি যেটা মূলধারা, এবং এই মূলধারা সাংষ্কৃতিকভাবে একটা ফ্যাসিবাদি ক্ষমতাকে উলঙ্গভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এটা জেনেও এরা এই ফ্যাসিবাদের গোড়াতেই তেল ঢালতেছে আর ভাষার কথা, চেতনার কথা মুখস্ত ভাবে বলে যাচ্ছে। ফলে এর বাইরে যারা আছেন; যারা সমাজের সব দল, মত ও ভিন্ন চিন্তা-রুচির মানুষের সহ-অবস্থান চান। এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব- বাজারে সব অর্থেই মাথা উঁচু দেখতে চান তাঁদের উচিত তেলের ঢিবিতে আগুন ধরায়া দেয়া। ভুল বুঝবেন না, আমি বুদ্ধিবৃত্তিক ভায়োলেন্সের কথা বলছি। থিওরিটিক্যাল ভায়োলেন্স -এর কথা বলছি।
আমি মনে করি, বই এই ধরণের মেলাতেই আনতে হবে এমন কোন কথা নয়। বরং এই মেলাতে মূল ফোকাস থাকে বায়ান্নর চেতনা চর্চার দিকে। ফলে বইয়ের দিকে ফোকাস করার আর কোন ইচ্ছে থাকে না। এরা মনে করে বায়ান্নর ইতিহাস পূজা করলেই বাংলা সাহিত্য দুনিয়ার সবাইরে ছাড়ায়ে যাবে। আবার এই বায়ান্নর ইতিহাসটা হইল একটা দলীয় ইতিহাস। অবশ্য বাংলাদেশে ৫২, ৭১, শাহবাগ এইসবের ইতিহাস বলে যা চালু আছে তা একটি দলীয় জুলুম। একটা ইতিহাসের কোন ক্রিটিক করা যাবে না, নতুন চিন্তা করা যাবে না- এটা আইন দিয়ে যারা বন্ধ করতে চায় বুঝতে হবে, ওর কোন ইতিহাস নাই। সবই অবৈধ ক্ষমতার ফন্দিফিকির। তাও বলি, তাদের যদি চেতনা চর্চার এতোই জরুরত থাকে তাইলে একটা আলদা মেলা করুক। প্রকাশকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে রকম বইমেলা হয় তেমন একটি বইমেলার কথা ভাবতে পারেন, বছরের যেকোনো সময় এটা হতে পারে। বইও বের হবে বছরের যেকোনো সময়। কেননা চেতনার সমস্যা আমাদের ঐতিহ্য হতে পারে না। ভাষাপ্রেমের নামে অশিক্ষা ও কুশিক্ষার চর্চা চলতে পারে না। আমি উর্দু-পাঞ্জাবী ভাষাও শিখতে উতসাহিত করি। নিজের ভাষা সেরা আর সব কেওকেটা –এই রকম ধারণা এখন কেবলমাত্র চুড়ান্ত সন্ত্রাসীদের পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব। ভাষার কারণে কারো গৌরব বাড়ে না। ইংরেজি বা বাংলা নিয়ে অহেতুক অহং এর কোন মানে হয় না। ‘ভাষা’ ব্যাপারটা বুঝলে আপনি হিব্রুতে লিখলেও আমার কোন সমস্যা নাই। কারণ এখন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদের কাজটা খুব সহজ ও একটা পেশাগত ব্যাপার হয়ে গেছে। হারুকি মুরাকামি, জাপানি ভাষায় লেখেন, ইংরেজিতে তাঁর পাঠক যে কোন ইংরেজি লেখকের চেয়ে কম না। এমন বহু লেখক আছেন। একই সাথে বইটা অনেকগুলা ভাষাতে অনুবাদ হয়। তার মানে ভাষা বা বর্ণমালা পূজা না করে সাহিত্য ও চিন্তার গোড়ার বিষয়গুলা রপ্ত করতে হবে। নিজেদের সাহিত্যের উপনিবেশী-দশা কাটানোর জন্য ধৈর্য্য ধরে চিন্তাকে শাণিত করে গ্লোবাল কমিউনিটির দিকে তাকিয়ে, গোটা মানব সভ্যতার সাথে নিজের সম্পর্ককে আমলে নিয়ে লেখা-লেখির দিকে আগাতে হবে। নইলে শাহবাগের কবি, বান্ধবীদের প্রিয় লেখক বা মহল্লার সাহিত্যিক হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে হৈ চৈ করে জীবন পার করতে হবে। দুনিয়ার সাহিত্য বাজার তো দূরের কথা; কোন রিডারই মুখ ফিরে তাকাবে না। নিজের কাছে নিজেরে কেবল মহান মনে হবে; কাজের কাজ হবে না।
যাহোক আজ এখানেই শেষ করি। তবে মনে রাখতে হবে, নতুন চিন্তার আগুন কিন্তু জ্বালাতে হবে। নইলে অনিয়ম ও চুড়ান্ত সর্বনাশা পথই ডিজিটাল ও চেতনার পথের নামে আমাদের উপর চেপে বসবে। যা আমাদের জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য অপমানজনক। স্বাধীনতার বোধ আত্মসম্মানের সাথে সম্পর্কিত।
(প্রথম খসড়া :১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)