পুরুষ ধর্ষণ করে কেন?

সান্ড্রা নিউম্যান‘র বিশেষ লেখা

পুরুষ ধর্ষণ করে কেন?

সান্ড্রা নিউম্যান, আমেরিকান লেখক। তিনি একই সাথে ফিকশন ও ননফিকশন লিখেন। নিয়মিত বিখ্যাত পত্রিকাগুলো লিখেন তিনি। তার উপন্যাস ‘দ্যা কান্ট্রি অব আইসক্রিম স্টার’ ও ননফিকশন, ‘হাও নট টু রাইট এ ফিকশন’ অন্যতম। তার ‘হোয়াই ম্যান রেপ’ লেখাটি জবান’র জন্য অনুবাদ করেছেন জুনায়েদ আহমেদ এহসান।


পুরুষরা কেন ধর্ষণ করে?— এটা নিয়ে অনেক দিনের একটা সাধারণ ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত। এটা অনেকটা এরকম যে, যখন একজন পুরুষ যৌনতা থেকে বঞ্চিত থাকে অথবা অতিরিক্ত মাত্রায় যৌনকামনায় ভোগে বা কামুক হয় তখন একজন অরক্ষিত নারীকে সামনে পেলে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না। বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞানের কাছে শুরুর দিকে এই ধারণা মোটাদাগে এরকমই ছিল। ১৮৮৬ সালে রিচার্ড ভন ক্রাফট-এবিং তার ‘সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস’ (Psychopathia Sexualis) বইতে প্রিয়াপিজম (যৌন উদ্দীপনা শেষেও যৌনাঙ্গের উত্তেজিত থাকা যেটার কারণে অনিয়ন্ত্রিত কিংবা অত্যাধিক যৌনকামনা থেকে যায়) এবং মানসিক দূর্বলতাকে পুরুষদের নিয়ন্ত্রন হারানোর জন্য দায়ী করেন। এটা অনেকটা হাইড্রোলিকস’র মতো,  যখন কোনো পাইপের মধ্যে পানির অত্যাধিক চাপ থাকে কিংবা পাইপটি দুর্বল হয়, তখন দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মানুষের যৌনতা নিয়ে বিজ্ঞানের তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। এই কারণে এই ধরনের ব্যাখ্যাকে গবেষকরা একরকমভাবে সমর্থন করে যান। ব্রিটিশ শারীরতত্ত্ববিদ হ্যাভলক এলিস বিশ্বাস করতেন, পুরুষদের যৌনতা মাত্রই জোরপূর্বক এবং লুন্ঠনের যৌনতা। এই বিশ্বাস ধর্ষণকে পুরুষের সহজাত পৌরুষত্বের উদ্ভাস হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকান জীবতত্ত্ববিদ আলফ্রেড কিনসেও ধর্ষণের ইস্যুটি এড়িয়ে যান। তার মতে ধর্ষণ কোনো ধরনের ক্ষতি করে না, বরং এখানে ক্ষতির বিষয়টি এক ধরনের অপবাদ। এভাবে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ধর্ষণের হাইড্রোলিক মডেলটি স্থায়ী থাকে। এই ধারণাগুলো মূলত প্রথম ধাক্কাটা খায় যখন সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা এবং নারীবাদের তত্ত্বগুলোর জন্ম হতে থাকে। ‘কেন পুরুষ ধর্ষন করে?’— এর নতুন ধরনের ব্যাখ্যা তখন থেকে শুরু হয়। কিন্তু তারপরও ‘কিভাবে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা যাবে?’— এই প্রশ্নটি উপেক্ষিত থেকে যায়।

হাইড্রোলিক তত্ত্বে আবার ফিরে আসা যাক। এই তত্ত্ব ধর্ষণের শিকার নারীকে দোষারোপ করার দরজা খুলে দেয়। যদি যৌনকামনাই ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে নারী এখানে উত্তেজক বস্তু হিসেবে কাজ করে যা একজন ভালো পুরুষকেও আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। এই ধারণা অপরাধের শিকারকেই অপরাধী হিসেবে দাঁড় করায়। পুরুষকে দেখা হয় অসহায় একজন মানুষ হিসেবে। যে কিনা একজন নারীকে আঘাত করে, ধস্তাধস্তি করে তাকে মাটিতে ফেলে এবং জোরপূর্বক তার ভেতর যৌনাঙ্গ প্রবেশ করায়।

বিশ্বাস করতেন, পুরুষদের যৌনতা মাত্রই জোরপূর্বক এবং লুন্ঠনের যৌনতা। এই বিশ্বাস ধর্ষণকে পুরুষের সহজাত পৌরুষত্বের উদ্ভাস হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়।

 

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ফ্রয়েডিয়ানরাও এই ধারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে যে নারীরাই ধর্ষণের প্ররোচনা দেয়। তাদের জল্পনা ছিলো সকল নারীরাই গোপনে ধর্ষিত হওয়ার ফ্যান্টাসিতে ভোগে।  জার্মান মনোবিশ্লেষক কারেন হর্নি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্যা প্রবলেম অব ফেমিনিন মাসোচিজম’ (The Problem of Feminine Masochism) গ্রন্থে বলেন, নারীদের যৌনতা স্বভাবগতভাবেই এক ধরনের আত্ননিগ্রহের যৌনতা। বয়ঃসন্ধিকালের যৌন আকাঙ্ক্ষা শুরু হয় পিতাকে কেন্দ্র করে। নারীরা অবচেতনভাবেই যৌন লাঞ্চনার শিকার হতে চান বলে মনে করতেন হর্নি। আরো বেশি দোষারোপ শুরু হয় যখন মনোবিজ্ঞানী ডেভিড আব্রাহামসেন ১৯৬০ সালে ‘দ্যা সাইকোলজি অফ ক্রাইম’ (The Psychology of Crime ) লিখেন। তিনি দাবি করেন, একজন ধর্ষক তৈরি হয় তার মাকে দেখে। যিনি একই সাথে সম্মোহনকারী কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, এভাবে পুরুষ তাড়িত হয়। তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলনের মাধ্যমে সে তাড়না থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং একসময় সে ধর্ষনের মত অপরাধ করে বসে। এখানেও প্রকারান্তে একজন নারীকেই দোষারোপ করার সুযোগ তৈরি হয়।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও এই ধারণাগুলো একসময় প্রচলিত ছিলো ( আমাদের মতো সমাজে এখনও প্রচলিত আছে- অনুবাদক)। এই ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন বিখ্যাত আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা সুসান ব্রাউনমিলার। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘এগেইনস্ট আওয়ার উইল : ম্যান, উইমেন এন্ড রেপ’ (Against Our Will : Men, Women and Rape) বইতে তিনি বলেন, ধর্ষণ সচেতনভাবেই এক ধরনের আতংক ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে পুরুষরা নারীদেরকে এক ধরনের ভয়ের ভিতরে রাখতে চায়। ধর্ষণকে যৌন আকাঙ্ক্ষার ফলাফল হিসেবে দাবি করার যুক্তিগুলো তিনি উড়িয়ে দেন এবং একই সাথে এটাকে ‘রাজনৈতিক অপরাধ’ বলে আখ্যা দেন।

ধর্ষণ আবেগতাড়িত কোনো অপরাধ নয়, বরং এটা পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ যা অনেক সময় দলগতভাবেও হয়ে থাকে। যেভাবেই ধর্ষণ সংগঠিত হোক না কেন, সুসান মনে করেন, ধর্ষণ যৌনতার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং ধর্ষণের সাথে সম্পর্ক ক্ষমতার।

 

ধর্ষণ আবেগতাড়িত কোনো অপরাধ নয়, বরং এটা পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ যা অনেক সময় দলগতভাবেও হয়ে থাকে। যেভাবেই ধর্ষণ সংগঠিত হোক না কেন, সুসান মনে করেন, ধর্ষণ যৌনতার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং ধর্ষণের সাথে সম্পর্ক ক্ষমতার।

সুসানের মতবাদ সেই সময়ে ব্যপক আলোড়ন তৈলি করেছিলো এবং এই মতবাদকে ঘিরেও তর্ক-বিতর্কের খেলা শুরু হয়। নারীবাদ বিরোধীরা এটাকে হাস্যকর যুক্তি বলে দাবি করেন এবং ব্যঙ্গ করে বলেন, “সিঁধেল চোরেরা টাকার জন্য চুরি করে না, বরং তারা গৃহস্থকে শোষণ করার জন্য চুরি করে!” যাই হোক, নারীবাদীরা সুসানের তত্ত্বকে পরিপূর্ণভাবেই গ্রহণ করেন। যেহেতু ওই সময়ে গবেষণাকার্যের জন্য যথেষ্ট টাকা ছিল এবং মনোবিজ্ঞানীরাও এটাতে আগ্রহী ছিলেন, সুতরাং ধর্ষকের উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু হলো।

এই গবেষণাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী গবেষণাটি করেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিকোলাস গ্রোথ। গ্রোথ ম্যাসাচুসেটস কারাগারে বন্দি কয়েকশ ধর্ষকের উপর গবেষণা করে এর উপর ভিত্তি করে তিনি ১৯৭৯ সালে ‘ম্যান হু রেপ’ (Men Who Rape) নামে একটি বই প্রকাশ করেন। গ্রোথ’র মতে ধর্ষণের তিন ধরনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সেগুলো হলো :

১. স্যাডিজম (অন্যকে জোর পূর্বক ধর্ষণের মাধ্যমে যৌনসুখ লাভের মানসিক বিকার)

২. ক্রোধ এবং ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা।

৩. ধর্ষণ সবসময়ই একটি মানসিক বিকার। এই মানসিক বিকার ক্ষনস্থায়ীও হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদেও থাকতে পারে।

গ্রোথের দাবি ছিলো, মানসিকভাবে সুস্থ কোনো পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে না, তিনি আরও বলেন, ধর্ষণ একটি যৌনতার ছদ্মবেশ যার মাধ্যমে আসলে ক্ষমতা এবং ক্রোধই নিজেকে পরিচালিত করে।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে গ্রোথ তার বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। তিনি কোন উপায়ে গবেষণা করেছিলেন এবং ধর্ষকদের কি কি প্রশ্ন করেছিলেন, সেগুলোরও ব্যাখ্যা করেননি। যদিও তার গবেষণাটি খুবই শক্তিশালী ছিল। কারণ তিনি প্রমাণ করেছিলেন ‘ধর্ষণ যৌনতাড়িত কোনো ঘটনা নয়’। কিন্তু তিনি তার বইয়ে এই প্রমাণের পক্ষে কিছু লিখেননি।

ধর্ষকরা মূলত অন্যন্যদের থেকে কম সহনশীল হয়, খুব বেশিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক এবং ম্যানুপুলেটিভ হয় এবং নারীদের প্রতি তাদের এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সব দিক বিবেচনায় ধর্ষকের সাথে অন্যন্যদের পার্থক্য খুবই কম কিন্তু এই পার্থক্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

এদিকে অন্য গবেষকরা ব্যস্ত ছিলেন পুরানো হাইড্রোলিক মডেলকে প্রমাণ করতে, যদিও তারা ব্যর্থ হন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ধর্ষণের সময় পুরুষদের যৌন হরমোন স্বাভাবিক মিলনের সময়ের মতই থাকে। এমনকি ধর্ষকদের যৌনসঙ্গী অন্যান্যদের তুলনায় বেশি থাকে। আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী এবং যৌনতত্ত্ববিদ পল গেবহার্ড ১৯৬৫ সালে ‘সেক্স অফেনডারস : অ্যান এনালাইসিস অব টাইপস’ (Sex Offenders: An Analysis of Types) বইয়ে দাবি করেন, বিবাহিত ধর্ষকরাও তাদের স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক যৌনজীবন সচল রাখে। এই গবেষণাগুলো খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় ধর্ষণের কারণ হিসেবে অধিক বিকারগ্রস্থ যৌনকামনা কিংবা হতাশাকে মোটামুটি বাতিল করে দেয়া হয়।

একই সময়ে, ধর্ষণের কারণ হিসেবে যৌনতার বাইরের ব্যাখ্যাগুলোও খারিজ হয়ে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা প্রথমদিকে কারাবন্দি ধর্ষকদের নিয়ে গবেষণা করেন, যেহেতু তাদেরকে পাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু গুটিকয়েক ধর্ষককেই জেলে পাওয়া যেতো, এবং তারা অন্যান্য ধর্ষক থেকে অস্বাভাবিক ছিল। এসব ধর্ষকরা মূলত পথচারীদের লাঞ্চিত করা কিংবা অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা এসব কাজে জড়িত ছিলো এবং তাদের পূর্ব অপরাধের নথিও ছিল পোক্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কোনো শিক্ষা ছিল না এবং সমাজে তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানও ছিল না।

১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কিছু গবেষক নতুন ধরনের গবেষণা শুরু করলেন ধর্ষনের উপর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যেসব ধর্ষক কখনো কারাবন্দি হয়নি কিংবা তাদের নামে কোনো মামলাও হয় নি। এসব ধর্ষকরা অনেক কমক্ষেত্রেই জবরদস্তি কিংবা শারীরিক শক্তির আশ্রয় নিতো। তার পরিবর্তে তারা যেটা করতো তা হলো, মদ্যপান করিয়ে মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতো। বলপ্রয়োগ তখনোই হতো যখন, সম্মতিসূচক যৌনসম্পর্কে বাধা সৃষ্টি হতো। এই তথাকথিত ‘ডেট রেপ’র কারণ হিসেবে ওই মূহুর্তের যৌনতাড়নাকেই দেখা হয়।

এই ধরনের গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ জায়গাটি হচ্ছে এটার মাধ্যমে মুক্ত ধর্ষকদের চিহ্নিত করা যায়। যারা নিজেরাই স্বীকার করে তারা ধর্ষণের সাথে জড়িত। এই ধর্ষক শ্রেণির একটা বড় অংশ কলেজ বা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র এবং অবিশ্বাস্যভাবে তারা তাদের যৌন অপরাধ একজন অপরিচিত লোকের সাথে স্বীকার করে। যদিও প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জিজ্ঞেস করা হয় না। বরং এটাকে একটু ঘুরিয়া বলা হয়, “আপনি কি কখনো কারো সাথে যৌন সম্পর্ক করেছেন যেখানে আপনার পার্টনার রাজি ছিল না, কিন্তু আপনি বলপ্রয়োগ করেছেন অথবা বলপ্রয়োগের ভয় দেখিয়েছেন?” মনোবিজ্ঞানী ডেভিড লিসাক এবং সুসার রথ নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে লিসাক ও পল মিলার রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাটি করেছিলেন। যদিও উত্তরদাতারা কোনোভাবে বুঝতে পারেননি তারা একটি ধর্ষণের বর্ণনা দিচ্ছেন।

১৯৮৫ থেকে ১৯৯৮ সালে আরেকটি গবেষণা করা হয়। এই গবেষণার ফলাফল আমাদেরকে চমকপ্রদ তথ্য দেয়। ওই সময়ের মধ্যে ১০টি ভিন্ন গবেষণা করা হয়। সেখানে দেখা যায় ৬% থেকে ১৪.৯% কলেজ ছাত্ররা ধর্ষণের সাথে জড়িত অথবা ধর্ষণের প্রচেষ্টা নিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছাত্র এই কাজের সাথে বরবার জড়িত ছিল। এই গবেষণাটির ভিত্তি ছিল একটি মানসম্পন্ন প্রশ্নপত্র যেটার নাম ছিলো ‘সেক্সুয়াল এক্সপেরিয়েন্স সার্ভে’। এই প্রশ্নপত্রের প্রতিটি প্রশ্নের সাথে ‘তাদের সম্মতি ছাড়া’ কথাটি সংযুক্ত ছিলো যেটার মাধ্যমে ধর্ষণের মাপকাঠি নির্ধারিত হয়। অধিকন্তু, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে যারা ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছিলো তারা কেউই এটাকে ভুল বুঝাবুঝি দাবি করেনি। তারা জানত যে মেয়েটির যৌনসম্পর্ক করার ইচ্ছা নেই। তারা আসলে সম্মতি ছাড়া যৌনসম্পর্ক এবং ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি।

ধর্ষকরা মূলত অন্যন্যদের থেকে কম সহনশীল হয়, খুব বেশিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক এবং ম্যানুপুলেটিভ হয় এবং নারীদের প্রতি তাদের এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সব দিক বিবেচনায় ধর্ষকের সাথে অন্যন্যদের পার্থক্য খুবই কম কিন্তু এই পার্থক্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

 

এ গবেষণায় ধর্ষকদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষনে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ধর্ষকরা মূলত অন্যন্যদের থেকে কম সহনশীল হয়, খুব বেশিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক এবং ম্যানুপুলেটিভ হয় এবং নারীদের প্রতি তাদের এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সব দিক বিবেচনায় ধর্ষকের সাথে অন্যন্যদের পার্থক্য খুবই কম কিন্তু এই পার্থক্যগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণার উপসংহার আমরা এভাবে টানতে পারি যে, ধর্ষকরা কোনো দানব নয়, বরং সাধারণ মানুষ থেকেই ধর্ষকের উৎপত্তি ঘটে। এই উৎপত্তির ক্ষেত্রে নারীবিদ্বেষী মনোভাব প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে।

যদি নির্মমতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং যৌনতা একজন পুরুষকে ধর্ষক বানায়, তাহলে ধর্ষণের সমস্যাটির সমাধান করাটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। আমরা হয়তোবা যৌনতার বিনাশ ঘটাতে পারি, কিন্তু নির্মমতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতার সমস্যা হাজার বছর ধরেও উল্লেখযোগ্য কোনো সমাধানে পৌঁছায়নি।

আমেরিকান লেখক ডায়ানা স্কালি ১৯৯০ সালে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স’ নামে একটি বই লিখেন। এ বইটি লিখিত হয় ‘ইউএস ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ম্যানটাল হেলথ’র একটি গবেষণাকে কেন্দ্র করে। ডায়ানা লক্ষ্য করলেন যে, ধর্ষকরা নিজেদের কৃতকর্মকে ন্যায়সংগত প্রমাণ করার এবং তাদের নৃশংসতাকে লুকানোর চেষ্টা করে। তারা ধর্ষণকে একটি সাধারণ প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। একজন ধর্ষক এরকম বলেন যে, “যদি আপনি কাউকে কাছে পেতে চান এবং সে রাজি না হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই বল প্রয়োগ করতে হবে। পুরুষমাত্রই এরকম করে’। অন্য ধর্ষকরা মনে করে ধর্ষণ গ্রহণযোগ্য হবে যদি মেয়েটি সম্পর্কে বাজে ধারণা সমাজে প্রচলিত থাকে কিংবা তাকে ভ্রমনে নিয়ে যাওয়া যায়। কেউ কেউ আবার মনে করে, পূর্বে যৌনসম্পর্ক থাকলে বল প্রয়োগের মাধ্যমে তার সাথে আবারো যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা যায়। গবেষণাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি ছিলো, বেশিরভাগ ধর্ষক মনে করত তাদের কখনো শাস্তি হবে না। একজন ধর্ষকের ভাষ্য এরকম ছিলো যে, ‘আমি জানতাম আমি ভুল করছি। কিন্তু এটাও জানতাম বেশিরভাগ নারী ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করে না। আমি ভেবেছিলাম সেও মামলা করবে না’। তার মানে ধর্ষকরা ধর্ষণকে একটি নিরাপদ আনন্দ হিসেবেই দেখে থাকে।

অধিকাংশ ধর্ষণের কারণ ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’। এই সংস্কৃতির মানে হচ্ছে, ধর্ষণ শুধু একটি স্বাভাবিক আচরণই নয়, বরং একই সাথে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

 

এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন ধর্ষক আপেক্ষিকভাবে একটি অসামাজিক প্রাণী। ধর্ষিতার প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি তাকে বিরত করতে পারে না। যেমন, চোর এবং ছিনতাইকারী তাদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয় না। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো অপরাধের পূর্বশর্ত হচ্ছে, ভিকটিম বা শিকারের জন্য কোনো ধরনের সহানুভূতি না জন্মানো। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা তখনি ঘটে যখন কেউ বিশ্বাস করে, তার অপরাধের শাস্তিকে সে কৌশলে এড়িয়ে যেতে পারবে এবং বন্ধু মহলেও সামাজিকভাবে বয়কটের শিকার হবে না। ধর্ষকদের একটি বড় অংশই এভাবে চিন্তা করে। কলেজ পড়ুয়া ধর্ষকরা তো শাস্তির ভয় করেই না, বরং এটা যে অপরাধ সেটাও মনে করে না। এইসব বিষয় সামনে আসার পর ডায়ানা উপসংহারে বলেন, অধিকাংশ ধর্ষণের কারণ ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’। এই সংস্কৃতির মানে হচ্ছে, ধর্ষণ শুধু একটি স্বাভাবিক আচরণই নয়, বরং একই সাথে সম্পূর্ণ নিরাপদ।

ধর্ষণের সংস্কৃতি যদি আসলেই থেকে থাকে তাহলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন দেশে এর হার বিভিন্ন রকম। এবং এটা নির্ভর করবে ধর্ষণের শাস্তির মাত্রার উপর। আমেরিকার সাথে অন্য দেশগুলোর ধর্ষণ হারের তুলনা করলে বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। একটু আগে বলা হয়েছিলো আমেরিকায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ৬-১৪% ধর্ষণের সাথে জড়িত যারা নিজেরাই অপরাধ স্বীকার করেছে। ওই সময়ে চীনে এর হার ছিলো ২৩%। পাপুয়া নিউগিনির অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। সেখানে ধর্ষণের হার ছিলো ৬০% প্রায়।

যুদ্ধকালীন সময়ে সৈনিক কর্তৃক ধর্ষণও নির্ভর করে কিছু বিষয়ের উপর। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি কমান্ডাররা সৈনিকদের উদ্দীপিত করতো নাগরিকদের লাঞ্চিত করার জন্য। সেই সময়ে নানজিং নামক স্থানে প্রথম মাসেই ২০ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয় জাপানি বাহিনীর হাতে। ঐতিহাসিকভাবে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটে বামপন্থী গেরিলা সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রে। এল সালভেদরে ১২ বছর গৃহযুদ্ধ চলার পরও ১৯৮১ সালে ‘ইউএন ট্রুথ কমিশন’ তদন্ত করে দেখলো যে বিদ্রোহী গেরিলাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের কোনো মামলা হয় নি। যদিও যুদ্ধের প্রথম বছর সরকারি বাহিনী ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। এর পিছনে দুইটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিদ্রোহী গ্রুপের নিজস্ব আইন ছিলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, তাদের অস্তিত্বর প্রয়োজনেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মন ও হৃদয় জয় করা দরকার ছিল।

যুদ্ধের সময়ে ধর্ষণের ঘটনা নতুন মাত্রা লাভ করে। এই সময়ে ধর্ষণ আমাদের ধারণাকেও ছাপিয়ে যায়। এটা যে সব সময় বেড়ে যায়ে এমনটি নয়। তড়িৎ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাল বাহিনীর দ্বারা সংঘঠিত ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ করেই কমে গিয়েছিলো। কারণ সোভিয়েত নেতৃত্ব এটাকে যুদ্ধের একটি সমস্যা হিসেবে দেখেছিলো। এবং যুদ্ধের সময় ধর্ষণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই।  একইভাবে, সালভাদরের গণযুদ্ধের সময়ে ধর্ষণের ঘটনা যখন লক্ষনীয় ভাবে কমে এসছিলো, যখন আমেরিকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, তোমরা ধর্ষণ না থামালে আমেরিকার পক্ষ থেকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হবে। সাধারণভাবে এটা বলাই যায় যুদ্ধের সময়ও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনার মাত্রা কমিয়ে আনা যায় যদি তাদের কাছে এটার পরবর্তী কনসিকোয়েন্সটা পরিস্কারভাবে হাজির করা সম্ভব হয়।

আমরা যদি এই আলোচনার সাধারণ কোন উপসংহারে পৌঁছতে চাই তা হলে বলা যায়, অন্যান্য অপরাধের মতো ধর্ষণের ঘটানাও মোকাবেলা করা সম্ভব, যদি আমরা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। এই জন্য অবশ্যই সাময়িক সমাধানের যে সব বাকোয়াজি ভরা চিন্তা-ভাবনা আমাদের চার পাশে দেখা যায় তা বন্ধ করে কার্যকর প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে। তা হলেই এটা বন্ধ করা সম্ভব। প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই ক্ষেত্রে কাঙ্খিত সফলতা আসতে পারে।