এ সময়ের তরুণ কবিদের মধ্যে যারা নিয়মিত কাব্যচর্চায় নিজেকে শামিল রেখেছেন। তার প্রকাশিতব্য বই থেকে কয়েকটি কবিতা জবান’র পাঠকদের জন্য উত্থাপন করা হলো।
সুরা ইয়াসিন
কোনো সন্ধ্যায়, কারো সঙ্গের
ছাতাতলাটায় এক পার্শ্বে
তুমি হাঁটছ একা শরীরিণী
পাশে যে-ই লোক, ভাবো, ‘কার সে—!’
তুমি সঙ্গ ও নিঃসঙ্গের
টানাপোড়েনেই ভাবো ‘কই যাই—!’
ভাবো, এই সময়েই ছোট কৌটায়
মা খুঁজতেছে ভেজা দেশলাই
বাবা রিটায়ার্ড বাবা ক্লান্ত
সুরা ইয়াসিন ঝোলে দেয়ালে
দূরে শাদা ফুল ধীরে কালো হয়
চাঁদে মুখ দেয় কত শেয়ালে—
তুমি ছিঁড়ে যাও কূট হিংসায়
দম্পতিদের ফাঁকা কাপটায়
শাঁ শাঁ চলে যায় কারো গাড়িটা
তুমি মেখে যাও কাদা-ঝাপটায়—
ভাবো, অহেতুক এই বৃষ্টি
বেণি চুয়ে চুয়ে নামে সন্ধে
কোনো চুম্বন পৌঁছায় নি
আজ অব্দিই হৃদপিণ্ডে—
এই নীলক্ষেত: খোপ-পায়রার
জল-ছলছল ডুবো দোকানির
যেন দুই চোখ এই দেশটাই
ধনধান্য ভেসে অস্থির—!
ক্রমসংকোচে তুমি গুটে যাও
আসে মাৎস্যন্যায়ে ভরা দিন
দূরে বুলবুল কাঁপে সন্ধ্যায়
মার ঠোঁটজুড়ে সুরা ইয়াসিন—
বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে, তুমি ভিজবে না
বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে—তুমি ভিজবে না, না, খুঁজবে না
ছেঁড়া স্যান্ডেল নিচে নামবার—
ছাদে শুকনা কাপড়,
বড় মাদরাসাতে একা তালেবে এলেম
মোছে বোখারি শরিফ
তার জানালাপাশে দোলে আরশি, বেতের—
আজ শাওন মাসের কত যাচ্ছে তারিখ সে কি ভাবছে তা-ই—!
ভাবি, তোমার পথে যত দৃষ্টিবকুল ফুটে তুলবে ভুলে ওই তালেবে এলেম—!
তুমি দেখার ক্ষুধা হয়ে জ্বোলো না, মানিক!
সে কি খুতবা পড়ে দূর শুক্রবারে—নাকি মুয়াজ্জিনই খালি,
কোনো মসজিদে—!
তুমি জানো না কিছুই—ভাবো, ছাত্রটিও এই বর্ষাদিনে
কেন জানলা খুলে আছে দাঁড়িয়ে একা,
ছাদে পায়রা দুটি শাদা পাখনা মেলে দোঁহে ভিজছে হাওয়ায়, তত জলকেলিতে—
ভাবো নিরীহ এসব ছবি বর্ষাকালে
তুমি জানো না, সোনা—এরা দৃশ্যভিলেন—
তুমি বেরিয়ো না যেন—শোনো, রাস্তা খুঁড়ে কারা পালিয়ে গেছে
ধু ধু ভ্যানের ওপর কোন স্ত্রীটি আজ
তার স্বামীর শরীর ছেঁড়া ছাতা জড়িয়ে
ঢেকে রাখছে বুকে—তার লিউকোমিয়া, তার চোখের নিচে কোন বিষণ্নতা
কাঁপে বর্ষাজুড়ে—কূট-ছিন্ন কদম, আষাঢ়স্য ঘিরে
আজ যাচ্ছে ধুয়ে ওই ভ্যানের চাকায়—
ফ্যাসিবাদের এসব ক্রূর স্বর্ণযুগে, তুমি জানতে পাবে
কেউ, কারোর পাশেই, দেখা বৃষ্টিভিজে পারছে না দাঁড়াতে—
রু, বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে,
তুমি পুলিশভ্যানের পাশে এসে দাঁড়িয়ো না—
দেখো, কামরাঙাটির ফুল ভেসে যাচ্ছে,
অজস্র মৃত্যু চোখ চুয়ে তার—
গের্নিকা
যদি, তোমাদের ফ্যাসিস্ট সন্ধ্যায়
কখনো সকালের রোদ এসে হামলে পড়ে দূরে
যদি, অজস্র হিংসার ভিড়ে
দেখা যায়
শিশুদের হাইতোলা মুখের ওপর
হো হো করছে ট্রাক
অনন্ত গের্নিকা—
ফুলের নরম লেবু ভেঙে যায়
ফোটা ফোটা স্বেদ
হাসপাতালের পলেস্তারায়,
ফিনাইলে ঝরে আছে মহুয়া ছাঁচের দিন
এক চৌল হাসির জন্য ক্যামেরার ফ্ল্যাশ
জানে না সে
ক্ষণকাল পেরোলেই বেহেশতের পাখিরা তাকে
মিশিয়ে দেবে জন্মদক্ষিণার দিকে—
জোনাক-শরীর তার
ফ্যাসিস্টের ছিনালিতে
বহুদিন ঘূর্ণমান রুবিকনে
ছুড়ে দেয় আলো,
সাইকেলভর্তি কত আনাজের হাওয়া
আম্মা চোখের দূরে
অজস্র দেখতে পায় নোনা জুঁই ফুল—
পূরবী
এখানে নদীর নাম জলমিতা
এখানে আকাশ নীল বহুদিন
এখানে ভেড়ারা চরে সারা গ্রাম
এখানে তোমার মুখ কী মলিন!
তুমি কি শজনাডালে পাখিটার
বাঁকা সে ঠোঁটের পাশে নদীতীর—!
জানি না কোথায় তারা চলে যায়
শূন্য চিরটাকাল মন্দির—!
তুমি কি আসবে বঁধু, আমাদের
আত্মজীবনী ভরা সন্ধ্যায়
হাওয়াই মিঠাই যেন এ সময়
ধাতব শীতের মনোবেদনায়—
এখানে তোমার দিন সহজিয়া
এখানে মেঘের নাম মালহার
এখানে ভেড়ারা চরে দিনমান
হাওয়ায় পূরবী কাঁপে সন্ধ্যার—
কুসুম ও তার না ফোটাটুকু
তোমাকে মনে পড়বে না—
অস্থিমূলসহ ভুলে যাব সবকিছু—
ঘূর্ণি-আকাশ গত শ্রাবণ-তামায়
চলে যাওয়ার থেকেও যেন অধিক যাওয়ায়
পড়ে থাকছে পথে—এই হেমন্ততে সমকামী তারাদের
সাথে অনেক কথা হলো আমাদের মনে—
পরিকল্পনা নিয়ে কত ভাঙা পরিবার
আজ যাচ্ছে ভেসে দীনহীন ভরা ড্রেনে
সাথে অনেক কালের আগে শাদা চিঠিটাও—
একা বসন্তও রোদে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ছাউনি দেওয়া
বাসযাত্রীর সাথে—
সেই দৈবচয়ন গেছে ধুলা হয়ে কবে—!
স্মৃতি-অধ্যুষিত এই খর জঙ্গলে—যেন গভীর রাতে মৃত চোখের ওপর
টানে কুয়াশা ও স্মৃতি ফাঁকা রোডের ওপর কোনো লাশবাহী ট্রাক
যায় তারার দিকে—পাশে ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছোট মসজিদ
তার টিউবয়েলের থেকে চুয়ে পড়ছে বিষাদ—
যেন উনিশ শতক মরে ভূতটুত হয়ে শুয়ে পড়েই আছে ওই লাশবাহী ট্রাকে—
তারা জ্বলেই আছে রাত-আকাশের তীরে
যেন ভোটটা দিতে না পারার মতো
ব্যথা-বেদনা নিয়ে এক চায়ের পোড়া
ছোট স্টলে দাঁড়িয়ে
অভিশাপটিও দিতে না পারতে থাকায় শুধু তাকিয়ে আছে ওড়া পাখির দিকে—
তোমাকে মনে পড়বে না—
অস্থিমূলসহ ভুলে যাব এই সব—
প্রণয়ের মতো যা দেখতে ছিল ব্যক্তির গত সব আলাপ-বিলাপ
যেন হতে হবে তোমাকেও কূট সামাজিক
তবু ফুল ফোটারও অধিক ঝরে যায়—কী যে শ্লেষ!
সেই যে কুসুম, না ফোটাটাও ফুল!
কথা
যখন তুমি বলতে এলে কথা—
হারিয়ে বালার
সুগোল হাওয়া
ছাঁচ দুখানি
টলমলে সব রোদের বাথান
মোষের চোখের
তৃষ্ণা নিয়ে
পার হয়ে যায়
গ্রীষ্মরথের কামারজানি
বেপথু এক
ঝরার পাতা
পড়ল শেষে
রাস্তাঘাটের
অমর ধুলায়—পথিক যত
ছলকে ওঠা
কাদার ভয়েও
নড়ল না কেউ আলস্যত
তখন কুরু-
ক্ষেত্র যেন দূরের হাওয়া
যেদিক দেখি—
সবই লাগে ফ্যাসিস্ট মতন
কে যেন তার
বলার কিছু হাজির করে
কণ্ঠস্বরে:—
বিলের নিষাদ—স্বৈরাচারী
বাউল-মাটি—স্বৈরাচারী
বকুল-আতপ—স্বৈরাচারী
কোকিল-বেহাগ—স্বৈরাচারী
গণ যে তার তন্ত্রসহ
হারিয়ে ফেলে
গভীর কোনো
আকাক্সক্ষাতে
চালতা ফুলের
বদল ঘটে
ফুটছে পুলিশ
ভোরের সাথে
যখন তুমি বলতে এলে, নারী—
শহরজুড়ে
নীরবতার
দারুণ আহাজারি
কোথাও তুমি ধলেশ্বরী তীর—
বাজ পড়ছে ঢেউয়ের ওপার গ্রামে
ক্রসফায়ারের শব্দে নড়ে পাতা
কার মেয়েটা কাঁদছে মধ্যযামে—!