রামিন জাহানবেগলো তেহরানে জন্ম নিয়েছে। পড়েছেন প্যারিসে শোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি দার্শনিক হিসেবে তো বটেই এছাড়াও রাজনৈতিক লেখা-লেখির জন্য সুপরিচিত। তিনি মূলত পশ্চিমা দর্শন ও আধুনিকতার সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। বিখ্যাত চিন্তকদের সাথে তার সাক্ষাৎকারের একাধিক বই রয়েছে। সম্প্রতি সভ্যতা ও মতাদর্শ নিয়ে তিনি কাজ করছেন।
“বর্তমান জমানায় গণ-বুদ্ধিজীবীরা প্রায় বিপন্ন একটি প্রজাতি। এমন অবস্থা ‘মানব মর্যাদা’ রক্ষার লড়াকুদের ‘মানব চিত্তে শ্রেষ্ঠ বীর’ হওয়ার অর্থ কি দাঁড়াবে তাহলে?” গুরুত্বপূর্ণ এই প্রবন্ধটি তিনি সাম্প্রতিক অবস্থায় গণবুদ্ধিজীবীদের হালচাল নিয়ে লিখেছেন। এই প্রথম তার কোন লেখা বাংলাতে অনুবাদ করা হলো। জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন, উম্মে সালমা
গোটা বিশ্বে যখন বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হয়, তখন বিশেষভাবে ভারতের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়। ভারতের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের অবদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারতীয় একাডেমিতে গণতান্ত্রিক যোগসূত্র এবং সমালোচনামূলক মনোভাব গঠন এবং সংরক্ষণে ভারতীয় গণ-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করাই কেবল যথেষ্ঠ নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক ও নৈতিকতার উৎকর্ষ সাধনে এবং নাগরিকদের মধ্যে শক্ত বন্ধন তৈরিতে কি কি ভূমিকা অবশ্য পালনীয়— এই দিকগুলো নিয়ে এবং সেই কাজে গণ-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়েও আলোকপাত করতে হবে।
তবে যাই হোক, এসকল ভূমিকা বাস্তবায়ন করার জন্য ভারতীয় গণ-বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহ্যগত ধ্যানধারণা যেমন: সর্বদা ইতিবাচক মনোভাব, নিঃস্পৃহ পাণ্ডিত্য, এবং কৌশলগত নেতৃত্বের সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হবে।
সৌভাগ্যবশত, কতিপয় উল্লেখযোগ্য ভারতীয় বুদ্ধিজীবী -যেমন রোমিলা থাপার, আশীষ নন্দী, দীপঙ্কর গুপ্ত, অরুন্ধতী রায় এবং বিক্ষু পারেখ —এরা সবসময়ই ভারতীয় জনগণের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা প্রকাশ করেন। এবং সেই সাথে তারা গণতান্ত্রিক বিরোধ এবং নাগরিদের মধ্যে প্রশ্ন উস্কে দেন। প্রতিবাদের ধারাকে অনেক বেশি জোরালো করে তুলে ধরেন। আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে ‘বুদ্ধিজীবী’কে সংজ্ঞায়িত করার সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান হলো বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা এবং ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ধারাটি।
বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতন
১৯৩৮ সালে টমাস ম্যান নাৎসি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ইউরোপ ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। এই সময়ে নিউ ইয়র্ক পত্রিকায় তার আগমনের উপর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যেখানে আমার অবস্থান, সেখানেই জার্মান সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান।” আজকে, এই চলমান পরিস্থিতিতে যদি কেউ টমাস ম্যানের পদচিহ্ন অনুসরণ করে, তবে তার বলার যথার্থ অধিকার আছে, “যেখানে আমি অবস্থান করি না কেন, সেখানেই মানব সংস্কৃতি এবং মানব মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।” কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আজকের রাজনৈতিক বর্বরতা এবং সংঘাতের (Trumpization of politics) এই যুগ টমাস ম্যানের জমানা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বলেই মনে হচ্ছে।
এই একবিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা বিচ্ছেদ প্রতীয়মান হয়। কদাচিৎ হাতে গোনা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলাদা কিছু গুণাবলি থাকে। বর্তমানে কোনো বুদ্ধিজীবীকেই আর ‘মানসপটে অতি মানব’রূপে আখ্যায়িত করা যায় না। তবে সহজ ভাষায় এদেরকে ‘সমালোচনামূলক ভাববাদী’ বলা যায়। যারা নিত্যনৈমিত্তিক জীবনযাপনের উর্ধ্বেও অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করেন। বর্তমানে, এই খুতদর্শী বুদ্ধিজীবীরা একটি বিপন্নপ্রায় জাতি। আজকের জমানায় এই বুদ্ধিজীবীদের একধরণের রাজনৈতিক আতঙ্ক গ্রাস করছে এবং সর্বদা মনে হয়, এর বিপরীত স্রোতের রাজনৈতিক নেতাবৃন্দের মধ্যেও ভয়ানক নির্লিপ্ততা বিরাজ করছে। এর ফলে এদেরকেই ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে সম্বোধন করা যেতে পারে। যারা রাজনৈতিক ভাবে দরকারি হয়ে ওঠেন।
বুদ্ধিজীবীগণ জনসাধারণের কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার কথা বলার নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন কি তারা চিন্তাবিদ এবং প্রবক্তা হিসেবে নিজেদের স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উপস্থাপন করতে অসমর্থ হয়ে উঠছেন।
অনেকেই এই ব্যাপারটিকে বুদ্ধিজীবীদের পতন হিসেবে দেখছেন। এই পতনকে ক্রমবর্ধমান পেশাগত, কর্পোরেট জগৎ এবং স্বৈরশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের দূরত্বকে আরো জোরালো করার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়,বুদ্ধিজীবীগণ জনসাধারণের কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার কথা বলার নৈতিক বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন কি তারা চিন্তাবিদ এবং প্রবক্তা হিসেবে নিজেদের স্বাধীন এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উপস্থাপন করতে অসমর্থ হয়ে উঠছেন। জনসাধারণ এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করার পদক্ষেপগুলোকে রাজনৈতিক আলাপনে নৈতিক বিধিবিধানকে বিবেচনা না করে, কেবল সর্বসাধারণের উদ্দেশ্য এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে বার বার আলোচনা করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এই যেমন, আজকের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে মনে হয় বুদ্ধিজীবীরা সকল নৈতিক সত্যকে আপেক্ষিক বলেই ধারণা করেন। এবং তারা মনে করেন, এই নির্বাক, প্রতিরোধহীন জগতে নৈতিক কন্ঠে আওয়াজ তোলার কোনো প্রয়োজন নেই। কর্মজীবনের বিশেষ চাহিদাগুলোকে আমাদের বিশ্বের মানবিক আকাঙ্ক্ষার সাথে সমন্বয় সাধনের উপায় হিসেবে জনসাধারণের নৈতিক বিবেচনাবোধকে বর্জন করাই দূরদর্শিতার পরিচয় এবং এটিই রাজনৈতিকভাবে বিশুদ্ধ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য একাডেমিক এবং অন্যান্য পেশাদারি বুদ্ধিজীবীরা দ্ব্যর্থহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।
বেতনভোগী, মেয়াদপূর্ণ, অবসরপ্রাপ্ত এরকম অনেক বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের একটি সম্মানজনক পেশার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে ভালোবাসেন। যার ফলে অ-প্রতিকূল প্রেক্ষাপটের আলোকে তাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ মন-মানসিকতা তৈরি হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, এই সংকীর্ণ পেশাদারি স্বার্থপরতা বুদ্ধিজীবীদের তথাকথিত গণ স্বার্থপন্থী মনোভাব ধ্বংস করে দিয়েছে। দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিতভাবে, তাদের নৈতিক এবং রাজনৈতিক দায়দায়িত্ব ভুলে যাওয়া, আজকের বিশ্বের অনেক বুদ্ধিজীবীরাই অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং জনহিতকর এই ধারণাটিকে পরিত্যাগপূর্বক গণ সংস্কৃতির নিঃস্পৃহ বা উদাসীন সমর্থক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছে।
আধুনিক এই জমানায় যেখানে বাজারের অর্থনৈতিক আইন বা বিশ্বজুড়ে সরকারবৃন্দের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো মূল আলোচ্য বিষয় সেখানে আজকের মিডিয়া পাড়ার সেলিব্রিটিদের মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করার আর কোনো রুচিবোধ থাকে না।
জনগণের সমালোচনাবিহীন এবং উদাসীন মানসিকতার কারণে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিশেষজ্ঞবৃন্দ এবং গণমাধ্যমের পণ্ডিত ব্যক্তিরা বুদ্ধিজীবীদের সমাজতান্ত্রিক অভিনেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। আধুনিক এই জমানায় যেখানে বাজারের অর্থনৈতিক আইন বা বিশ্বজুড়ে সরকারবৃন্দের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো মূল আলোচ্য বিষয় সেখানে আজকের মিডিয়া পাড়ার সেলিব্রেটিদের মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করার আর কোনো রুচিবোধ থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিডিয়া নেটওয়ার্ক এবং প্রযুক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থা কর্তৃক প্রভাবিত শিল্প-পরবর্তী গ্লোবাল ভিলেজের উত্থানের কারণে সমালোচনামূলক প্রতিবাদী কন্ঠগুলো চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়। যাকে বলা হয় ‘অচলাবস্থার মহামারি’ এবং এটি সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধিজীবীদের জটিল এবং সমালোচনামূলক প্রশ্নসমূহকে অসাড় এবং ধ্বজভঙ্গ করে দিয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, ‘বুদ্ধিজীবী’ একটি জটিল এবং সমস্যাগ্রস্ত ধারণা এবং এই শ্রেণিটিকে সংজ্ঞায়িত করা যথেষ্ঠ কঠিন। তবে যাইহোক, এই একবিংশ শতাব্দীর আলোকে যখন বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, প্রথমে আমাদের ইতিহাসের পাতায় বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করতে হবে। বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে, ‘বুদ্ধিজীবী’ এই শ্রেণীটির একটি সামাজিক এবং ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য থাকে যার উদ্ভব ঘটে একটি সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে। তবে একই সাথে এটি একটি পাবলিক ফাংশন যা সার্বজনীন চেতনার সাথেও সম্পর্কযুক্ত।
বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বজনীন কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে ‘বুদ্ধিজীবী’ এবং ‘শিক্ষাবিদ’ এর মাঝে সহজেই পার্থক্য নিরূপণ করা যায়। এছাড়াও, বুদ্ধিজীবীদের ফোকাস শুধুমাত্র তাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার উপরেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বজনীন সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যেও তারা কাজ করে থাকেন।
সুতরাং, সাধারণত, অর্থ, যথার্থতা এবং বৈধতার উপর ভিত্তি করে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্নগুলো রচিত হয়। এক্ষেত্রে, সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, সমাজ বুদ্ধিজীবীদের জন্য একটি উন্মুক্ত জায়গা যেখানে সক্রিয় এবং নিরবচ্ছিন্নতার সাথে বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন করতে পারবে। এবং এমনভাবে তারা প্রশ্ন করবে যাতে সর্বদা স্বাধীন, ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষতা, এবং সমতার ভিত্তিতে প্রশ্নগুলো নতুন রূপে উত্থাপিত হতে পারে এবং কখনো আপোষ করা যাবে না।
প্রথম বুদ্ধিজীবী
এটা আমাদের জন্য কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, একজন বুদ্ধিজীবীর প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উদ্ভব হয়েছিল। আর তিনি হলেন সক্রেটিস। এথেন্সের একজন দার্শনিক যার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করা হয়েছিল। সক্রেটিসকে মানবতার ইতিহাসে প্রথম বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভাবা হয়। যাকে ভীড়ের মধ্য থেকেও অন্য সাধারণ এথেন্সের বাসিন্দাদের থেকে বিশেষ করেই আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেত। তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কেননা তিনিই প্রথম গ্রীক পুরাণ এবং এর ধারণাসমূহকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে আলাদা দূরত্ব রচনা করেন।
সক্রেটিসের প্রধান অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল তার সময়ের প্রশাসন এবং ধর্মীয় গুরুদের কর্তৃত্ব এবং স্বৈরাচারের প্রচলিত রীতিনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। যেমন, সক্রেটিস কেবল সাধারণ একজন দার্শনিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিরোধীমতের দার্শনিক। সর্বকালের বুদ্ধিজীবীদের তাত্ত্বিক এবং অস্তিত্ববাদী ধারণার মূল বৈশিষ্ট্য হলো ‘ভিন্নমত’ (dissent)। যদিও ‘বুদ্ধিজীবী’ —এই শব্দটি সম্পর্কে আজকে যে আমরা অবগত, এটি মানব ইতিহাসে অনেক পরে সম্পৃক্ত হয়েছে। সমগ্র ইতিহাসে দেখা যায়, বুদ্ধিজীবীদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা, মতবিরোধীমূলক আচরণ বিশেষ করে স্রোতের বিপরীতে চলা এবং এক প্রকারের বিদ্রোহী মনমানসিকতা।
সমগ্র ইতিহাসে দেখা যায়,বুদ্ধিজীবীদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা, মতবিরোধীমূলক আচরণ বিশেষ করে স্রোতের বিপরীতে চলা, এবং এক প্রকারের বিদ্রোহী মনমানসিকতা।
অন্যভাষায় বলা যায়, সমালোচনামূলক প্রশ্ন তৈরি করা বুদ্ধিজীবীদের যথার্থ কর্ম। তাদের শুধুমাত্র প্রশ্ন করার সামর্থ্য থাকলেই চলবে না, সেইসাথে প্রচলিত ধারণাগুলো নিয়ে তাদের যথেষ্ঠ সন্দেহপ্রবণও হতে হবে।
উনবিংশ শতকে ফ্রান্সের ড্রেফাস এফ্যায়ারের (যাকে ১৮৯৪ সালে জার্মান সৈনিকদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল) হাত ধরে এই ‘বুদ্ধিজীবী’ এই শ্রেণিটির ‘গণ’ ভূমিকার কিছুটা ভিন্ন ব্যাখ্যা সংযোজনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি লাভ করে। ড্রেফাসের সময়ে বুদ্ধিজীবীদের ভিতরে মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও এই ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সকলেই একমত প্রকাশ করেন। তবে এমিলি জোলার মতো একজন বুদ্ধিজীবী যে কি না ড্রেফাসের ধ্যানধারণাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখলেন। জোলার পুস্তিকা জ্যাকুস(J’accuse) এ অসংখ্য লেখকবৃন্দ, শিল্পীগোষ্ঠী, সাংবাদিকবর্গ এবং শিক্ষাবিদদের কঠিন সমালোচনা করা হয়েছে যারা সম্মিলিতভাবে ‘ইস্তেহারে’(Manifesto) এ স্বাক্ষর করেন এবং ড্রেফাসকে নির্দোষ এবং অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েছিল বলে দাবি করেন।
শুধুমাত্র স্বতন্ত্র চিন্তাবিদ হিসেবে নয়, এই বুদ্ধিজীবীরা মানবতার গণ সেবক হিসেবেও প্রতীয়মান হন। এরা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাহিরেও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাকে সমর্থন করেন। তারা ব্যক্তিগত এবং বহির্গত জীবনে অবিরাম ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন। এইজন্যই বলা হয়ে থাকে, আদর্শের প্রতি একজন বুদ্ধিজীবীর অঙ্গীকার অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে এবং সমাজের প্রতি থাকে অবিচল সম্মান। এভাবেই একজন বুদ্ধিজীবী নিজেকে সমাজের পরিবর্তনশীল ধারার সাথে সম্পৃক্ত করেন যেখানে নৈতিক রীতিনীতির সাথে সত্যের মেলবন্ধন ঘটে। আর এভাবেই বুদ্ধিজীবীরা সমাজের নৈতিক বিবেকরূপে আবির্ভূত হন।
চিন্তাভাবনা করা বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম প্রধান একটি কাজ। তবে বিদ্রোহী মনোভাব, প্রচলিত অনিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা এবং মতবিরোধিতা ছাড়া কি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি? মার্টিন হেইদেগার লিখেছিলেন, “সবচেয়ে চিন্তা-উদ্রেককারী বিষয় হলো আমাদের এই চিন্তা-উদ্রেককারী যুগ। কিন্তু আমরা চিন্তাই করছি না।” তিনি আরো বলেন যে, চিন্তাশীলতার অর্থই হলো জিজ্ঞাসাবাদ করা। এবং এই মহাবিশ্ব এবং নিজের সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু মনে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সহজ ভাষায়, প্রকৃতপক্ষে যিনি প্রশ্ন করেন তিনিই মূলত প্রশ্নগুলোকে সংরক্ষণ করেন। এই জিজ্ঞাসাবাদ আমাদের স্বাধীনতাকে কেবল সুরক্ষিত করে না, আমাদের বিদ্রোহী হবার প্রয়োজনীয়তাকেও তুলে ধরে। চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ মানেই হলো স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান করা। সক্রেটিস থেকে শুরু করে প্রতিটি গণ-বুদ্ধিজীবীর ঐতিহ্য হলো নাগরিক স্বাধীনতার সমর্থক এবং অভিভাবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা।
আসুন তবে আজকের জমানায় গণ বুদ্ধিজীবীরা কিসের পক্ষে দাঁড়াতে এবং লড়তে চায় সে সম্পর্কে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করি। নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিজীবী এবং অভিজাত বুদ্ধিজীবী প্রায় একই শ্রেণির যারা যথাসময়ে বুদ্ধিজীবী শব্দটির সদ্ব্যবহার করতে পারে না
শেষাংশ
আসুন তবে আজকের জমানায় গণ বুদ্ধিজীবীরা কিসের পক্ষে দাঁড়াতে এবং লড়তে চায় সে সম্পর্কে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করি। নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিজীবী এবং অভিজাত বুদ্ধিজীবী প্রায় একই শ্রেণির যারা যথাসময়ে বুদ্ধিজীবী শব্দটির সদ্ব্যবহার করতে পারে না। বিশেষ করে যখন তারা সম্মিলিতভাবে সার্বজনীন সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার অভিপ্রায়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যান। যাইহোক, গণ-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাবের ফলে বুদ্ধিজীবীদের যখন দলীয়করণ করা হয়, তাদের সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন গুণগুলো গায়েব হয়ে যায় এবং সেই সাথে ‘গণ’ বলতে আমরা যা বুঝি সেটারও গুণগত মানের অবনতি ঘটে। বর্তমানে, বুদ্ধিজীবীরা এখন আর পৃথিবীর উদারপন্থী কূটনীতি এবং বিশ্বব্যাপী সমাদৃত শাসকগোষ্ঠীর বিপরীতে কঠিন সমালোচনায় লিপ্ত হন না। এবং তারা ‘সেলিব্রেটি সংস্কৃতির’ একজন অভিনেতা মাত্র। তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। সাংস্কৃতিক জীবনের গতানুগতিক ধারার প্রভাবের ফলে এই বুদ্ধিজীবীরা একটি অর্থহীন মেরুদন্ডে পরিণত হয়েছেন। এরা বিভিন্ন সংগঠনগুলোতে তাদের আশ্রয়স্থল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এবং পুরো বিশ্বের চারপাশকে মারণাস্ত্র দ্বারা আবৃত কল্পনা করছেন। যেখানে কোনো বিষয়ের উপর কথা বলারও নৈতিক বৈধতা তাদের নেই।
এই যুগটি হলো ‘রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের’ (Trumpization of politics) যুগ। অজ্ঞতা, ঔদ্ধত্য —এইসবের ভরপুর একটি যুগ। যে যুগে সুযোগসন্ধানী এবং অপরিমিত ভাষী রাজনৈতিক নেতাবৃন্দের উত্থান ঘটেছে। যাইহোক, এসকল নেতৃবৃন্দের আবির্ভাব জনগণের আস্থা এবং প্রবৃত্তি নিঃশেষ হয়ে যাবার মতো কোনো উপসর্গ নয়। তবে সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে এখন আর দেখা যায় না। তাদেরকে অবশ্যই সমাজকে ঘিরে নতুন কাল্পনিক রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে এবং তাদের চিন্তাভাবনার জগতে যথেষ্ঠ পরিবর্তন আনতে হবে। মানবতার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে এই গণ-বুদ্ধিজীবীদের আপোষহীন, অবিচল যোদ্ধা হবার এখনই উপযুক্ত সময়।