বিদায় সালা

বিদায় সালা

স্বপ্নের পথে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছিলেন। স্বপ্ন তার আগামীর আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় মেসি হওয়া। বড় হওয়ার স্বপ্নে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কঠোর পরিশ্রমকে সঙ্গী করেই। ট্রাক ড্রাইভার বাবার সংসারে থেকে বড় হওয়া ছেলেটি অবশেষে পেলো কঠিন পরিশ্রমের স্বীকৃতি। ফ্রান্স থেকে সরাসরি সুযোগ মিলল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার। স্বপ্নের সিঁড়িকে পায়ের নিচে পেয়ে যেন উড়ছিল ছেলেটি। কিন্তু উড়ে বেড়ানো ছেলেটির যে আর ধরায় দেখা মিলবে না, কে-ই বা ভেবেছিল! কথা হচ্ছে এমিলিয়ানো সালাকে নিয়ে। উড়তে উড়তেই যিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কার্ডিফ সিটির হয়ে আর খেলা হলো না এই আর্জেন্টাইন তারকার। ইংল্যান্ড পৌঁছানোর আগে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া হলো না ২৮ বছর বয়সী এই তারকার।

এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৬ সালের শেষের দিকে ব্রাজিলের শাপোকোয়েন্স ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড়দের নিয়ে ভয়াবহ বিমান  দুর্ঘটনার খবরে কেঁদেছিল সারাবিশ্ব। ১৯৫৮ সালে প্রায় নয়জন প্রতিভাবান ফুটবলার নিয়ে বিধ্বস্ত হয় ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার  ইউনাইটেডের বিমান। ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সেনেগালের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন জাম্বিয়ার জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। এবার সেই মর্মান্তিক ঘটনার ধারাবাহিকতাতেই আর্জেন্টিনার ফুটবলার নিয়ে নিখোঁজ হলো একটি বিমান। লিস্টার সিটির মালিক ভিচাই শ্রীবদ্ধনাপ্রভা পড়েছিলেন বিমান দুর্ঘটনায়। তার মৃত্যুর ঘটনাই এখনো ফিকে হয়নি। এরমধ্যেই ফুটবল বিশ্বকে আবার ভুগতে হলো সালার দুর্ঘটনার খবরে। উদ্ধারকার্যে ব্যর্থতা প্রমাণ করে, এখন আর বেঁচে নেই সালা।

১৯৯০ সালের ৩১ অক্টোবর আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন সালা। ট্রাক ড্রাইভার বাবার সংসারে থেকে ছোটবেলায়ই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। দারুণ সম্ভাবনাময় এই তরুণ গ্রানাডায় থাকার সময় ২০০৯ সালে পর্তুগিজ অঞ্চলের একটি দলে খেলার জন্য আমন্ত্রণ পান। যেখানে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় ছিলেন। ওখানে তিনি ভালোই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি ক্লাবটি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্লাবটি ছেড়ে তিনি আর্জেন্টিনা চলে আসেন। আর্জেন্টিনার যুব দল ও পর্তুগালের আঞ্চলিক লিগে খেলার পর ২০১২ সালে সালা নিজের প্রফেশনাল ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন ফ্রান্সে। বেশ সংগ্রাম করেই সামনের পথ পাড়ি দেন এই ২৮ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন। ফ্রান্সের বিভিন্ন ক্লাবে লোনে খেলতে থাকেন এই প্রতিভাবান। ২০১৫ সালে সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পান। ফ্রান্সের নঁতে পাকাপাকিভাবে যোগ দেন সালা। মূলত এখানেই নিজেকে দারুণভাবে প্রকাশ করে কার্ডিফ সিটির নজরে পড়েন তিনি। নঁতে ১২০ ম্যাচ খেলে ৪২ গোলের দেখা পান এই উঠতি তারকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কার্ডিফ রেকর্ড প্রায় ১৮ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভেড়ায় সালাকে।

ফ্রান্সকে বিদায় জানিয়ে কার্ডিফের পথে যাত্রা করে সালাকে বহণকারী বিমানটি। ২১ জানুয়ারি, সোমবার রাতে ফ্রান্স আর কার্ডিফের মাঝে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের সময় রাউডারের বাইরে চলে যায় বিমানটি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল বলছে, গত মঙ্গলবার দীর্ঘ সময় চ্যানেল আইল্যান্ডের ১১,৫০০ স্কয়ার মাইল জুড়ে তল্লাশি চালালেও বিমানের কোনো  ধ্বংসাবশেষ বা মৃতদেহের হদিস পায়নি স্থানীয় পুলিশ। পাঁচটি বিমান ও দুইটি লাইফবোট দিয়ে উদ্ধারের জন্য অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কিন্তু কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শোকের মাঝে সালার অডিও রেকর্ড কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে বিমানে থেকেই তরুণ এই খেলোয়াড় ভীত কণ্ঠে জানিয়েছিলেন ঘন্টা খানেকের মধ্যে তার কোনো বার্তা পাওয়া না গেলে তাকে যেন উদ্ধার করা হয়। ব্যর্থ চেষ্টা করে উদ্ধারকারীরা এখন ক্ষান্ত দিয়েছেন। মোটামুটি নিশ্চিত পানিতে তলিয়ে গেছে সালাসমেত বিমানটি।

এদিকে, ১৭ মিলিয়ন ইউরোতে নঁতে থেকে কার্ডিফ তাকে দলে টেনেছিল। একদিনও দলটির হয়ে মাঠে নামতে পারেননি সালা। স্বাভাবিকভাবেই দলটির বিশাল অঙ্কের ক্ষতি হয়ে গেল। টাকার ব্যাপারে কি ভাবছে কার্ডিফ? তারা কি নঁতেকে টাকাটা পরিশোধ করবে? ট্রান্সফার ফির প্রথম কিস্তি হিসেবে ৬ মিলিয়ন ইউরো নঁতেকে দেয়ার কথা ছিল কার্ডিফের। কিন্তু আপাতত ব্যাপারটি তারা স্থগিত রেখেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘টেলিগ্রাফ’ জানিয়েছে, সালার ফ্রান্স থেকে কার্ডিফে আসার পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নয় কার্ডিফ সিটির কর্তাব্যক্তিরা। এক ইঞ্জিনের পুরনো বিমানে আসার ব্যাপারটি ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে কার্ডিফের কর্মকর্তাদের মাঝে। এমনকি সালার এই বিমানে ভ্রমণ সম্পর্কে তারা কিছুই জানত না। শোনা যাচ্ছে বিমান যিনি চালিয়েছেন তিনি প্রফেশনাল বিমান চালক তো দূরের কথা, বিমান চালানোর তেমন অভিজ্ঞতাও নেই তার। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে তাই কার্ডিফ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থের ব্যাপারে সমঝোতায় আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও স্বপ্নকে ছুঁয়ে দিতে পারলেন না সালা। তার আগেই সবকিছুর হলো সলিল সমাধি। হারিয়ে গেলেন পায়ের জাদু দিয়ে ফুটবল বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করার আগেই। যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন সালা।