মিশেল আলেক্সান্ডার মার্কিন নাগরিক। নিউ ইয়র্ক টাইমস’র কলামিস্ট। নাগরিক অধিকার বিষয়ক একজন আইনজীবি। নিউ ইয়র্ক টাইমস ছাড়াও নিয়মিত লেখেন ওয়াশিংটন পোস্ট, হাফিংটন পোস্ট, দ্যা নেশন, দ্যা লস এঞ্জেলেস টাইমস-সহ নানা আন্তর্জাতিক পত্রিকায়। নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এই আলোচিত কলামটি জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন, মাশকুর রাতুল।
১৯৬৭ সাল, এপ্রিলের ৩ তারিখ। মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, ম্যানহাটনের নদীর পাড় ঘেঁষা গির্জায় একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার সেই অগ্নিঝরা বক্তব্যগুলোর একটি বক্তব্য সম্প্রতি খুব আলোচনায় এসেছিল। তখন মাত্র দুই বছর গত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সাথে সক্রিয় যুদ্ধে লিপ্ত। লক্ষ মানুষ মরছে, দশ হাজার সেনা নিহত। ডান-বাম সবপন্থাই ঐ যুদ্ধে উৎসাহী। চল্লিশ হাজার সেনা তখনও ভিয়েতনামে। তাদের জীবন তখনো মৃত্যুর কাঁটাতার ছুঁই ছুঁই করছে।
লুথার কিং’র মিত্ররাও তাকে যুদ্ধের সমালোচনা করতে নিষেধ করতো। কিন্তু তাতে সমালোচনা থামতোনা। এরপর নরম সুরে সমালোচনা করার উপদেশ আসতে লাগলো। তার মিত্ররা জানতো, তার সমালোচনা থামানো কঠিন। তবে এই সমালোচনায় তাকে মিথ্যা অপবাদ দিবে। তাকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এতে লুথার কিং’রই ক্ষতি ছিল। তাকে প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ করা হত। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলে সমর্থন কমে আসতো। সর্বোপরি নাগরিক আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ত।
নরম সুরে সমালোচনা করার উপদেশ আসতে লাগলো। তার মিত্ররা জানতো, তার সমালোচনা থামানো কঠিন। তবে এই সমালোচনায় তাকে মিথ্যা অপবাদ দিবে। তাকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এতে লুথার কিং’রই ক্ষতি ছিল। তাকে প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ করা হত। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলে সমর্থন কমে আসতো। সর্বোপরি নাগরিক আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ত।
সকল ভয় ও উপদেশ উপেক্ষা করে গির্জায় সে ভাষণে গর্জে উঠলেন লুথার কিং। বললেন, “আমি মহান এই প্রার্থনাগারে এসেছি। আমার বিবেক আমাকে বিকল্প কোন সুযোগ দেয়নি। ভিয়েতনাম সম্পর্কে ক্লার্গার এবং লেম্যানের একটি বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “এমন সময় আসে যখন নিরাবতা মানেই বিশ্বাসঘাতকতা।” তিনি আরো বলেন, “ভিয়েতনামের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপনের সময় এসেছে।”
এটি ছিল তার নৈতিক অবস্থান। যদিও নিঃসঙ্গ। এর চড়া মূল্য তাকে দিতে হয়েছে তাকে। তবে লুথার কিং’র ঐ অবস্থান এখনো আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে আছে। তিনি দেখিয়ে গেছেন যে নিজের স্বার্থ আর ভালো থাকাকে উপেক্ষা করে নিজের বিবেক ও মূল্যবোধকে মূল্যায়ন করা কতটা জরুরি। ঠিক এই উপলব্ধিটা আমার হয় যখন আমি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ভাবি। সামান্য স্বার্থ আর সম্পর্কের খাতিরে আমি নিরব আছি। চোখ বন্ধ করে আছি। নইলে এত অমানবিকতা চোখে পড়ছেনা কেন? এই নিরাবতাই যে আমাদের সবচেয়ে বড় নৈতিক চ্যালেঞ্জ।
আমি একা ছিলাম না। তবে ইদানিং দেখছি, পুরো কংগ্রেস নিরব হয়ে আছে। ঐ ভূমিতে দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহভাবে ধ্বংস হচ্ছে মানবতা। মানবাধিকার। কংগ্রেস নিশ্চুপ। যাদের দায়িত্ব আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ ঠিক করা। দেশ পরিচালনা করার জন্যই তারা নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হয় আমাদের ভোটে। তবে তাদের দালালি সর্বদা ইসরায়েলেরই পক্ষে। যার দালিলিক প্রমাণও রয়েছে। ইসরায়েলের সমালোচনা করতে তারা সর্বদাই কুণ্ঠাবোধ করে। ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন দিনদিন নির্লজ্জ নগ্নতা নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এদিকে ফিলিস্তিনে চলছে একই রকমের জাতিগত নিপীড়ন যা দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়েছে এবং স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রে জিম ক্রো আইন যার বিরোধিতা করে থাকে।
যে নিজের স্বার্থ আর ভালো থাকাকে উপেক্ষা করে নিজের বিবেক ও মূল্যবোধকে মূল্যায়ন করা কতটা জরুরি। ঠিক এই উপলব্ধিটা আমার হয় যখন আমি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ভাবি।
শুধু রাজনীতিবিদই না এই বিষয়ে নিরব রয়েছে অনেক মানুষ ও নাগরিক অধিকার কর্মী। এমন না যে তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত না কিংবা ফিলিস্তিনবাসীদের জন্য তাদের সহমর্মিতা নেই। তারা চুপ কারণ তাদের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাবে। তারা চুপ কারণ তাদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষী অপবাদ দেয়া হবে। এই বিষয়ে তারা চিন্তিত। আমিও চিন্তিত ছিলাম। তারা ভাবে একবার তারা এই বিষয়ে মুখ খুললে সবাই ভাববে তারা ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে।
এদিকে ছাত্ররাও এই বিষয়ে মুখ খুলতে পারছে না। পারছে না ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে। যারাই আজ পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে তাদেরকেই আনা হয়েছে নজরদারির আওতায়। ক্যানারি মিশন’র মাধ্যমে তাদের উপর করা হচ্ছে গোপন নজরদারি। এই নজরদারির মাধ্যমে তাদের ইহুদিবিদ্বেষ যাচাই করা হয়। যারা ফিলিস্তিনের পাশে থাকবে এবং তাদের নজরদারিতে আসবে তাদের ভবিষ্যৎ হবে ক্যারিয়ার শূন্য।
লুথার কিং’র মৃত্যুর ৫০ বছর পরে নদীর পাড়ে তার সেই ভাষণ আমি পড়ছি। উপলব্ধি করছি। তার সময়কার ভাষণটা এখনও প্রযোজ্য। আমাদেরকে কঠোরভাবেই কথা বলতে হবে মানবতার পক্ষে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। ফিলিস্তিনে যে অবিচার চলছে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। সব ভয় এবং জটিলতাকে উপেক্ষা করেই আমাদের এই মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই শুরু করতে হবে। ভিয়েতনাম ইস্যুতে কিং বলেছিলেন “যখন পরিস্থিতি আমাদের হাতে থাকে তখন আমরা হতবুদ্ধি হই আর মর্মান্তিক যুদ্ধকে আরো বাড়িয়ে দেই। অনিশ্চিয়তায় হতভম্ব হলে চলবেনা। আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকবেই কিন্তু আমাদের সাম সামর্থ্য’র মাঝে থেকেই মানবতার পক্ষে আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে।”
লুথার কিং’র কথাকে আমাদের সমর্থন করতে হবে। সন্মান করতে হবে। আর তাই এখনই সময় ইসরায়েলের সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। ইসরায়েল নির্মমভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে, ওয়েস্ট ব্যাংক বা পশ্চিম তীর দখল করছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে ঘর জ্বালিয়ে নির্মমভাবে মানবতা হত্যা করছে। আমাদের এখন মুখ খুলতে হবে। কথা বলতে হবে ফিলিস্তিনিদের অবাধে চলাফেরার অধিকারের জন্য, বাড়িতে, গ্রামে গ্রামে অনৈতিক তল্লাশি বন্ধ করা নিয়ে, বাড়ি, হাসপাতাল, স্কুলে যাতায়াতের ব্যাবস্থা নিয়ে আওয়াজ দিতে হবে আমাদের।
যখন পরিস্থিতি আমাদের হাতে থাকে তখন আমরা হতবুদ্ধি হই আর মর্মান্তিক যুদ্ধকে আরো বাড়িয়ে দেই। অনিশ্চিয়তায় হতভম্ব হলে চলবেনা। আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকবেই কিন্তু আমাদের সাম সামর্থ্য’র মাঝে থেকেই মানবতার পক্ষে আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে
ফিলিস্তিনবাসীর অধিকার নিয়ে কথা বললেই, তাদের ঘরবাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা আসলেই অস্বীকার করে ইসরায়েল। তারা ফিলিস্তিতিদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ইসরায়েলের এমন কাজ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। মোটেও না। জাতিসংঘের প্রস্তাবনা মতে ইসরায়েলকে সব মেনে নিতে হবে। আমাদের আরও প্রশ্ন তুলতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রতি। কেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে তারা আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে? কেন এই নির্মমতাকে সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকার সরকার? হাজারো ফিলিস্তিনি জনতা নিহত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইসয়েলকে ৩৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।
এরপরে আরও কথা বলতে হবে ইসরায়েলের কিছু আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে। আমাদের সাহস জড়ো করতে হবে। সে দেশে আইনিভাবেই ব্যাপক বৈষম্য চলে আসছে। আদালতের মাধ্যমেই দেশটিতে বৈষম্য নিশ্চিত করা হচ্ছে। আরব নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সেখানে আলাদা আদালত আছে। কমপক্ষে ৫০টি আইন আছে যার মাধ্যমে ঐ আদালতে বৈষম্যমূলক ও ত্রুটি পূর্ণ বিচার করা হচ্ছে। এই বৈষম্যমূলক আইনের মধ্যে অন্যতম একটি আইনের নাম “নিউ-স্টেট ল”। এই আইনে বলা হয়েছে শুধু মাত্র ইসরায়েলি ইহুদি সম্প্রদায়ই সেদেশে জাতিগতভাবে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নির্ধারণের অধিকার রাখে। সেখানে আরব নৃ-গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। মোট জনসংখ্যার ২১ ভাগ আরব নৃ-গোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও চলে আসছে এমন বৈষম্য।
অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবে জানি, লুথার কিং বেঁচে থাকলে কি আজ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নিয়ে এভাবে ভাবতো? কথা বলতো? এটা সত্য। ইসরায়েল সম্পর্কিত লুথার কিং’র দৃষ্টিভঙ্গি জটিল এবং কিছুটা সাংঘর্ষিক।
যদিও ছাত্রদের ননভায়োলেন্ট কোঅরডিনেটিং কমিটি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছিল। তবে কিং’র অবস্থান এক্ষেত্রে কিছুটা বিরোধপূর্ণ ছিল। সে সময় অন্যান্য কৃষ্ণ নেতাদের মত তিনিও ইউরোপীয় ইহুদিদের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও গৃহহীন একটি জাতি হিসেবেই ভেবেছিলেন, যারা চেষ্টা করছিল নিজেদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। এ জন্যেই সে সময় তিনি ইহুদিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। এটাকে তখন নাগরিক অধিকার আন্দোলনেরই একটা অংশ হিসেবে ধরা হয়েছিল।
তবে ইসরায়েল পশ্চিম তট দখল করে নিলে লুথার কিং ১৯৬৭ সালে সেখানে তার তীর্থযাত্রা বাতিল করে। এই ব্যাপারে যাত্রার উপদেষ্টাদের সাথে একটি ফোনালাপে লুথার কিং বলেন “আমি এই তীর্থযাত্রায় গেলে আরব, এশিয়া ও আফ্রিকায় এর প্রভাব পড়বে। তারা সবাই ভাববে আমি ইসরায়েলের দখলদারীকে সমর্থন করি। আমি নিজেও এ ব্যপারে সন্দিহান।”
আমি অনড় হয়েই বলতে চাই, ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি যেমন একটি ইহুদি শিশুর মাঝে আছে তেমনিই একটি ফিলিস্তিন শিশুর মাঝেও রয়েছে।
এরপরেও তিনি ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তবে জাতীয় টেলিভিশনের একটি ভাষণে তিনি তার অবস্থান স্বচ্ছ করেন। তিনি জানান প্রকৃত শান্তি ও সুরক্ষা ফিরিয়ে আনতে এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়াতে ইসরায়েলের উচিৎ তাদের দখলকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দেয়া। সর্বসম্মুক্ষে সকল অসঙ্গতি মিটমাটের লক্ষ্যে এবং ন্যায়বিচার ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তার এর চেয়ে বেশি কিছু করার ছিল না। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর তেমনটাই প্রকাশিত হয়।
এই সময়ে আমরা লুথার কিং’র দৃষ্টিভঙ্গির মূল জায়গাটা চিন্তা করতেই পারি। তবুও, আমি ইতিহাসবেত্তা রবিন ডিজি কেলির সাথে একমত। তিনি বলেন, কিং যদি বর্তমান সময়টিকে যাচাই করার সুযোগ পেতেন ঠিক যেমনটা তিনি করেছিলেন ভিয়েতনাম ইস্যুতে তবে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্ত ভিন্ন হতো। হিংস্রতা, সামন্তবাদ, বর্ণবাদ, যুদ্ধপ্রিয়তা (মিলিটারিজম) এর বিরুদ্ধে তার যেরকম অভ্রান্ত বিরোধিতা ছিল। সেক্ষেত্রে এটা বলাই যায় তিনি ইসরায়েলের বর্তমান অবস্থান জানলে তাদের কঠোরভাবে বিরোধিতা করতেন।
প্রকৃতপক্ষে লুথার কিং’র দৃষ্টিভঙ্গি আরো কয়েকজন চিন্তাবিদ দ্বারা অভিব্যাক্ত হয়েছে। যেমন রাব্বি ব্রায়েন ওয়াল্ট। তার মতে, ইহুদিবাদের অনেক কিছুই আছে যা এর রাজনৈতিক চেতনাকে পরিত্যক্ত করতে বাধ্য করে। তিনি কিছুদিন আগেই আমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি আমার কাছে বিশ্লেষণ করেছেন। লিবারেল বা উদার ইহুদিবাদীরা বিশ্বাস করে কেবলই ইহুদি জনগোষ্ঠীর একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মোট কথা তারা একটি ইহুদি স্বর্গ গড়ে তুলতে মরিয়া। তিনি বলেন, “তারা একটি রাষ্ট্র চায় যার আদর্শ ও গতি কেবলই ইহুদীবাদের সর্বোচ্চ ঐতিহ্য ও রীতি মেনে চলবে”। তিনি জানান, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বড় হয়েছেন। সেখানে তিনি ইহুদিবাদের দীক্ষা পান। তিনি প্রচারও করেছেন বটে। তবে দখল করা ভূমি এবং মানুষের অমানবিক অবস্থা দেখে তার সব চেতনা বদলে গিয়েছে।
তিনি ২০ বার গাজার পশ্চিম তীরে ভ্রমণ করেছেন। তিনি দেখেছেন মানবতার অবক্ষয় কতটা মর্মান্তিক হতে পারে। দেখেছেন কিভাবে মানুষের ক্রন্দনরত চোখের সামনে তাদের ঘর-বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। বাচ্চাদের খেলনাগুলো কিভাবে পড়েছিল। মনে হচ্ছিল জীবন্ত কিছুকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাই না, বেআইনি বন্দোবস্তের মাধ্যমে দখল করা হচ্ছিলো ফিলিস্তিনের জমি, এলাকা। সকল ধ্বংসলীলা, বেআইনি উচ্ছেদাভিজান এবং সকল অমানবিকতা দেখেও আমাকে বাধ্যকরা হয়েছিলো এই সবকিছুকে যাচাই করতে এবং সমর্থন করতে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আমাকে জোর করেছিল। তার মতে, তার চেতনার উন্নতির কারণ ছিল নিপীড়ন এবং বৈষম্যকে বৈধতা দেওয়া। যেটা তিনি কখনই মেনে নিতে পারেননি। বাল্য বয়সে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় যত না বৈষম্য দেখেছেন তার চেয়ে বেশি দেখেছেন সেখানে। ইসরায়েলে শুধু ইহুদিদের জন্য করা হয়েছে আলাদা সড়ক।
তার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, কারণ প্রায়শই এমনটা শোনা যায়। তার ঘটনাগুলো বেশি দিন আগেরও নয়।
আমেরিকায় এমন সংগঠনও আছে যারা আমেরিকানদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা ফিলিস্তিনে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে সেটা খুবই জরুরি। সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনবাসীকে গৃহহীন করা হয়েছে শুধু ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার জন্যই। ‘জিউস ভয়েস ফর পিস’— এমনই একটি সংগঠন। তবে সাহসের সাথে এর বিরুদ্ধে অনেকেই মুখ খুলছে। এদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকায় কিছু সংগঠন আছে যারা কিছু তরুণ এবং যাদের মধ্যে ইহুদিও আছে, প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে ইসরায়েলের এমন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ‘ইফ নট নাউ’— তেমনই একটি সংগঠন। অনেক পেশার মানুষ আছে যারা ধর্ম নিরেপেক্ষ এবং ইউএস ক্যাম্পেইন ফর প্যালেস্টাইন রাইটস এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
এই উন্নতির ফলেই আশা করা যায় যে একদিন সফল ভাবে এই ইহুদিবাদের সমালোচনা হবে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন কর্মসূচিকে তখন ইহুদীবিদ্বেষ এর নামে প্রচার চালানো হবেনা। এর শেষ হবে। দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ড ও সরকারের সমালোচনাকে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিচ্ছে।
আমি এটা বলছি না যে ইহুদিবিদ্বেষ বলতে কিছু নেই। অধিবাসীদের প্রতি শক্তি হিসেবে নব্য-নাৎসি তৈরি হচ্ছে জার্মানে। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবিদ্বেষ ২০১৭ সালে ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। এই হামলাকেই আমেরিকায় ইহুদিদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বৃহৎ হামলা হিসেবে ধরা হয়। আমরা এখনো শোকাচ্ছন্ন। তবে আমাদের এটা অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই ইহুদিবিদ্বেষ নয়।
সৌভাগ্যবসত, দ্বিতীয় ড. উইলিয়াম জে. বারবার’র মত উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। তিনি ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সংহতি জানিয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের দখল থেকে রক্ষা করতে সংগ্রাম জারি রেখেছেন।
তিনি গত বছর তার এক ভাষণে বলেছেন, আমরা স্থানীয় জনগণকে উপেক্ষা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারি না। তাদের স্থানচ্যূত করে তা সম্ভবও নয়। বর্ণবাদী ব্যাবস্থা যেখানে বিদ্যমান, সরকারি অবিচার যেখানে চলছে সেখানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। একই ভাষণে তার আর একটি উক্তি ছিলো এই যে “আমি স্পষ্ট করেই বলছি, আমি জানি একজন বা এক গোষ্ঠীর সন্মান ও মানবতা কখনোই অন্য একজন বা গোষ্ঠীর সন্মান ও মানবতা রক্ষা করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আমি অনড় হয়েই বলতে চাই, ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি যেমন একটি ইহুদি শিশুর মাঝে আছে তেমনিই একটি ফিলিস্তিন শিশুর মাঝেও রয়েছে।”
এই রকমের আদর্শিক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাস আজকাল অনেক শ্রেণির মানুষের মধ্যেই স্পষ্ট হচ্ছে। ২০১৬ সালে ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চের (গীর্জা) বোর্ড ইসরায়েলি অর্থসাহায্যে দেয়া একটি শত কোটি ডলারের অবসর ফান্ড প্রত্যাখ্যান করে। ঐ ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে এমন আইন করতে ইসরায়েলি সরকারকে ঋণ দেওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইভাবে ইউনাইটেড চার্চ অব ক্রাইস্ট একই বছর ইসরায়েলের কিছু কোম্পানির বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের এলাকা দখলের সিদ্ধান্তেই নেওয়া হয় এমন পদক্ষেপ।
আমার অবস্থান বিশেষভাবে তাদের বিরুদ্ধে হবে যারা সরকারি সহায়তা নিয়ে এই সকল অবিচারে লিপ্ত রয়েছে। সংহতি জানবো গণতন্ত্র ও মুক্তির সকল লড়াইয়ের পক্ষে। আমার বিবেক আমাকে আর কোন বিকল্প পথ দেয়নি।
এমনকি কংগ্রেস প্রথমবারের মত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন শুরু করেছে। প্রথমবারের মত দু’জন সিটিং সদস্য প্রতিনিধি ইলহান ওমর, মিনিয়েসোটার ডেমোক্রেট এবং রাশিদা তালিব, মিশিগানের ডেমোক্রেট জন সম্মুখে গীর্জাগুলোর ইসরায়েল বিরোধী সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন জানায়। ২০১৭ সালে, মিনিয়েসোটার ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি বেটি ম্যাককলাম সংসদে বাধ্য করে যেন যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী কোন রকম সাহায্য নিয়ে ইসরায়েলের জুভেনাইল ডিটেনশনে না যায়। ইসরায়েল নিয়মিত দখলকৃত এলাকায় শিশুদের নানা ভাবে বিচার করছে এবং শাস্তি দিচ্ছে। সামরিক আদালতেই হচ্ছে ঐসব বিচারকার্য।
যদিও এত কিছু এটা প্রমাণ করে না যে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গিয়েছে কিংবা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া বন্ধ হচ্ছে। যারা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে তদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হচ্ছে প্রতিশোধ। অনেকটা সেভাবেই যেভাবে প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিলো লুথার কিং’র বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের পক্ষে কথা বলাতে। দ্যা টাইমসসহ ১৬৮টি খবরের কাগজ জানিয়েছিল, যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে রয়েছে তারা এখনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং নিন্দার পক্ষে যা ভয়ানক।
বাহিয়া আমাওয়াই একজন ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূদ আমেরিকান স্পিচ প্যাথোলজিস্ট। তাকে চাকরিচ্যূত করা হয়েছে শুধু মাত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোন রকম অবরোধ যেন না হয় এমন সম্মতি পত্রে সই না করার জন্য। মার্ক ল্যামোন্ট, সিএনএন’র একজন সাংবাদিক। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে একটি ভাষণ দেওয়ার ফলে তার সাথেও এমনটি করা হয়েছে বলে জানা যায়। তার ভাষণকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করা হয়। প্রমাণ করা হয় যে তিনি সহিংসতার পক্ষে কথা বলেছেন।
এইতো কিছুদিন আগেই নাগরিক অধিকারের আইকন অ্যাঞ্জেলা ডেভিস’র একটি সম্মান পদবি বাতিল করা হয় বার্মিংহাম সিভিলি রাইটস ইন্সটিটিউট থেকে। প্রতিষ্ঠানটি অ্যালাব্যামায় অবস্থিত। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার নিন্দা জানানোতেই এমনটি হয়। ঐ প্রতিষ্ঠানের ইহুদিদের চাপেই তার সন্মান কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
তবে ঐ সিদ্ধান্তকে প্রতিহত করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সিদ্ধান্তটি বাতিল হয়। শিক্ষাবিদ এবং আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে প্রতিষ্ঠানটি তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছ পা হয়। বার্মিংহামের মেয়রসহ বার্মিংহাম স্কুল বোর্ড এবং সিটি কাউন্সিল ঐ প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। একটি বিবিধ অধ্যাদেশে ডেভিসকে তার পূর্বের সম্মান ফিরিয়ে দেয়া হয়। তার সাথে মানবমুক্তির একান্ত কর্মী হিসেবে ১০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয় ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে।
আমি এটা নিশ্চিত বলতে পারছিনা যে কিং বার্মিংহামের ঐ সিদ্ধান্তের তারিফ করতো কি না। তবে অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং সংহতির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তটি ছিল সম্পূর্ণরূপে হিংসাত্বক। তবে এই নতুন বছরে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই এসকল অবিচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবো। কথা বলব আরো বৃহৎ পরিসরে। আমার আওয়াজকে জাতীয় সীমান্তের বাহিরে নিয়ে যাবো। আমি করেই ছাড়ব। আমার অবস্থান বিশেষভাবে তাদের বিরুদ্ধে হবে যারা সরকারি সহায়তা নিয়ে এই সকল অবিচারে লিপ্ত রয়েছে। সংহতি জানবো গণতন্ত্র ও মুক্তির সকল লড়াইয়ের পক্ষে। আমার বিবেক আমাকে আর কোন বিকল্প পথ দেয়নি।