উইন্টার স্লিপ : সিনেমায় দর্শন অথবা দর্শন’র সিনেমা

উইন্টার স্লিপ : সিনেমায় দর্শন অথবা দর্শন’র সিনেমা

প্রথমে বলি এই সিনেমাটি তরুণ বয়সের কারও পক্ষে একটানা বসে হজম করা মনে হয় খুব একটা আরামদায়ক হবে না। কারণ এটা তিন ঘন্টা ষোল মিনিটের একটা স্লো স্ক্রিনপ্লে। যা মূলত শ্রেফ ডায়লগ নির্ভর সিনেমা। অনেকেই হয়তো প্রথম আধা ঘন্টায় বিরক্ত হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু তার পরে যদি দম ধরে রাখতে পারেন। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আপনি মুগ্ধ হবেন এবং এই মুগ্ধতার রেশ আপনার সমগ্র অঙ্গকেই ছুঁয়ে যাবে। এই ২৫ বছরের জীবনে প্রায় হাজার খানেক মুভি দেখা হয়েছে আমার। কিন্তু সিনেমায় এতো দার্শনিক আলাপ একসাথে কোন মুভিতে পাই নি। কেবল তিন চারটা চরিত্র, একজন সাবেক মঞ্চ অভিনেতা, তার তরুণ স্ত্রী, তার ডিভোর্সি বোন এবং দুই একজন সাইড অ্যাক্টর, কয়েকটা রুম এবং আনতলিয়ার একটা গ্রাম। যেটা আবার তুষার ঝড়ে ঢাকা, কেবল এর ভেতরে শ্রেফ ডায়লগের উপর বেইজ করে একটা তিনঘন্টার মুভি, জাস্ট অনবদ্য ও অসাধারণ এবং কল্পনাতীত মুগ্ধতায় ভরপুর।

প্রতিটা সংলাপ এতো আকর্ষণীয় এবং কৌতুহলীউদ্দীপক যে ইচ্ছে করছে আলাদা আলাদা করে সব টুকে রাখি কোন খাতায়। সব মনে রাখা যাবেনা এটাই আফসোস।

মানুষ, তার চিরায়ত জীবন, তার চিন্তা, স্ট্যাটাস। এর পক্ষে বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক, লেখা লেখি নিয়ে দার্শনিক আলাপ, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, ডিভোর্স, নীতি, নৈতিকতা, সাহিত্য, ধর্ম প্রায় প্রতিটা বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদা আলাপ আছে এখানে। এটাতে মূল চরিত্র বয়স্ক লেখক আয়দিন’র সাথে তার বোন নেকলার দীর্ঘ সংলাপগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে বিশেষ করে। বিস্তারিত না লিখে  কয়েকটা সংলাপ এমন,

১. দুইজন মানুষের মধ্যে যখন মনোমালিন্য হয়, তখন প্রত্যেকের উচিৎ অন্যের দোষ না খুঁজে, ঐ ঘটনায় নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করা।

২. কোন ঘটনায় কেবল একজনের উপর সব দোষ বর্তায় না।

৩. আমাদের যাপিত জীবনে এমন অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো হয়তো কখনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়, আমাদের উচিৎ এই ক্ষেত্রে নিজেদের আরেকটু সহনশীল করা, সব মানুষ সব বিষয়কে একি অ্যাঙ্গেল থেকে বিচার বিবেচনা না করা।

৪. যে সব সময় মোরালিটি, ন্যাপরায়নতার আলাপ তোলে তাকে আগেই সন্দেহ করা হয়।

৫. লেখালেখির বিষয় অনেক ক্ষেত্রে লেখক নিজে নির্ধারণ করেন না, এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিজেই লেখক নির্বাচন করে। কারণ ঐ লেখার জন্য সেই হয়তো উপযুক্ত লেখক।

৬. আমার মনে হয় আমাদের দরকার কোন বদ লোককে তার কাজ কন্টিনিউ করতে দেওয়া, এইভাবে হয়তো সে নিজেই একসময় তার কাজের জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হতে পারে, তখন সে এটা আর এমনটি করবেনা। এটা লেখকের বোন নেকলার ধারণা, এবং মুভির সবচাইতে আকর্ষণীয় বিতর্কের জায়গা। যেটা নিয়ে ভাই-বোনের মাঝে দারুণ তর্ক বিতর্ক হয়।

৭.  যে সর্বদা ভাবনায় ও চিন্তায় মগ্ন থাকে সে বেশি পরিশ্রম করে।

৮. কোন মানুষকে ভালোভাবে না জেনে তার প্রতি মুগ্ধ হওয়া, ভালোবাসা, বিয়ে করা এবং পরবর্তীতে আর ভালো লাগছেনা বলে তাকে তিরষ্কার করা, এটা কতটুকু নৈতিক?

৯. আমাদের যৌবন কেটেছে বেশ দমবন্ধ উৎকন্ঠিত অবস্থায়, ফলত আমরা জানিনা কিভাবে সুখী হতে হয়, কিভাবে অন্যকে সুখী করতে হয়। আমার মতো মানুষের কাছে এমন শীতল রাত্রে স্ত্রীর এমন উচ্চ শব্দে ভর্ৎসনা শুনাটাও সুখের মনে হয়। তরুণ স্ত্রীর প্রতি আয়দিন এমন একটি ডায়লগ দেন।

১০. একসময় আমার মার সাথে ছিলাম, আমরা একসাথে খেলতাম, তারপর একদিন মা চলে গেলেন, আমি বিয়ে করলাম, মেয়ে হলো, এখন তার মা কবরে শুয়ে আছে, আর মেয়ে আমার থেকে হাজার মাইলে দূরে, আমি আবারো একা।

১১. আমরা পরিকল্পনা করতে করতে জীবনের স্বর্ণালী সময়গুলো নষ্ট করে ফেলি, তারপর একসময় জীবন ফুরিয়ে আসে, পরিকল্পনা সব ভেস্তে যায়, আমাদের নতুন করে কিছু উদযাপন করা হয় না।

এইভাবে লিখতে গেলে উপন্যাস লেখা যেতো আরেকটা কেবল এই মুভির সব ডায়লগ আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণে গেলে। সবশেষে আয়দিন ও তার তরুণী স্ত্রীর প্রতি আকুল ভালোবাসায় নিজেকে ছোট করে ক্ষমা প্রার্থনা করার দৃশ্যে বুকের ভেতরটা আৎকে ওঠে। কেবল একটু নত হলে, আমাদের জীবনের কত হতাশা বিবাদ দূর হয়ে যেতে পারে সেটা আমরা বুঝতে চাইনা। মানুষ তার ভালোবাসার কাছে ছোট হতে পারে, তাকে এইভাবে জিতে নিতে পারে। যেমন আয়দিন তার স্ত্রীর কাছে কেবল চাকর হিসেবে পাশে থাকার আবেদন করছে সমস্ত অর্থ সম্পদ সবকিছুকে তুচ্ছ করে। আহা জীবন, আহা ভালোবাসা। এ ছাড়াও তুষারপাত এ ঢাকা আনাতলিয়ার সিনেমাটোগ্রাফি এই মুভির আরেক অসাধারণ কাজ। মুগ্ধতা একসময় মন খারাপ ঠেকে, এবং কখন আয়দিনের চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করে চোখ ভিজে ওঠে বুঝতে পারিনা।