প্রজাপতি এ মন মেলুক পাখনা—
দূরে যত দূরে— যায় যদি যাক না—
স্বপ্নের ভেতর আমরা এভাবে উড়িনা কি… অবশ্যই উড়তে থাকি নিজের মতো। যেখানে কোনও বাধন নেই। যেখানে কেউ নেই মানা করার। সোনালি রোদ্দুর ছুঁয়ে অবিরাম একটার পর একটা স্বপ্ন দেখি। কখনও পাখি হয়ে কখনও বা ঘোড়া হয়ে। সবার স্বপ্নের এক আলাদা মানে আছে। আলাদা জগত আছে। খাবো কে পরিন্দে উড়ে যেতে যেতে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে— মহাকাশে। অন্য গ্রহে যেতেও তাঁর ভিসা পাসপোর্ট কিচ্ছু লাগে না।
এভাবে মন খুলে স্বপ্ন দেখতে জানতে হয়। শিখতেও হয় কিছুটা। তা নাহলে পুরো জীবনটাই ব্যাং অন হয়ে যাবে। আচ্ছা ভাবুন তো, আমরা স্বপ্ন দেখি কেন, স্বপ্ন কয় প্রকার। সোজা কথা হল, স্বপ্ন না দেখলে আমরা বেঁচে থাকব কি করে। আর স্বপ্নের প্রকারভেদ, সে তো এক জেগে জেগে স্বপ্ন, আর এক ঘুমিয়ে। আসলে আমাদের ব্রেন আমাদের যা বলতে চায়, সেটাই স্বপ্ন। টুকরো টুকরো কোলাজ।
স্বপ্নের মানে নিয়ে হাজার বছর ধরে মানুষ পাজল হয়ে আছে। প্রাচীন যুগে ইজিপশিয়ানরা মনে করতেন স্বপ্ন হল ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা বা সামনের দিনগুলোতে কি আসতে চলেছে, তার একটা বিবরণ মাত্র।
মানুষের একটি মানসিক অবস্থার নাম স্বপ্ন, যাতে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করে থাকে। ঘটনাগুলি কাল্পনিক হলেও স্বপ্ন দেখার সময় সত্যি বলে মনে হয়। অধিকাংশ সময় যে স্বপ্ন দেখছে নিজে সেই ঘটনায় অংশগ্রহণ করছে বলে মনে করতে থাকে। অনেক সময়ই পুরনো অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো স্মৃতি কল্পনায় বিভিন্নভাবে জুড়েও পরিবর্তিত হয়ে সম্ভব অসম্ভব সব ঘটনার রূপ নেয়। স্বপ্ন সম্বন্ধে অনেক দর্শন, বিজ্ঞান, কাহিনী ইত্যাদি আছে। স্বপ্নবিজ্ঞানের ইংরেজি নাম Oneirology। কিছু স্বপ্নবিজ্ঞানীর মতে নিদ্রার যে পর্যায়ে কেবল অক্ষিগোলক দ্রুত নড়াচড়া করে কিন্তু বাকি শরীর শিথিল (সাময়িকভাবে প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত) হয়ে যায় সেই REM (Rapid eye movement) দশায় মানুষ স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও।
স্বপ্ন হল ধারাবাহিক কতগুলো ছবি ও আবেগের সমষ্টি যা ঘুমের সময় মানুষের মনের মধ্যে আসে। এগুলো কল্পনা হতে পারে, অবচেতন মনের কথা হতে পারে, বা অন্য কিছুও হতে পারে, শ্রেণিবিন্যাস করা বেশ কষ্টকর। সাধারণত মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে, তবে সবগুলো মনে রাখতে পারে না। স্বপ্নের অর্থ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন লোক ভিন্ন ভিন্ন মতামত পোষণ করেছে যা সময় এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেকেই স্বপ্ন সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে সমর্থন করেন যে স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগগুলির বহিঃপ্রকাশ। অন্যান্য বিশিষ্ট থিওরিগুলোতে সুপারিশ করা হয়েছে যে স্বপ্ন মেমরি গঠন, সমস্যা সমাধান এবং মস্তিষ্ককে সক্রিয়করণ করতে সাহায্য করে। প্রায় ৫০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় স্বপ্ন সম্পর্কে যে প্রাচীন রেকর্ডগুলি পাওয়া গিয়েছিল তা মূলত কাদামাটি দিয়ে তৈরি ট্যাবলেটগুলিতে নথিভুক্ত ছিল। গ্রিক এবং রোমান যুগে মানুষ বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্নগুলি এক বা একাধিক দেবতার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বার্তা অথবা মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসা বার্তা যা প্রধানত ভবিষ্যৎবাণী হিসাবে গণ্য করা হতো।
১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে সিগমন্ড ফ্রয়েড মনোবিশ্লেষণের মনস্তাত্ত্বিক শৃঙ্খলা বিকাশ করেছিলেন তাছাড়া স্বপ্নের তত্ত্ব ও তাদের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে লিখেছিলেন। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছিলেন গভীরতম আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্বিগ্নতা প্রকাশের মাধ্যমকে অবলম্বন করে যা প্রায়ই দমনমূলক শৈশব স্মৃতি বা আচ্ছন্নতা সম্পর্কিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বস্তুগতভাবে তার স্বপ্নের বিষয়টি অবশ্যই যৌন উত্তেজনা মুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। Interpretation of Dreams (1899) এর মধ্যে, ফ্রয়েড স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জন্য একটি মানসিক কৌশলকে বিকশিত করেছিলেন এবং একটি ধারাবাহিক নির্দেশিকা দিয়েছিলেন যা আমাদের স্বপ্নে প্রদর্শিত সিম্বল এবং মোটিফ বুঝতে সাহায্য করবে। আধুনিক যুগে স্বপ্নকে অবচেতন মনের সংযোগ হিসাবে দেখা হয়। স্বপ্ন একটি সুররিয়ালিজম। স্বপ্ন বিভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে। যেমন, ভয়ঙ্কর, উত্তেজনাপূর্ণ, জাদুকর, মর্মান্তিক, সাহসিক বা যৌন উত্তেজনা সংক্রান্ত। স্বপ্নের ঘটনাগুলি সাধারণত যিনি স্বপ্ন দেখেন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। ব্যতিক্রম কিছু স্বপ্ন আছে যেখানে স্বপ্নদর্শক আত্মসচেতনতার পরিচয় দেয়। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে সৃজনশীল চিন্তাধারার উদ্রেক হতে পারে যার ফলে সে অনুপ্রেরণাও অনুভব করতে পারে।
প্রাচীন ইতিহাস
৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয়রা স্বপ্নের নিদর্শন রেখে গিয়েছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর বিদ্বান-রাজা এই প্রারম্ভিক রেকর্ডকৃত দেব-দেবতাদের কাহিনী অনুসারে স্বপ্নের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন। কাদামাটির ট্যাবলেটগুলির আর্কাইভের মধ্যে কিংবদন্তি রাজা গিলগামেশের গল্পের কিছু বিবরণ পাওয়া গিয়েছিল।
মেসোপটেমিয়ার লোকদের বিশ্বাস ছিল যে আত্মা বা তার কিছু অংশ ঘুমন্ত ব্যক্তির শরীর থেকে বেরিয়ে আসে যা প্রকৃতপক্ষে ঐসব স্থান এবং ব্যক্তিদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় যা স্বপ্নদর্শীরা তাদের ঘুমের মধ্যে দেখে। কখনও কখনও স্বপ্নের দেবতারা স্বপ্নদর্শীকে বহন করতে বলে। ব্যাবিলনীয়রা এবং আসিরিয়ানরা স্বপ্নকে বিভক্ত করেছিল ‘ভাল’ যা দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত হয়েছিল এবং ‘মন্দ’ যা ভূতদের দ্বারা পাঠানো হয়েছিল। তারা এও বিশ্বাস করতো যে তাদের স্বপ্ন ছিল নিখুঁত এবং ভবিষ্যদ্বাণী সংবলিত।
ক্লাসিক্যাল ইতিহাস
চীনা ইতিহাসে, মানুষ আত্মার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে লিখেছিলেন, যার মধ্যে একটি স্বপ্নের রাজ্যে যাত্রার সময় শরীর থেকে মুক্তি পায় এবং অন্যটি দেহে অবস্থান করে, যদিও শুরু থেকেই এই বিশ্বাস ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা দার্শনিক ওয়াং চং (২৭- ৯৭ খ্রিস্টাব্দ) দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। ৯০০ এবং ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে লিখিত ভারতীয় পাঠ উপনিষদে স্বপ্নের দুটি অর্থের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথমটি বলে যে, স্বপ্ন হল মনের ভিতরের নিছক ইচ্ছার অভিব্যক্তি মাত্র। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ঘুমের সময় আত্মা দেহ ত্যাগ করে এবং জাগ্রত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বপ্ন দ্বারা দেহ পরিচালিত হয়।
পঞ্চম খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে অ্যান্টিফন স্বপ্ন নিয়ে প্রথম গ্রীক বই লিখেছিলেন। সেই শতাব্দীতে, অন্যান্য সংস্কৃতি গ্রিকদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত ছিল যে, আত্মা ঘুমানোর সময় শরীর ছেড়ে চলে যায়। হিপোক্রেটস (৪৬৯ -৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) স্বপ্ন নিয়ে একটি সহজ তত্ত্ব দিয়েছিলেন: দিনের বেলা মানুষের আত্মা স্বপ্ন সংক্রান্ত চিত্র গ্রহণ করে এবং রাতের বেলা পূর্ণাঙ্গ একটি ছবিতে রূপদান করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্ন হল শারীরিক কার্যকলাপ। তিনি মনে করতেন স্বপ্ন রোগের বিশ্লেষণ এবং কোন ধরনের রোগ হতে পারে তার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
আব্রাহামিক ধর্মের দিক থেকে
ইহুদিধর্মের মধ্যে স্বপ্নকে পৃথিবীর অভিজ্ঞতার অংশ বলে বিবেচিত হয়। যদিও হিব্রুরা একেশ্বরবাদী ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন যে স্বপ্নগুলি একমাত্র ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত ধ্বনি ছিল। হিব্রুরা অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতির মত ঐশ্বরিক বাণীকে ব্যাখ্যা করার জন্য স্বপ্নের সাহায্য নিতেন।
খ্রিস্টান জাতির মানুষেরা হিব্রুদের মত মেনে নিয়েছিল। তারা মনে করতেন যে স্বপ্ন একটি অতিপ্রাকৃত চরিত্র। ওল্ড টেস্টামেন্টে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা সংবলিত অনেক স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। এই স্বপ্ন সংক্রান্ত কাহিনীগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল জ্যাকব এর স্বপ্ন যেটি পৃথিবী থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক খ্রিস্টান প্রচার করেন যে ঈশ্বর স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষের সাথে কথা বলতে পারেন।
ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে
ইসলামে স্বপ্নের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন ইয়ান আর এডগার। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, স্বপ্ন ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলমানদের জীবনযাত্রার উপর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, কারণ স্বপ্নের ব্যাখ্যা হচ্ছে একমাত্র উপায় যা মুসলিমরা শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর কাছ থেকে যে প্রত্যাদেশ লাভ করতেন তা থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়।
হিন্দুধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে
মান্ডুক্য উপনিষদ ভারতীয় হিন্দুধর্মের বেদ ধর্মগ্রন্থের একটি অংশ, এখানে স্বপ্নের তিনটি অবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম অবস্থা হচ্ছে আত্মা তার জীবদ্দশায় অভিজ্ঞতা লাভ করে। অন্য দুইটি অবস্থা হচ্ছে জাগ্রত অবস্থা এবং ঘুমন্ত অবস্থা।
ক্লাসিক্যাল উত্তর এবং মধ্যযুগীয় ইতিহাস
কিছু আদিবাসী আমেরিকান উপজাতি এবং মেক্সিকান সভ্যতার লোকেরা বিশ্বাস করত যে, স্বপ্ন হল একটি মাধ্যম যার সাহায্যে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের দেখতে এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। কয়েকটি নেটিভ আমেরিকান উপজাতি স্বপ্নের মাধ্যমে উপদেশ গ্রহণ না করা পর্যন্ত উপবাস ও প্রার্থনা করে। স্বপ্ন থেকে প্রাপ্ত উপদেশ তারা বাকিদের সাথে ভাগ করে নেয়।
মধ্যযুগে স্বপ্নকে একটি কঠোর ব্যাখ্যায় উন্নীত করা হয়েছিল। তাছাড়া স্বপ্নের ছবিগুলোকে শয়তান’র প্রলোভন হিসাবে মনে করা হত। অনেকে বিশ্বাস করতেন যে, ঘুমের সময় শয়তান মানুষের মনকে কলুষিত ও ক্ষতিকারক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে। প্রোটেস্টান্টিজম’র প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার বিশ্বাস করতেন স্বপ্ন হল শয়তানের কাজ।
স্বপ্ন… স্বপ্ন… স্বপ্ন… স্বপ্ন দ্যাখে মন। তাহলে এই তো গেলো স্বপ্ন সম্বন্ধীয় সামান্য ইতিহাস। প্রতিটা স্বপ্নেরই আলাদা আলাদা মানে রয়েছে বলে গবেষকদের মত। যার মধ্যে বেশ কিছু মানে আমাদের পরিচিত। কিন্তু এমন অনেক স্বপ্ন আমরা দেখি যেগুলোর কোনও মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের ঘুমের তিনটে পর্যায়ের মধ্যেই রয়েছে এই ভাগটি। স্লিপ অনসেট, লাইট স্লিপ, আর ডিপ স্লিপ। সাধারণত তৃতীয় ধাপে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে মানুষ। স্বপ্ন বড় জটিল বিষয়। অধিক দুশ্চিন্তা থেকেই নয়, শুধু অধিক অসচেতনা থেকেও দুঃস্বপ্নের জন্ম হয়। অনেক গবেষণার পরও এই স্বপ্ন নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি গবেষকরা।
তাই সেসব না ভেবে স্বপ্ন দেখে চলি। অতিরিক্ত পেট গরম থাকলে নাকি দুঃস্বপ্ন এসে হাজির হয়। সেসব না ভেবে রাতে হালকা খাবার খেয়ে ঘুমোতে যাওয়াটা কি সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। দুঃস্বপ্ন নয় এক একটা স্বপ্ন হোক এক একটা চলচিত্র।