প্রায় এক দশক ধরে ফুটবল বিশ্বে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে লিওনেল মেসি- ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম। অসংখ্যবার উত্থাপিত প্রশ্ন, মেসি সেরা, নাকি রোনালদো? দুজনের কেউ কাউকে টপকে যেতে পারেন না খুব একটা। একজন আরেকজনকে ছাপিয়ে গেলেই যেন অপর পাশে থাকা মানুষটা আরো বেশি নিজেকে প্রমাণ করা শুরু করে দেয়। দুজনের বর্ষসেরা খেলোয়াড় হওয়ার দিক থেকে দুজনেই সমান। পাঁচবার করে জিতেছেন দুজনই। ক্লাবের হয়ে সাফল্যেও কেউ কারোর চেয়ে কম না। একজন লা লিগায় রাজত্ব করেছেন। অন্যদিকে, আরেকজনকে চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজা বলা যায়।
তবে জাতীয় দলের কথা বলতে গেলে এখানে এগিয়ে আছেন পর্তুগিজ তারকা রোনালদো। জিতেছেন ইউরো। অন্যদিকে, মেসি আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সেরা তারকা ও সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও জাতীয় দলের জার্সি গায়ে নেই তেমন সাফল্য। আর ক্লাবের ক্যারিয়ারে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন বার্সেলোনাতেই। কিন্তু তিনটি দেশের তিনটি ভিন্ন জনপ্রিয় ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসে হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন রোনালদো।
মেসি ভক্তরা যেমন মনে করেন, মেসিই সর্বকালের সেরা।ঠিক তেমনি রোনালদো ভক্তরাও মনে করেন, রোনালদো বর্তমানে সেরা তারকা। কে সেরা এই তর্কে না গিয়ে বর্তমান দুই তারকা সেরার লড়াইয়ে কে এগিয়ে জেনে নেওয়া যাক।
লা লিগায় গত সোমবার লেগানেসের বিপক্ষে ম্যাচের কথাই ধরা যাক। যদিও প্রথমার্ধে উসমান ডেম্বেলে গোল পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ সেই গোল শোধ করেছেও বেশ তড়িৎ গতিতে। ম্যাচে কোথায় যেন প্রাণচাঞ্চল্যের একটা ঘাটতি। গত সেপ্টেম্বরে লেগানেসের মাঠ থেকে ২-১ গোলের পরাজয় নিয়ে ফিরেছিল কাতালানরা। ম্যাচ হারার শঙ্কায় তাই উপায়ন্তর না দেখে ম্যাচের ৬৪ মিনিটে অ্যালেনার বদলি হিসেবে মেসিকে মাঠে নামান কোচ। মেসি নামলেন, খেলা প্রাণ ফিরে পেলো, গোলের দেখা পেলেন, ম্যাচ জিতে নিলো বার্সা ৩-১ গোলের ব্যবধানে। আবার গত ম্যাচের কথাই ধরা যাক। কোপা দেল রের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে সেভিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে গেছে ফেভারিট বার্সেলোনা। মেসি এদিন মাঠে নামেননি। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের মাটিতে দারুণ এক জয় তুলে নিয়েছে সেভিয়া। এটাই মেসিসহ ও মেসিবিহীন বার্সেলোনা দলের চিত্র। এমনকি, এই একই চিত্র মেসির আর্জেন্টিনা জাতীয় দলেও। তবে দিনদিন মেসি যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশনে নেমেছেন। লা লিগায় ক্যারিয়ারের ৪০০তম গোল করার রেকর্ড গড়েছেন মেসি। ম্যাচের বার্সার জয়ের চেয়ে বেশি আলোচনা ছিল মেসির রেকর্ড। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় ৪০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করলেন তিনি। স্প্যানিশ ৪৩৫ ম্যাচ খেলে দারুণ এই কীর্তি গড়েন মেসি। যাতে ৮৩ ম্যাচে গোল করেছেন দুটি করে আর হ্যাটট্রিক করেছেন ৩১ বার। ২০০৪ সালে লা লিগায় অভিষেক হয়েছিল মেসির। লা লিগার ৯০ বছরের ইতিহাসে সেরা গোলদাতাদের তালিকাতেও বেশ বড় ব্যবধানে এগিয়ে শীর্ষে আছেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। ২০১৮-১৯ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মেসি ক্লাবে গোল পেয়েছেন ২৫টি। ১৩টি গোলে সরাসরি তার অবদান আছে।
এদিকে, সমসাময়িক সময়ে মাঠের পারফর্ম্যান্সের চেয়ে মাঠের বাইরের কর্মকান্ডে বেশি আলোচনায় ৩৩ বছর বয়সী রোনালদো। কিছুদিন আগেই কর ফাঁকির মামলায় মাদ্রিদের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছরের কারাদণ্ড হলো তার। রোনালদোর উপস্থিতিতেই মামলার শুনানি ও রায় হয়। তবে স্প্যানিশ আইনের বিশেষ সুবিধার কারণে জেল খাটতে হবে না তাকে। স্পেনে ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া অন্য মামলায় দুই বছর বা এর কম কারাদণ্ডের রায় হলে কাউকে জেল খাটতে হয় না। রিয়াল মাদ্রিদে থাকাকালীন কর ফাঁকির অভিযোগে ২০১৭ সালে এই মামলা দায়ের করা হয়। জেল না খাটলেও প্রায় এক কোটি ৮৮ লাখ ইউরো জরিমানা গুনতে হবে এই জুভ তারকাকে। অবশ্য, এর আগে একই ধরনের অপরাধে বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসিরও ২১ মাসের কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। লাস ভেগাসের একটি হোটেলে ২০০৯ সালে ক্যাথরিন মায়োরগা নামের এক নারীকে ধর্ষনের অভিযোগ উঠেছিল রোনালদোর বিরুদ্ধে। ওখানকার স্থানীয় পুলিশ ইতিমধ্যে এই বিষয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে ইতালিয়ান পুলিশ কর্তৃপক্ষকে রোনালদোর ডিএনএ পাঠাতে অনুরোধ করেছে। জার্মান সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ডার স্পেইজেল’ গত অক্টোবরে প্রথম এই ঘটনা নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। ওই নিবন্ধটিতে বলা হয়, ক্যাথরিন মায়োরগা নামের অভিযোগকারী নারী ঘটনার পর পরই লাস ভেগাস মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।যদিও অভিযোগকারীর সাথে আপোষ করার চেষ্টা চালিয়েছেন রোনালদোর পক্ষের আইনজীবি। কিন্তু আপোষের ব্যাপারে রাজি হননি ক্যাথরিন।
রোনালদো স্পেনের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে নতুন ক্লাব জুভেন্টাসে যোগ দেওয়ায় নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো কিংবা সতীর্থদের সাথে বোঝাপড়া হতেও সময়ের দরকার। কিন্তু মাঠের পারফরম্যান্সের চেয়েও মাঠের বাইরে বিব্রতকর ঘটনা রোনালদোর মাঠে মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে না? যদিও রোনালদো বলেছেন, তিনি এসব পরিস্থিতির পরেও ঠিক আছেন। তবে রোনালদোর পারফর্ম্যান্স বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ক্লাবের সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে রোনালদো মাত্র ১৬ গোল পেয়েছেন, গোলে সহায়তা করেছেন ৭টি। মেসির চেয়েও তিন ম্যাচ বেশি খেলে ফেলেছেন পর্তুগিজ তারকা। কিন্তু মাঠের পারফর্ম্যান্সে পিছিয়ে আছেন আর্জেন্টাইন তারকার চেয়ে। বলাই বাহুল্য, মাঠের বাইরে রোনালদোর জীবনের অঘটনগুলো মাঠে তাকে স্বচ্ছন্দ হতে দিচ্ছে না। আর সাবলীল মেসি এগিয়ে যাচ্ছেন আপন গতিতে, আরো অধরাকে ছুঁইয়ে দিতে।