“অমেঠী কা ডঙ্কা, বিটিয়া প্রিয়াঙ্কা।” (অমেঠীর ডঙ্কা, কন্যা প্রিয়াঙ্কা।)
“প্রিয়াঙ্কা লাও, দেশ বাচাও!” (প্রিয়াঙ্কাকে আনো, দেশ বাঁচাও!)
রাজীব গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধীর কন্যা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসুন, স্লোগান বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করছিল উত্তরপ্রদেশের অগণিত কংগ্রেস নেতাকর্মী এবং সমর্থক। রক্তে রাজনীতি, তাই অল্প বয়স থেকেই রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র চিনতে শুরু করেন প্রিয়াঙ্কা। নেপথ্য কারিগর হিসাবে দলের বেশ কিছু কৌশল এবং সিদ্ধান্তে তিনি বিচক্ষণতা প্রমাণ করেছেন। তিনি রাজনীতিতে আসুন, মা এবং দাদার পাশাপাশি তাকে পরামর্শ দিয়েছিল কিছু অভিজ্ঞ কংগ্রেস নেতা। কিন্তু, কোনও অজ্ঞাত কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেননি প্রিয়াঙ্কা। কয়েকদিন আগে দাদা রাহুল গান্ধী দুবাই থেকে আমেরিকা গিয়েছেন তাকে বোঝাতে, এখনই সঠিক সময় প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করার। অবশেষে, প্রিয়াঙ্কাকে রাজি করিয়ে দেশে ফিরে রাহুল ঘোষণা করলেন, পূর্ব উত্তরপ্রদেশের এআইসিসি সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত করা হল প্রিয়াঙ্কাকে। অ-বিজেপি রাজনৈতিক শিবির দাবি করছে, এই মুহূর্তে প্রিয়াঙ্কা কংগ্রেসের ‘ট্রাম্পকার্ড’। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আব্দুল্লা বলছেন, সমগ্র বিরোধী শিবিরে যেন নতুন শক্তি এল! কংগ্রেস নেতাদের দাবি, নরেন্দ্র মোদিকে পর্যুদস্ত করতে এটি রাহুল গান্ধীর ‘ব্রহ্মাস্ত্র’! উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের দুই শক্ত ঘাঁটি অমেঠী এবং রায়বরেলী। পাশাপাশি, ওই দুই এলাকা নরেন্দ্র মোদি এবং যোগী আদিত্যনাথের গড় হিসাবে দাবি করে বিজেপি শিবির। লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে আগামী দুই মাস পূর্ব উত্তরপ্রদেশের রণকৌশল তৈরি করবেন প্রিয়াঙ্কা, খবর শুনে আতশবাজি ফাটিয়ে এবং আবির মেখে উদযাপনে মাতে অমেঠী, রায়বরেলী এলাকার জনসাধারণ। দিল্লির ২৪ আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরের সামনেও উৎসবের মেজাজ। বাজি ফাটিয়ে, ঢোল বাজিয়ে, লাড্ডু বিতরণ করে উল্লাস করে কংগ্রেস শিবির। উত্তরপ্রদেশের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা এবং জোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে। এযাবৎ সমগ্র উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক গুলাম নবি আজাদ। তাকে হরিয়ানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নিজ কেন্দ্র অমেঠী থেকে ২৩ জানুয়ারি ভোট সফর শুরু করলেন রাহুল গান্ধী। সেখানে পৌঁছে তিনি বলেন, “আমার বোন দক্ষ এবং পরিশ্রমী। আমি আনন্দিত যে আমাদের সঙ্গে বোন কাজ করবে। উত্তরপ্রদেশে তরুণ নেতৃত্বের দাবি করেছিল দল, সেই দাবি পূর্ণ করা হল। কেবল মাসদুয়েকের জন্য আমরা ওকে উত্তরপ্রদেশ পাঠাচ্ছি না। গরিব, যুবক, কৃষকদের জন্য লড়াই করে বিচারধারা প্রসারিত করা আমাদের লক্ষ্য।” রাহুল গান্ধী আরও দাবি করেন, উত্তরপ্রদেশকে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী দিলাম। এবার কেন্দ্রে জোট সরকার এবং উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস সরকার দেখবে দেশ। দিনকয়েক আগে রাহুল বলেন, উত্তরপ্রদেশে ৪৪০ ভোল্ট ঝটকা দেবেন। কংগ্রেস শিবির বলছে, এটা প্রথম ধাপ। আগামী কিছুদিনের মধ্যে হয়তো তার পিতৃব্যের ছেলে বরুণ গান্ধী দীর্ঘদিনের তিক্ত সম্পর্ক ভুলে বিজেপি ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দেবে, কে বলতে পারে!
প্রিয়াঙ্কার উচ্ছ্বসিত হাসি, চুলের ছাঁট, শাড়ি পরার ধাঁচ, হাত নাড়ানোর মুদ্রা- সবেতেই ঠাকুরমা ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান অনেকে। ২০০৪ সালে রাহুল গান্ধী জীবনে প্রথমবার লোকসভা ভোটে প্রার্থী হলেন। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় জিপ-সফরে রাহুলের সঙ্গী হয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা এবং তার স্বামী রবার্ট বঢরা। হুডখোলা জিপে হাত নাড়তে-নাড়তে প্রিয়াঙ্কার হাসিমুখ দেখে অনেক গরিব আমজনতা বলতেন, “এ যেন যুবতী ইন্দিরা ফের হাজির!” ঠাকুরমার সঙ্গে সাদৃশ্য অস্বীকার করেন না প্রিয়াঙ্কা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আমার চেহারা অনেকটা ঠাকুরমার মতো। তারই রক্ত তো আমার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, তাই হয়তো আমার স্বভাবও ঠাকুরমার মতো। ছোটবেলায় এমন এক পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে তিনিই ছিলেন কর্ত্রী। আমার স্বভাবে হয়তো সেই প্রভাব পড়েছে।” তবে তার দাবি, স্বভাবের দিক থেকে তিনি বাবার স্বভাবের বেশি নিকটে, বাবার মতো নরম মেজাজের। তার স্বভাবে ‘কোমলতা’র দৃষ্টান্ত দেখেছে ভারতবাসী। রাজীব গান্ধী-হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত নলিনী মুরুগনের সঙ্গে সেলে দেখা করে ক্ষমা প্রদর্শন করার ঘটনা জনমানসে নিঃসন্দেহে একটি ‘দেবীতুল্য’ ইমেজ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। সোনিয়া-রাজীবের কন্যা হিসাবে নয়, চেহারায় ইন্দিরার সাদৃশ্য থাকার জন্য নয়; নিজ গুণে প্রিয়াঙ্কা মানুষের দরবারে সম্ভ্রম আদায়ের মতো ব্যক্তিত্ব গঠন করতে, জনমনে ক্যারিশমা তৈরি করতে একশো শতাংশ সফল। লখনউয়ের দলীয় কার্যালয়ে ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিসম্বলিত ঘরটিতে ঘষামাজা চলছে। ওই ঘরে ওঠার জন্য পৃথক সিঁড়ি ব্যবহার করতেন কেবল ইন্দিরা, দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে সেই সিঁড়িতে ধুলো জমেছে। জোরকদমে চলছে ঝাড়পোছ করার কাজ। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেস সূত্রের খবর, উপরের ঘরে উঠতে ওই সিঁড়ি ব্যবহার করবেন প্রিয়াঙ্কা। দক্ষ রাজনীতিক হিসাবে তিনি কতটা উপরে উঠতে পারবেন, ইন্দিরাকে ছুঁতে পারবেন কি না- তা আপাতত ভাবিষ্যতের গর্ভে।
অতীতে প্রিয়াঙ্কা রাজনীতি-পরিসরে কী-কী দায়দায়িত্ব সামলেছেন? ২০০৪ সাল থেকে প্রিয়াঙ্কা উত্তরপ্রদেশে রায়বরেলী কেন্দ্রে মা সোনিয়া গান্ধী এবং অমেঠী কেন্দ্রে দাদা রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। মায়ের প্রচার সচিব ছিলেন তিনি, লিখে দিতেন বক্তৃতা। এখনও তিনিই দাদা রাহুল গান্ধীর প্রধান পরামর্শদাতা। গুজরাটে বিজেপি-বিরোধী জোট, কর্ণাটকে কংগ্রেস-জেডিএস জোট গড়ার নেপথ্যে ছিলেন তিনি। গত বছর দলের ৮৪তম প্লেনারি আয়োজন, রাহুল গান্ধী সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার নেপথ্যে ছিলেন সেই তিনিই। গত বছরে ছয় রাজ্যের বিধানসভা ভোটে রণকৌশল তৈরিতে সহায়তা করেছেন দাদা রাহুলকে। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীশগঢ়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে বিস্তর দোলাচলের সময় নেপথ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। পাঞ্জাবে প্রাক্তন ক্রিকেটার নভজ্যোত সিংহ সিধুকে দলে টানতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর, ফুলপুর এবং কৈরানা বিধানসভা উপনির্বাচনে কংগ্রেসকে সপা-বসপা জোট থেকে দূরে রাখা তারই কৌশলগত সিদ্ধান্ত। প্রিয়াঙ্কাকে কেন পূর্ব উত্তরপ্রদেশের রণকৌশল তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল? কংগ্রেস শিবিরের ব্যাখ্যা, তিনি অমেঠী-রায়বরেলী এলাকায় প্রচারের সময় ঘুম ছুটে গিয়েছিল বিজেপির শীর্ষ নেতাদের। এবার তিনি মোদি-যোগীর গড়ের দায়িত্বে থাকলে অতিরিক্ত নজর দিতে বাধ্য হবে বিজেপি নেতৃত্ব। ফলে, ওই এলাকায় বিজেপির শীর্ষ নেতাদের বেঁধে রেখে রাজ্যের অন্যত্র ফায়দা নিতে পারবে কংগ্রেস। বর্তমানে সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে রায়বরেলী অঞ্চল থেকে কি তবে প্রিয়াঙ্কা লড়বেন? সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিয়ে রাহুল বলছেন, “সেটা স্থির করবে প্রিয়াঙ্কা নিজেই।” কানাঘুষো চলছে, বারাণসী কেন্দ্র থেকে খোদ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরা!
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জন্মগ্রহণ করেন। মডার্ন স্কুল অ্যান্ড কনভেন্ট অফ জিসাস অ্যান্ড মেরি থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। ইউনিভার্সিটি অফ দিল্লি থেকে স্নাতক ডিগ্রি এবং ২০১০ সালে বুদ্ধিস্ট অ্যাকাডেমি থেকে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ব্যবসায়ী রবার্ট বঢরার সঙ্গে। তাদের দুই সন্তান, পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে রাইহান ও মিরায়া। ২৩ জানুয়ারি পূর্ব উত্তরপ্রদেশের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অভিষেক হল তার। অব্যবহিত পরে স্লোগান উঠল, “দহন করেগি মোদি কা লঙ্কা, প্রিয়াঙ্কা প্রিয়াঙ্কা!”
আগামী লোকসভা ভোট পর্যন্ত মাসদুয়েক সময়টা খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছে আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসী!