রোজ সকালে চায়ের কাপ হাতে পত্রিকা দেখাটা অমিয়র অভ্যেস। নিয়মের ব্যাতিক্রম না ঘটিয়ে তাই করছিল সে। হঠাৎই একটা হেড লাইন দেখে হাতে থাকা চায়ের কাপটা কেপে উঠল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না অমিয়।
“উদিয়মান চিত্রশিল্পী অশোক রায়ের আত্মহত্যা।”
বিস্তারিত তেমন কিছুই লেখা নেই আর। শুধু জানা গেল শেষ রাতের কোনো একটা সময় নিজের ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি বেধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে সে। অমিয় আর অশোক সহপাঠী ছিলো। চারুকলায় এক সাথে পড়ত দু’জনে। অমিয় শিল্পের জগত বাদ দিয়ে পুরোদস্তর চাকুরীজিবী এখন। শিল্পী হিসেবে অশোক কখনোই তেমন উচুমানের ছিলো না। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বাবার সন্তান অশোকের বরং বেশিরভাগ সময় কাটত নেশার পেছনে। আচমকাই এক একক চিত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করল অশোক। অতিথি হিসেবে অমিয়ও গিয়েছিলো তাতে। ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হলেও মনের ভেতরটায় কেমন যেন খচখচ করছিলো অমিয়র। অশোককে সে বহুকাল চেনে। এত ভালো আকার হাত তার কখনোই ছিলো না। কিন্তু, নিজ চোখকেই বা অবিশ্বাস করে কেমন করে? প্রাইভেট ফার্মের বড় কর্তা অমিয় বেশ কবার ছবিগুলো নিয়ে অশোকের সাথে কথা বলতে গেলেই কৌশলে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেছিলো অশোক। তখনই ব্যাপারটা সুবিধার ঠেকেনি অমিয়র।
-শুনছ?
বেশ উচু গলাতেই নিজের স্ত্রী শীলাকে ডাকে অমিয়। অশোক শীলারও সহপাঠী ছিলো। শীলা ঘরে ঢুকতেই অশোকের খবরটি তাকে জানালো অমিয়।
– সে কি কথা ? অশোক কেন আত্মহত্যা করতে যাবে?
– সেটিই তো ভাবছি, এর পেছনে কোনো কিন্তু রয়েছে
– সব আত্মহত্যার পেছনেই কোনো কিন্তু থাকে অমিয়
– তা থাকে। কিন্তু ভেবে দেখো, অশোকের ত কোনো কিছুর অভাব ছিলো না। ওর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিলো নাম করা আর্টিস্ট হওয়া। প্রদর্শনিটিও ব্যাপক প্রশংসা পেল সবার কাছ থেকে। এমন সময় কেন আত্মহত্যা করতে যাবে ও? ব্যাপারটা কিছুতেই মিলছে না ।
– ফ্যামিলির ইন্টার্নাল কোনো বিষয়ও থাকতে পারে
– উহু, ফ্যামিলি লাইফে অশোক বেশ খুশিই ছিলো। বরং প্রদর্শনীটির পর চিত্রার সাথে ওর বিয়ের কথাও নাকি পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিলো শুনেছিলাম।
– তবে?
– সেটিই ভাবছি
এই ভাবনটাই পাঁচটা বছর স্থির থাকতে দেয়নি অমিয়কে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে, বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসা করে সে যে গল্পটি জেনেছে তা তার নিজেরই বিশ্বাস হতে চায়নি প্রথমে। আর তার এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মানুষ আজ জানতে পারলো অকাল প্রয়াত হতভাগা চিত্রশিল্পী সুকুমার রায়ের নাম। আজকে বহু কষ্টে সুকুমারের আঁকা ছবিগুলো জোগাড় করেছে অমিয়। কেন তা সে নিজেও জানে না। হয়ত অতৃপ্ত এক শিল্পীর আত্মাকে শান্তি দিতে। আজ সুকুমার এর একক চিত্র শিল্পের প্রদর্শনী চলছে। সেই একই গ্যালারিতে, যেখানে অশোকেরটির আয়োজন করা হয়েছিলো। মানুষের ভীড়ে দাড়ানো দায়। এ অবস্থায় বরং জেনে আসি অমিয়র বহু পরিশ্রমে আবিষ্কার করা গল্পটিকে।
সুকুমার ছিলো অশোকের স্কুল জীবনের বন্ধু। কলেজ পর্যন্ত একসাথে পড়েছে দু’জন। অশোক পুরো রাস্তা কাপিয়ে ঝকঝকে ফিয়াট গাড়িতে করে এলেও সুকুমার আসত পায়ে হেটে। ধুলায় ধুসর দু’পা। সুকুমারের বাবা ছিলেন সামান্য ব্যাংক কেরানি। সুকুমারসহ আরো তিনটি সন্তান ছিলো তার। সামান্য মাইনেতে ছ’জনের সংসার চালাতে নাভিশ্বাঃস উঠে যেত হরিপদ রায়ের। সুকুমার পড়াশোনায় গড়পরতা মানের হলেও ছবি আকার হাতটি ছিলো অসাধারণ। তা দেখে স্কুলের আর্টের শিক্ষক মিত্তির বাবু বলেছিলেন, তুই যখন ছবি আঁকিস স্বয়ং ভগবান যেন ভর করেন তোর উপর। সুকুমারেরও ইচ্ছে ছিলো খুব বড় শিল্পী হবার। কিন্তু, জীবন তো সরল পথে চলে না। আর নিন্ম মধ্যবিত্তের স্বপ্নও কোনো দিন সূয্যির আলো দেখে না। তাই ইচ্ছা থাকলেও চারুকলায় ভর্তি হওয়া হলো না সুকুমারের। নিন্ম মধ্যবিত্ত ঘরে শিল্পচর্চা বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। তাই সুকুমারও রঙ্গের কৌটো তুলে রেখে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল পড়ায় ভালো ফল করবার। কিন্তু, সবাইকে দিয়ে যদি সব হতো তাহলে পৃথিবী এত রঙিন হত কি করে ? পড়ুয়া সুকুমারকে কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেয় না শিল্পী সুকুমার। তাই দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সুকুমারের বাবা হরিপদ। একদিন বাইরে ফেলে দেন সুকুমারের সব রং আর তুলি। এত যত্নে আঁকা ছবিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে?
তার কিছুদিন পরেই সুকুমারের সাথে দেখা হয় অশোকের। দু’জনের মধ্যে যে খুব বেশি ভাব ছিলো তা না। অশোককে দেখেই ছবিগুলো বাঁচানোর বুদ্ধিটা আসে সুকুমারের মাথায়। ওদের অত বড় বাড়ি, তার এক কোনে সুকুমারের ছবিগুলোর জায়গা হবে না? সুকুমার ওকে কথাটা বলতেই অশোকও রাজি হয়ে যায়। সুকুমার চাকরির জন্য বেশ চেষ্টা করছে, একটা হয়ে যাবেই। তখন এসে ছবিগুলো অশোকের কাছ থেকে নিয়ে যাবে সে। তখন কেই বা জানত এই ছবি বিনিময়ের মধ্যেই স্থির হয়ে গেল দু’জনের প্রস্থানের গল্প?
বেশ ক’ মাস চলে গিয়েছে। বাবার চাকরির আর এক মাস আছে। এখনো সুকুমার কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেনি। পথে পথে ঘুরে সেই পুরোনো সুকুমারকে আর চেনা যায় না। বিশাল দাড়ি গোফের জঙ্গল, উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টি। কার কাছে, কোথায় জায়নি সুকুমার? কেউ চাকরি দিলো না। শেষে কে যেন বুদ্ধি দিলো ওর ছবিগুলো বেঁচে কিছু পায় কি না সে চেষ্টা করতে। চাকরির খোঁজে ছবিগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলো সুকুমার। ছবিগুলো বেঁচে যদি কিছু টাকা আসে তাতে কিছুদিন তো পার করা যাবে। বন্ধক রাখার মতনও তো তেমন কিছু নেই আর।
তার দু’দিন আগের ঘটনা। চিত্রাই বুদ্ধিটি দিয়েছিলো অশোককে। সারা জীবন চেষ্টা করলেও অমন ছবি আঁকতে পারবে না তুমি, তার চেয়ে বরং এগুলো দিয়েই নিজের নামে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করো। প্রথমে প্রবল আপত্তি তুলেছিলো অশোক। কিন্তু, বিখ্যাত হবার লোভ আর নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানত সে। তাই শেষ পর্যন্ত চিত্রার কথায় রাজি হয়ে যায় সে। পুরো গ্যালারিটাই ভাড়া করে।
সবই ঠিক চলছিলো। বিপত্তিটা বাঁধে অশোকের খোঁজে সুকুমার যখন অশোকদের বাড়ি যাচ্ছিলো তখন। পথিমধ্যেই গ্যালারিটি। তার বাইরে নিজের আঁকা একটি ছবি আর তার নিচে অশোকের প্রদর্শনির কথা লেখা দেখে হতভম্ভ হয়ে যায় সুকুমার। গ্যালারিতে ঢুকতে যাবে এমন সময়ই তাকে দেখে ফেলে অশোক। সাথে সাথে সিকিউরিটি এনে বের করে দেয় সুকুমারকে। ভয়ে, শঙ্কায় পুলিশকে ফোন দেয় অশোক। বিনা অপরাধে জেলে যায় সুকুমার।
তারপর আর সাত দিন বেঁচে ছিলো সুকুমার। এ সাত দিনে একটি কিছুও মুখে দেয়নি সে। সবাইকে দেখলেই বলত দাদা, একটা কাগজ আর একটা পেন্সিল হবে? কে সে, কোন দোষে জেলে কেউই জানত না। শেষে এক বুড়ো জেলারের মায়া হয়। সে সুকুমার কে একটি কাগজ আর পেন্সিল এনে দেয়। সেটিই ছিলো সুকুমারের আঁকা শেষ ছবি। গলায় দড়ি দিয়ে এক মানব ঝুলছে। ছবিটি এত বাস্তব দেখাচ্ছিলো যে সেই বুড়ো জেলার চমকে উঠেছিলেন। কেন সুকুমার এটি আঁকল বহুবার জিজ্ঞাস করেও উত্তর পায়নি জেলার। তার কয়েক ঘন্টা পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সুকুমার রায়।
অপর দিকে সুকুমারকে জেলে ভরেও যেন শান্তি পাচ্ছিলো না অশোক। অজানা এক ভয় তাড়া করতে শুরু করলো তাকে। অনুশোচনা, লজ্জা, ঘেন্নার ভার আর সইতে পারছিলো না অশোক। গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া ভিন্নপথ ছিলো না সামনে। ঠিক সে ভাবেই অশোক ঝুলছিলো, যেভাবে সুকুমার এঁকেছিলো।
গ্লানি কখনো মানুষকে মুক্তি দেয় না। অশোক পনেরো দিনের বেশি সইতে পারেনি, কেউ হয়তো পনেরো বছর সয়ে যান। তবে, দিন শেষে মুক্তির পথ নেই। গ্লানি আপনাকে শাস্তি দিবেই। আর সত্য? সেও কোনো দিন লুকিয়ে থাকবার জিনিস নয়। এই যে, বিনা বিচারে সুকুমারকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া, ক্ষমতাশীল বাবার সুইসাইড নোট চেপে যাওয়া কিছুই কি পেরেছে সুকুমারের গল্প লুকাতে? পারে নি। পারে না। আর তাই, ঠিক একই জায়গায়, একই ছবিগুলো দিয়ো আবারো প্রদর্শনী হচ্ছে। এবার সত্যিকারের শিল্পীর নামে। অশোক যেদিন প্রদর্শনীটির আয়োজন করে সেদিন প্রচুর ছবি বিক্রি হয়েছিলো। সুকুমারের ঘটনা প্রকাশের পর তারা একদিনের জন্য ছবিগুলো গ্যালারিতে দিয়েছে সবাই যেনো সুকুমারের শিল্পকর্ম দেখতে পারে তার জন্য।
আর হ্যাঁ, সুইসাইড নোট একটি ছিলো বৈকি। অশোকের বাবার চাপে পুলিশ তা প্রকাশ করতে পারেনি। অশোক, তার বাবার মতন মানুষরা যেমন আছেন, তেমনি অমিয়দের মত মানুষও ভগবান পাঠিয়েছেন দু’হাত ভরে। এদের মুখোশটা খুলে দেবার জন্য।
অশোকের সুইসাইট নোটে শুধু দুটো বাক্যই লেখা ছিলো
“এ গ্লানি সহ্য করবার মত নয়,
আমায় মাফ করে দিস সুকুমার…”