মানুষের জিন্দেগীই একটি শিক্ষা সফর। জনম থেকে শুরু করে মওতের আগ মূহূর্ত পর্যন্ত একজন আদমি যে কত কিছু শেখে তার ইয়াত্তা নেই। চলতি বিপিএল নানা কারণে আমাদের হতাশ করলেও এর থেকেও শেখার মেলা কিছু রয়েছে। সে সব দিকে একটু দৃষ্টি দিতে চাই।
বিপিএল এর বদৌলতে আমরা সর্বশেষ যে বিষয়টি শিখতে পেরেছি তা হলো আওয়ামী ওলামা লীগ আওয়ামী লীগের কোনো অঙ্গ সংগঠন নয়। নয়া নওবাতের কালে ওলামা লিগের আবদারে আপদের আশঙ্কা দেখা মাত্তরই আওয়ামী লীগ থেকে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। এর আগেও ওলামা লীগ বিচিত্র কিছু বয়ান দিলেও বিষয়টি এতোদিন স্পষ্ট ছিলো না। বিপিএল এক্ষেত্রে বাহবার দাবিদার।
যাই হোক ওলামা লীগ যে দাবিটা তুলেছে সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। তারা বলেছে আইপিএল, বিপিএল’র মতন আসরগুলো দেশে জুয়ার জোয়ারের জনম দেয়। কথাটি নিরেট সত্য। আইপিএল, বিপিএল শুরু মাত্তরই জুয়ায় জমজমাট আসর শুরু হয়ে যায় মহল্লার টঙ থেকে শুরু করে ফাইভ স্টারের লবিতে। এ ব্যাধি দিন দিন বেড়েই চলেছে এটাও নিরেট সত্য। একটু দেখি এ জাজবা বন্ধের জন্য এবার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি না?
চলতি আসরের শুরু থেকেই বিসিবি বেশ চেষ্টা চালাচ্ছে এ জুয়ায় মজে থাকা ব্যক্তিদের ধরতে। মাঠ থেকে, হোটেল থেকে ভিনদেশি বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের সংবাদও পেয়েছি আমরা। নজর রাখা হচ্ছে মাঠে মোবাইল হাতে অতিরিক্ত সময় কাটানো আদমিদের ওপরেও। তবু এটি থামানো যাচ্ছে না। বাস্তবতা কি বলে? দেখুন এমনিতেই আমাদের পুলিশ নানাবিধ কর্মে ব্যস্ত। ককটেল মামলার আসামি থেকে শুরু করে পুলিশের কাজে বাধা দেয়া আদমিদের পাকড়াও করতে পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। বিষয়টি এত সরলও না। এক এলাকায় একটি ককটেল ফাটাতেই অংশ নেয় শ’য়েরও ওপরে আদমি। তাদের ধরতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক।
শুধু মাত্র ঢাকার পাড়া মহল্লার ওপর নজর রাখতে গেলে সারা দেশের পুলিশ এনেও কাজ হবে না। এক কামরাঙ্গির চরেই যে কয়টি টঙ দোকান রয়েছে তার ওপর নজর রাখা কি বাস্তবেও সম্ভব? তারপরেও পুলিশ যে ভূমিকাটা রাখছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে শুধু মাত্র বিসিবি বা পুলিশের পক্ষে আসলে কিছু করার নেই, দরকার জন সচেতনতার। যে দেশে মা-বাবা সন্তানের জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্নের খোঁজে ব্যস্ত সময় পার করে সে দেশে শুধু পুলিশ দিয়ে জুয়া বন্ধের চিন্তাটাও অস্বাভাবিক। সুতরাং, বিপিএল বন্ধ করলেই যে এ ব্যধি থেকে মুক্তি মিলবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ আমি অন্তত দেখি না।
ওলামা লীগের বিপিএল বন্ধ করে জুয়া থেকে পরিত্রানের পরিকল্পনাটিকে তাই অসাড়ই বলা যায়। এ আসরে আরো দুটো সমালোচনার বিষয় হচ্ছে ধারাভাষ্য এবং আম্পারিং। এ নিয়ে আমিও সমালোচনা করেছি। তবে জ্ঞানী আদমিরা যেমনটি বলেন, সব নেতিবাচকের মাঝেও কিছু ইতিবাচক দিক থাকে, সেটি ইয়াদে রেখে ভিন্ন নজরে দেখার চেষ্টা করে দুটো বিষয় অন্তত শিখেছি। ৬৫ মিটার ছয়, যে উচ্চতায় অনেক সময় ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন, সেটিও হিউজ! বিপিএল না দেখলে বিষয়টি শিখতেই পারতাম না।
আমাদের সমাজে সব সময় মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটি বক্র কথা বলা হয়। সেটি হচ্ছে দু’জন মেয়ে একসাথে হলে কথার তোরে আসমান থেকে আদমিকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারে। মোদ্দা কথা মেয়েরা মুখই বন্ধ করতে পারে না। এটি যে শুধুই একটি গুজব তা আমরা এ বিপিএল’এ দেখেছি। স্ব-নামে খ্যাত এক আদমিকে ম্যাচের পুরো সময়টাতে পাঁচ মিনিটের জন্যও মুখ বন্ধ করতে দেখা যায় নি। শৈশব থেকে মেয়েদের প্রতি শুনে আসা এ বক্র বাক্যটি যে মিথ্যা তাও এবার শিখতে পারলাম।
ধারাভাষ্য নিয়ে যেহেতু বাত হচ্ছে তা হলে ম্যাচের মধ্যবর্তী সময়ে হাজির হওয়া উপস্থাপিকাদেরও একটু জিকর করা যাক। তারা যে ক্রিকেট জ্ঞানের গুণে নির্বাচিত হননি তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, সে বিষয়ে সাওয়াল তুলে বিব্রত না করাই বেহতার। বিপিএল যখন শুরু হয় তখন শীতের সময় ছিলো। কিন্তু তাদের পোষাকে মনে হয়েছে আসরটি হচ্ছে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রৌদ্রে! এ ধরনের পোশাক আমাদের সংস্কৃতির সাথে যায় কি না সে সাওয়ালটি মনে বেশ কবারই ঘুরপাক খেয়েছে। তবে এটির একটি সুবিধাও ছিলো। শীতকালে ঘর থেকে বের হবার আগে আদমিরা উপস্থাপিকাদের পোশাকের মাত্রা দেখে কি কাপড়ে বের হবেন সেটি সম্পর্কে একটি ধারণা পেতেন।
পোশাকের বিষয়টির অবতারণা এ জন্য করছি যে, বিপিএল যেহেতু বিদেশেও প্রচার হয় তাই আমাদের একটি ভালো সুযোগ রয়েছে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরার। সেটি উপস্থাপিকাদের মাধ্যমেও সম্ভব। সেটি বাদ দিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ দেওলিয়া মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। মজার বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়টি নিয়ে যদি বাতচিতে যান যে বয়ানটি শুনবেন তা হলো, যুগের সাথে তাল মেলাতেই এই ভূষণ! এর চেয়ে মজার হচ্ছে এই মানুষটিই পয়লা বৈশাখে বাঙালি সাজে সেজে বাঙালি সংস্কৃতি কতটা বর্ণিল তা বয়ানে জি জান লাগিয়ে দিবেন! বড়ই সেকুলাস।
এবার একটু আম্পায়রদের দিকে নজর দেয়া যাক। জিন্দেগীভর ওয়াইডের যা নিয়ম আমরা জেনে এসেছি তা যে কতটা ভুল তা বিপিএল থেকে আমরা শিখছি। বল ব্যাটে লাগার পরেও ওয়াইড কল করা যে সম্ভব তা বিপিএল না দেখলে বোধকরি জানা হতো না। ছোট বেলায় আমরা পাড়া মহল্লায় যে সব টুর্নামেন্ট খেলতাম তাতে কমিটির টিম বলে একটা টিম থাকতো। স্বভাবতই আম্পায়াররা কমিটির দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতেন। তখন অপর পক্ষের খেলোয়াড়রা যেন নিমরাজি হয়েই বিষয়টা মেনে নিতেন। এবার, এনামুল যেভাবে মেহেদীকে বোলিংয়ে ফিড়িয়েছিলেন তা শৈশবের সে স্মৃতিই মনে করিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় পর্যায়েও যে কমিটির দলের মত আম্পায়ারিং হয় তাও আমরা এবার শিখলাম। একই সাথে কমিটির টিম বিষয়টি ইয়াদে এনে দেয়ার জন্যও শুকরিয়া আদায় করছি আম্পায়ারদের।
খেলার আসরে খেলার খবরের চেয়ে বেখবরই বেশি হয়ে যাচ্ছে। শেষ করার আগে একটু খেলারও জিকর করি। বিপিএল এর মাঝেই ঘোষণা করা হয়েছে আসন্ন নিউজিল্যান্ড সফরের দল। এখানে বিপিএল’র পারফর্ম্যান্সকে যেরুপে বিবেচনা করা হয়েছে সেটিও বিস্ময়করই বলা যায়। বিপিএল’র জেরেই দলে ফিরেছেন তাসকিন এবং সাব্বির। এটা নিয়ে সমালোচনা নেই। তাসকিন নিজেকে বেশ ভালো ভাবেই প্রমাণ করেছেন এ আসরে। কিন্তু যে আদমির ওপর ফ্রাঞ্চাইজিই পুরো ভরসা রাখতে না পেরে দু’ম্যাচ বসিয়ে রেখেছিল, সে সৌম্যকে দেখাটাকে বিস্ময়কর বললেও বোধকরি কম হয়।
আসলে, এ আসরই আরো একবার প্রমাণ করলো সৌম্যের জন্য পার্ফরম্যান্স কোনো নিয়ামক না। নতুবা, জাতীয় দলের হয়ে একটি সিরিজ অ্যাভারেজ পার্ফরম্যান্স জন্য বাদ পরা ইমরুল বিপিএল’এ সৌম্যের চেয়েও ভালো খেলে বাদ পরেন কি কারণে? যে ব্যাক্তির পুরো আসরের মোট রানই এখনো পঞ্চাশের কম, তিনি অবলীলায় দলে সুযোগ পেয়ে যান, আর এক ইনিংসেই তার সমান রান করেও বাকিরা থাকেন উপেক্ষিত। এ বিষয়ে সাওয়াল তুলেও আর লাভ নেই, সেই ফাটা রেকর্ডই বাজে নিয়ত।
নিজেদের ওপর হতাশ না হয়ে তারা বরং সৌম্যের কাছ থেকে সালাহ নিতে পারেন। তাতে যদি কিছু হয়। যাই হোক, চলতি বিপিএল প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শংকরের ইয়াদ এনে দিচ্ছে। কোর্ট পাড়ায় বিস্ময়ে বিস্ময়াভূত হয়ে তিনি যেমন লিখেছিলেন ‘কত অজানা রে’ তেমনি চলতি বিপিএল দেখে আমারও মনে হচ্ছে কত কিছুই অজানাই ছিল জীবনে। সে হিসাবে বিপিএল’র একটি ধন্যবাদ প্রাপ্যই বলা যায়।