রাতারাতি ক্রিকেটের অনুঃপ্রবেশ ঘটলো টি টোয়েন্টির ছোট সংস্করণে। সেই স্রোতে গা ভাসাতেও সময় লাগল না কারো। ফ্রাঞ্জাইজি থেকে শুরু করে দর্শক ও সমর্থকদের উত্তেজনায় এটিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) সহ বিভিন্ন লিগে চলছে তারকাদের জমজমাট আসর। এই আসরকে কেন্দ্র করে সবার যতটা উত্তেজনা, তাতে বেশিরভাগ মানুষের মাঝেই ভ্রান্ত ধারণা টি টোয়েন্টি আসরকে ঘিরে চলছে টাকার খেলা। কিন্তু আসলেই কি এখানে টাকার খেলা নাকি পুরোটাই মিথ?
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা ঘরোয়া টি টোয়েন্টি লিগগুলো এখন পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চলেছে। এই টুর্নামেন্টগুলো কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে নয়, বরং ঘরোয়া বিভিন্ন টুর্নামেন্টের সাথে দর্শক ধরে রাখা ও টিভিস্বত্বের জন্য প্রতিযোগিতা করে চলেছে। ২০১৭ সাল থেকেই অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ (বিবিএল) বিস্তৃত হয়েছে, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আগামী কয়েক বছরে আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে, এর সাথে আরো দল এবং ম্যাচ যুক্ত হবে। টি টোয়েন্টি বিস্ফোরণের এই সময়ে ২০২০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় টি টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা থাকবে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আইপিএল এর পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সম্প্রচার ও ডিজিটাল অধিকার ২.৫৫ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা হয়েছিল, যা প্রতি ম্যাচ জুড়ে বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক স্পোর্টস লিগের অন্যতম। কিন্তু আইপিএল বাদে খুব অল্প টি টোয়েন্টি দল বা লিগ লাভ করে। এমনকি বিবিএল যা বিশ্বব্যাপী সেরা রানের টি টোয়েন্টি লিগ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত তারাও প্রথম পাঁচ বছরে ৩৩ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অনেক লিগের পক্ষ থেকেই বলা হয়, তারা কমপক্ষে সাতটি আন্তর্জাতিক সম্প্রচারকে আকর্ষণ করতে পারে। যে দাবিকে একেবারেই অমূলক বলেছেন স্বয়ং ক্রিকেট সম্প্রচারের অন্যতম সিনিয়র ব্যক্তিদের একজন। টি-টোয়েন্টি লিগের ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, এটি বর্তমানের মত হবে না। ২০০৩ সালে টি টোয়েন্টি উন্মাদনা শুরু হওয়ার পর থেকে, প্রশাসনিক বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে লিগগুলো ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। আইপিএলই প্রথম দেশের মানুষের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভারতকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়েছে। যদিও বেশিরভাগ দল নতুন সম্প্রচার চুক্তির আগে ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক মুনাফা অর্জন করে না। অন্যদিকের চিত্র ভিন্ন। দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লিগে, লিগটি শুরু হওয়ার আগেই একজন বিনিয়োগকারী ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন এই প্রতিযোগিতা শুরু থেকে নয় বরং তৃতীয় মৌসুম থেকে মুনাফা অর্জন শুরু করবে। সিপিএল পাঁচ বছরে অর্থ হারিয়েছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের জন্য বিপিএল সাধারণ প্রক্রিয়ায় লাভ করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দল বছরে ১-১.৫ মিলিয়ন ডলার হারায়। একইভাবে পাকিস্তানের সুপার লিগ পাকিস্তান বোর্ডের জন্য বছরে ২.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে, তবে ছয়টি দল বছরে কমপক্ষে ১ মিলিয়ন ডলার হারায়। ক্যারিবীয় লিগ তার সম্প্রচার এবং বাণিজ্যিক আয়ের কেবল ৩৫% বহিঃর্বিশ্বে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে।
আইপিএল নিয়ে ভাবনার কিছু না থাকলেও এর সাফল্যেরও গণ্ডিও সীমিত। তবে বিবিএলের উন্নয়নের জন্য এখন কাজ করাটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। বিবিএলের উদ্দেশ্য ছিল ক্রিকেটের প্রতি অনাগ্রহীদের আগ্রহী করে তোলা। মূলত, টি টোয়েন্টি লিগগুলোই চালু হয়েছে খেলাধুলার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো ও অবশ্যই বানিজ্যিকীকরণের জন্য। অন্যান্য লিগগুলি আইপিএলের ব্যক্তিগত মালিকানা মডেল অনুসরণ করলেও তারা তাদের প্রথমিক বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে অধৈর্য্যশীল। লিগগুলির ব্যবসায়িক মূলনীতি ত্রুটিযুক্ত কারণ অপারেটিং খরচ অনেক বেশি। প্রত্যেকেই বিনিয়োগকৃত টাকা উসুল করতে পারে না। তাই এখানে থাকার জন্য কোনো উৎসাহ পান না। এক্ষেত্রে দলগুলো খরচ কমানোয় নজর দিতে পারে। কিন্তু তাতে খেলোয়াড়দের বেতন কমে যাবে। ফলে তারা বিদেশি লিগগুলোর প্রতি আগ্রহ হারাবে। এই সমস্যার সহজ কোনো সমাধান নেই।তবুও অনেক ক্লাব আরো উপার্জন করার উপায় খুঁজে পেয়েছে, যা অন্য দলগুলির জন্য দারুণ সহায়ক হবে। যেমন বিবিএলের দল মেলবোর্ন এবং সিডনি উভয় দলই এক মৌসুমে অন্তত দুইবার একে অপরের মুখোমুখি হয়। যার মাধ্যমে দলগুলো তাদের প্রতিপক্ষকে উত্থানের সুযোগ দেয়। এবং একই সাথে বাড়তি উপার্জনও করে। বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাদের আয় বাড়াতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত। টিমগুলো স্পন্সর পাওয়ার লক্ষ্যে ভক্ত ও সমর্থকদের তথ্য সংগ্রহ করছে। লিগগুলি মিডিয়াকে কাজে লাগানোর নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে। সিপিএল ২০১৭ সালের মৌসুম থেকেই ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং শুরু করেছে। যার মাধ্যমে নতুন সমর্থক যোগ হচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও প্রদানে মনোযোগ দিচ্ছে। আশার কথা হলো, স্যাটেলাইটের বৃদ্ধি এবং লাইভ স্ট্রিমিংয়ে মানুষের আগ্রহ এই প্রতিযোগিতায় থাকা লিগগুলোর প্রতিযোগিতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আইপিএলের কথাই ধরা যাক। মানুষের আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই ফেসবুক কতৃপক্ষ পাঁচ বছর আইপিএলের ম্যাচ লাইভ দেখানোর জন্য ৬১০ মিলিয়ন ডলার বিড করেছিল। পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল ) দল ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের প্রধান অপারেটিং অফিসার শোয়েব নাভেদের মতে, এখানে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা একটি অবিরত প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যেতে হয়। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, স্পন্সরদের আস্থা অর্জন করে মুনাফা অর্জন করতে আরো কয়েক বছর সময়ের দরকার।
মুনাফা অর্জনই কি মূখ্য উদ্দেশ্য? ফুটবলের কথাই ধরা যাক। এখন পর্যন্ত লিগের ইতিহাসে বেশিরভাগ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। যারা একটি দল কিনে প্রায় সবাই চায় খেলার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করতে। সেক্ষেত্রে একটি দলের মালিকানা অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি পরিচিতিও এনে দেয়।যেমন, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার আগে সাধারণ জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য জর্জ ডব্লিউ বুশ টেক্সাস রাঙ্গার্স নামে একটি দলে বিনিয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের অধিকাংশ দলের মালিকানা দেশের শিল্পপতিদের হাতে। তাদের বেশিরভাগেরই দাবি, বিপিএল বর্তমান মডেল অর্থ উপার্জনের জন্য এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। ঢাকা ডায়নামাইটসের একজন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে বলেন, “বর্তমান বিপিএল মডেলটি অর্থ উপার্জন মডেল নয়। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি এবং বিপিএলের সাথে আলোচনা করছি। আমরা তাদের বেশ কয়েকবার লিখেছি। তারা বলেছিল, তারা বসে আলোচনা করবে, কিন্তু কিছুই ঘটেনি।”
শুধু বিপিএলে নয়। এই সমস্যা পুরো বিশ্বের লিগজুড়ে চলছে। দলগুলোর মালিকেরা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চেয়ে আসছে। এমনকি, দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন মুল্লুকের ক্রীড়া ক্ষেত্রে মামলাও ঝুলেছিল। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লিগ চালু হচ্ছে। ২০২০ সালে বিশ্ব টি টোয়েন্টি ফিরে আসলে, লিগের স্থানকে আরো সংকুচিত করবে। তাছাড়া, আইপিএলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, বিবিএল এবং সম্ভাব্য নতুন ইংলিশ প্রতিযোগিতা অন্যান্য লিগের আয়ের ক্ষেত্রে হুমকির মুখে ফেলবে।