ওমর শাহিদ হামিদ ( জন্ম : ১৯৭৭) পাকিস্তানি কথা সাহিত্যিক। খুবই কম সময়ের মধ্যে এবং মাত্র তিনটি গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রধান ‘ক্রাইম ফিকশন’ লেখক হয়ে উঠেছেন। তার উপন্যাসে পুলিশের কাউন্টার-টেরোরিজম বিভাগে কাটানো ১৩ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার চিত্রায়ণ থাকায় তিনি পাঠকদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তার গ্রন্থগুলো হলো : দ্য প্রিজনার (২০১৩), দ্য স্পিনার’স টেল (২০১৫) এবং দ্য পার্টি ওয়ার্কার (২০১৭)।
চাকরি জীবনে ওমর শাহিদ হামিদ বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন। ২০০৫ সালে তিনি সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন এবং ২০১০ সালে অল্পের জন্য বেঁচে যান, যখন তার অফিসে বোমা হামলা হয়। ওমর শাহিদ হামিদের লেখায় পাকিস্তানের অন্ধকার রাজনীতি, সশস্ত্র সংগ্রাম, সামরিক তথা পুলিশের কর্মকাণ্ড, রাজধানীর অরাজক পরিস্থিতি সবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে যে সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করা হয়েছে সেটি মূলত ২০১৬ সালের, তখন পর্যন্ত তার দ্য পার্টি ওয়ার্কার প্রকাশিত হয়নি। পাকিস্তানি সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘পেপারকাটস’কে দেয়া সাক্ষাৎকারটিতে তিনি তার পুলিশে অভিজ্ঞতার সাথে তার উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাক্ষাৎকারটি জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, তুহিন মোহাম্মদ।
পেপারকাটস: মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আপনি নিজেকে পাকিস্তানের প্রধান ক্রাইম ফিকশন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আপনার ওই ফিল্ডে অভিজ্ঞতার বিষয়টিই কি আপনার পাঠকদের কল্পনায় আগ্রহী করে তোলে? কিভাবে আপনার পাকিস্তান পুলিশ ফোর্সে— বিশেষ করে অ্যান্টি-টেরর সেলের জীবন আপনার লেখায় উঠে এসেছে?
ওমর শাহিদ হামিদ : যা কিছু আমি লিখি তার সবই আমার পুলিশে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। নিজের ডিপার্টমেন্টকে বোঝা, করাচির অন্তর্ভাগকে বোঝা এবং বোঝা কিভাবে এটি কাজ করে এবং কতটা অন্ধকারে, কিভাবে এটি নির্দোষ ব্যক্তিকে উস্কানি দেয়— এই সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি আমি পুলিশে থাকাকালীন সময়ে অর্জন করেছি। আমি সংশয় ছাড়াই বলতে পারি, আমি যদি পুলিশে না থাকতাম তবে কখনোই লেখক হতে পারতাম না।
একটা প্রবাদ আছে— সত্য কথাসাহিত্যের চেয়ে শক্তিশালী। আপনার ফিকশনগুলো কতটুকু বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে? সেগুলো কি বাস্তব চরিত্রানুরাগী, যদি তাই হয়। তাহলে আপনি কিভাবে বাস্তব এবং ফিকশনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন?
আমার বেশিরভাগ চরিত্র এবং আবহই বাস্তব জীবনের অনুপ্রেরণায় তৈরি। পরিণতি কখনো কখনো বাস্তবের প্রতিচ্ছবি নয় কিন্তু আমার পুলিশ অফিসার হিসেবে পেশাদারি অভিজ্ঞতা আমাকে ফিকশনাল স্পেস তৈরি করতে ভুরি ভুরি তথ্য দিয়েছে।
একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী জনগণের কল্পনায় দুর্নীতি ও অযোগ্যতার প্রতিশব্দ। আপনার কি মনে হয় আপনার বই কিছুটা হলেও পুলিশ বাহিনীর ইমেজ পুনর্বাসন এবং এর নায়কোচিত র্যাংকিং পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে? এটি কি আপনার ইনটেনশন ছিল কি না?
যখন আমি লেখালেখি শুরু করি, পুলিশের জন্য পুনর্বাসন বার্তা রাখাটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু আমি তাদের সঠিক আলোতে দেখানোর চেষ্টা করি। সমাজে, আমাদের বহু ধারণা এবং মতামত ব্যাঙ্গাত্মক বর্ণনার উপর তৈরি হয়, বিশেষ করে আমাদের পুলিশ বাহিনীর জন্য এটি সত্য। বিশ্বের যে কোন স্থানে পুলিশিং একটি অবিশ্বাস্য কঠিন পেশা, তবে বিশেষ করে পাকিস্তানে— এবং হ্যাঁ, অনেক অফিসারই তাদের নির্বুদ্ধিতা, দূর্নীতি এবং সাধারণের জন্য সহানুভূতির অভাব থাকার কারণে জনগণের সমালোচনার যোগ্য। আমি প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস করি, অনেক পুলিশ অফিসার আছেন যারা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং প্রতিনিয়তই অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছেন।
এই বিষয়টি আপনাকে আঘাত করবে, যখন আপনি এমন কোন পুলিশ অফিসারের বাড়ি যাবেন যিনি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। আপনি তার কঠোর জীবনের মুখোমুখি হবেন, এমনকি সে বাচ্চাদের স্কুলের ফি’র জন্য সংগ্রাম করেছে। এবং আপনি চিন্তা করেন, কেউ অবৈধ অর্থোপার্জনের জন্য নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে? বিশেষভাবে যখন সে জানে যে ডিপার্টমেন্ট কখনোই তার পরিবারের সঠিক দেখভাল করবে না? যখন সত্যিকার অর্থে এরকম কিছু ঘটে, বোঝা যায় এই মানুষগুলো কতটা এক্সট্রা-অর্ডিনারি।
‘দি প্রিজনার’এ আপনি করাচির মত বৃহৎ মেট্রোপলিটন শহরের পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন, এবং উপন্যাসটি এই শহরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় ভরপুর, পরিত্যক্ত বস্তি থেকে প্রকাণ্ড প্রাসাদের বর্ণনা পর্যন্ত রয়েছে। এই পরিবেশ কিভাবে আপনার গল্পে প্রভাব বিস্তার করেছে?
পাঠক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, যেকোন লেখক তার পাঠককে যে পৃথিবী বা স্থান দেখাতে চায় তা পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। ক্ষুদ্র কিছুও, এবং মুহূর্তে মনোযোগ কাড়তে পারে এমন কিছুও। আপনি লে ক্যারি পড়লে সরকারি অফিসের পুরনো ফাইলের গন্ধ পেতে পারেন। আপনি জেফারি আর্চার’র ‘ফার্স্ট অ্যামাং ইকুয়াল’ পড়ুন দেখবেন আপনি নিজেকে যুক্তরাজ্যের সংসদের একজন দর্শক হিসেবে ভাবতে পারবেন। আমার মধ্যে এই ধরনের বইয়ের সর্বাধিক প্রভাব রয়েছে। একজন লেখক হিসেবে আমি চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব আমার পাঠককে যাত্রায় সামিল করাতে। সুতরাং আমার জন্য গল্পের কাঠামোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি এই কাঠামো বা সেটিংসটা সঠিকভাবে করতে না পারেন তাহলে গল্পটি অসামঞ্জস্য ও বিরক্তিকর হতে সহজ হয়ে যায়।
‘দ্য স্পিনার টেল’ উপন্যাসে ওমর আব্বাসীর মতো অমায়িক পুলিশ অফিসারকে দাঁড় করানো হয়েছে শেখ আহমেদ উজাইর সুফির প্রলোভনসঙ্কুল নিষ্ঠুরতার বর্ণনায়। একজন নৃশংস সন্ত্রাসী হিসেবে শেখ সুফি’র প্রতিষ্ঠা ছাড়াও আমরা বলে থাকি ‘তিনি তার ধর্মান্ধ ভক্তদের জন্য চুম্বকস্বরূপ’। এই উপন্যাসে, আপনি শেখের বিগত জীবনের কাহিনী আপনার পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে যথেষ্ঠ দায় বোধ করেছেন। এমনকি তার ‘এডি’কে লেখা পুরনো চিঠির মধ্য দিয়ে তাকে কথা বলার বিশেষ সুবিধাও দিয়েছেন। আপনার কাছে কেন মনে হয়েছে এটা গুরুত্বপূর্ণ?
আমি এই উপন্যাসে, কীভাবে একজন সাধারণ ব্যক্তি শয়তানের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে— তাই-ই দেখাতে চেয়েছি। আমি নিশ্চিত, একটা সময় ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ফজলুল্লাহর মতো আধুনিক কালের সমস্ত দানবেরা তুলনামূলকভাবে ‘সাধারণ’ হিসেবেই শুরু করেছিলেন। এটি নিশ্চিত জীবনের কোন একটি মোড়, হতে পারে কিছু মানুষের জন্য, কোন বিশৃঙ্খলা কিংবা সহিংসতার পূর্বাভাস— তাদের তৈরি করেছে, যা তারা আজ করছে। আমি এই ধরনের রূপান্তরের উপর কয়েকটি বই পড়েছি। কিন্তু আমি মনে করি না, তারা এই প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি ক্যাপচার করতে সক্ষম হয়েছে। এটাই কারণ, কেন আমি শেখ আহমেদ উজাইর সুফির পেছনের গল্প চিত্রায়িত করেছি, তার মাঝের সুশৃঙ্খল পরিবর্তন দেখিয়েছি। এমনকি তা গল্পের গতিকে ধীর করলেও আমি তা দেখিয়েছি।
শেখ উজাইর’র চুম্বকত্ব অংশের বিষয়টি হলো এই যে, ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম সহিংসতার সর্বোচ্চ জিহাদি হওয়ার পরও তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন এবং রমজান মাসে রোজা রাখতেন, আসলে একজন ‘ধার্মিক’ মুসলমানের সমস্ত গুনাবলিই তার মধ্যে ছিল। তিনি তার সমর্থকদের কাছে নায়ক, অন্যদের কাছে সন্ত্রাসী। কীভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ‘হিরোইজম’র মানদণ্ড পরিবর্তন করেছে?
ধর্মীয় চরমপন্থা— যে কোনও ফর্ম অথবা বিশ্বাসের জন্য, তা ইসলামের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। কারণ এটি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট প্রিজমের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে দেখা- এটি সর্বদা এর নায়কদের শ্রেণিভুক্ত করে যা আসলে ওইভাবে সামঞ্জস্য নয় যেভাবে আমি আপনি ‘নায়ক’দের সংজ্ঞায়িত করি। উদাহরণস্বরূপ আপনি ওই মতাদর্শের কিছু মানুষের সাথে আন্তরিকতার সাথে কথা বলুন, দেখবেন— তারা বিশ্বাস করে ওসামা বিন লাদেন অথবা মুমতাজ কাদরীরা নায়ক। এরকমটা ইতিহাসের সমস্ত ধর্মীয় চরপন্থীদের বেলায় ঘটেছে। এটি নতুন কোন ফেনোমেনন নয়। তাদের নায়কেরা প্রায়ই ভিন্ন, খুবই ভিন্ন।