টেস্ট নাকি টি টোয়েন্টি; কোনটি হবে ক্রিকেটের ভবিষ্যত সম্রাট তা নিয়ে বিগত কয়েক বছরে বেশ আলোচনা হয়েছে। বর্তমানেও এ আলোচনা চলছে, নিকট ভবিষ্যতেও হবে। টি টোয়েন্টি আগ্রাসনে অস্তিত্বের মুখে পড়বে টেস্ট; এমনটিই বলেছেন টেস্টের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত বিশ্লেষকরা। টি টোয়েন্টি বলতে আসলে এখানে বোঝানো হয়েছে ঘরোয়া আসরগুলো, বিগত কয়েক বছরে আমরা যার আগ্রাসন লক্ষ্য করছি। কিন্তু, আমি বরং ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগগুলোর ভবিষ্যত নিয়েই সন্দিহান। আচানক কেন এই সংশয়ের সৃষ্টি বিশদ আলোচনা করবো সে বিষয়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কিন্তু সে অর্থে টি টোয়েন্টি খেলা হয় না। ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলো বাদ দিলে বেশিভাগ দলের দ্বিপাক্ষিক সফরে টি টোয়েন্টি থাকে সাকুল্যে একটি। তবু, টি টোয়েন্টিকে টেস্টের জন্য হুমকি মনে করার পিছনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলো বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া টি টোয়েন্টির আসরগুলো। আরো স্পষ্ট করে বললে আইপিএল। বিগ ব্যাশ বা বিপিএলকে আমরা যতই জনপ্রিয় সাবুদের চেষ্টা করি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে আকর্ষনের দিক বলুন বা বাজার, কোনো দিকেই আইপিএল এর কাছাকাছি কেউ নেই। মজার বিষয় হচ্ছে টি টোয়েন্টির ভবিষ্যত এর পয়লা ধাক্কাটি দিয়েছে কিন্তু এই আইপিএলই। বোধ করি সেটি হয়েছে কর্তাদের অজান্তেই।
টি টোয়েন্টির সবচেয়ে বড় ফেরিওয়ালা বলা হয় ক্যারাবিয়ান তারকা ক্রিস গেইলকে। সূচনা লগ্ন থেকেই আইপিএল মাত করছেন তিনি। আসন্ন আইপিএল এর নিলামে মুদ্রার অপর পিঠটিও দেখেছেন ক্যারিবিয়ান দানব। এবারের নিলামের শুরুতে গেইলে আগ্রহ দেখায়নি কোনো দলই। চূড়ান্ত ধাক্কা থেকে তাকে রক্ষা করেছে প্রীতি জিনতার পাঞ্জাব। গেইলের মত মহাতারকা যখন এক মৌসুম নিষ্প্রভ থাকার দায়ে দলই খুজে পাননা তখন সেটি বাকিদের জন্য অশনি সংকেতই বলা যায়। কেন এমনটি বলছি? টি টোয়েন্টির ঘরোয়া আসরগুলো জনপ্রিয় করার পিছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররা। জাতীয় দলের চুক্তির শৃঙ্খলে বাধা পরার চেয়ে তাদের কাছে আকর্ষনিয় ঠেকেছে ফ্রি ল্যান্সার হয়ে বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া লিগ মাত করাটাই। পয়লা এ বিষয়টি নিয়েই কথা বলা যাক।
ফ্রি ল্যান্সার ক্রিকেটারদের আপাত দৃষ্টিতে স্বাধীন বলে মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যেহেতু তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলেন না, তাই ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগ গুলোতে বাড়তি পারফর্ম এর দায় থাকে তাদের ওপর। কেননা, এ আসর গুলোর সাফল্যের ওপরই নির্ভর করে তাদের চাহিদা। ফ্রাঞ্চাইজি গুলো কখনোই জাতীয় দলের মত যত্নশীল হয় না। যেহেতু তারা এসব আসরে অংশই নেয় মুনাফার জন্য তাই তাদের কাছে একজন খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশী প্রাধান্য পায় নিজেদের স্বার্থ। সে জন্য গেইলের মত তারকাও এক আসরে ব্যর্থতার জন্য হয়ে পরেন ব্রাত্য। আইপিএল এ খারাপ খেলা একজন হয়তো অন্য কোনো আসরে সুযোগ খুজবেন নিজেকে পুনরায় প্রমাণ করার। কিন্তু, যেহেতু তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলেন না, বা সে অর্থে অন্য সব ঘরোয়া আসরেও অংশ নেন না, তাই তাদের পরখ করার সুযোগ সে অর্থে থাকে না। তাই, ফ্রাঞ্চাইজি গুলো নামের বদলে ঝুকে পরে ফর্মে থাকা খেলোয়াড়দের দিকে। আইপিএল এই যেটি আমরা দেখেছি মোস্তাফিজের বেলায়।
বেশিভাগ ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগেই চারজন বিদেশি খেলানো হয়ে থাকে। চার জনের বিপরীতে প্রত্যেকটি দলই একাধিক তারকা ভিড়িয়ে থাকে সাফল্যের আশায়। এমন অবস্থায় দুটি ম্যাচ খারাপ করলেই পুরো আসর দর্শক হয়ে কাটানোর আশঙ্কা থাকে। আরো যে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে, তা হলো প্রত্যেকটি লিগই হয় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন কন্ডিশনে। একটি দলের সাথে আরেকটি দলের কোনো মিলই থাকে না। এ অবস্থায় একজন ক্রিকেটারের জন্য মানিয়ে নেয়াটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে সাথে থাকে ভ্রমণ ক্লান্তি। এ অবস্থায় শুরুর দিকে একজন খেলোয়াড় ব্যর্থ হতেই পারেন। কিন্তু এ সব আসরে ক্রিকেটিয় বেসিকের পাশ দিয়েও যাওয়া হয় না। টানা ধকলের ফলে ইনজুরীও স্বাভাবিক একটি বিষয়। টে টোয়েন্টির আরেক ফেরিওলা ইংলিশ ক্রিকেটার ওয়াইস শাহ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ফ্রাঞ্চাইজিরা খেলোয়াড়ের চেয়ে প্রাধাণ্য দেয় নিজেদের স্বার্থটাকে। যার ফলে অনেক সময়ই আঘাত প্রাপ্ত খেলোয়াড়ের সঠিক পরিচর্যা হয় না। এসকল দিক মাথায় রেখেই এতদিন টি টোয়েন্টি মাত করে গিয়েছেন গেইল এন্ড কং।
এ আসরগুলোর আরো একটি অন্যতম আশঙ্কার দিক হচ্ছে আর্থিক দিক। আইপিএল ব্যতীত অন্য কোনো লিগের কোনো দলই বৈধ উপায়ে লাভ দেখাতে পারছে না। বিভিন্ন সূত্র মতে দলগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক মিলিয়ন ডলারের ওপরে। মজার বিষয় হচ্ছে, দলগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হলেও প্রত্যেকটি বোর্ডই কিন্তু এ আসরগুলো থেকে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। যার নগণ্য অংশ পাচ্ছেন ক্রিকেটাররা। আমরা যদি বিপিএল এর কথাই ধরি, পয়লা আসরে টাইটেল স্পন্সর এবং প্রচার স্বত্ত্ব বিক্রি করে বিসিবি যা কামিয়েছিলো বর্তমানে তা বেশ বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, বিসিবি বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম ধণী ক্রিকেট বোর্ড। এর পিছনে যে বিপিএল এর বিশাল ভূমিকা রয়েছে তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, বিপিএল এ খেলোয়াড়দের আয় কতটা বেড়েছে? নিলাম বিষয়টার আমি ঘোর বিরোধী, তবে তার বিকল্প হিসাবে প্লেয়ার্স ড্রাফট নামক বিদঘুটে নিয়মের আরো বেশি। কেননা, এটাতে একজন খেলোয়াড়ের স্বাধীনতা চূড়ান্তভাবে খর্ব হয়। হ্যা, নিলাম নিয়ে বিপিএল এ কী ঘটেছিলো সেটি আমাদের ইয়াদ রয়েছে, কিন্তু তার বিকল্প প্লেয়ার্স ড্রফট হতে পারে না।
বিপিএল থেকে বোর্ড যেখানে বিশাল অঙ্কের অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে সেখানে খেলোয়াড়দের দাম বেধে দেয়া বেশ মজারই বলা যায়। বিপিএল শুধু উদাহারণ হিসাবে ব্যবহার করলাম, এরকম চিত্র সবখানেই। মজাটা হচ্ছে আর্থিক লোকসানের ফিরিস্তি দিলেও কোনো ফ্রাঞ্চাইজি কিন্তু পিছু হটছে না, এটি কিন্তু এক ধরনের সন্দেহের জনম দেয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলো এসব আসরে লগ্নি করছে তাদের ব্যবসায়ীক সাফল্যের কথা সকলের জ্ঞাত। তো, এই ঝানু ব্যবসায়ীরা ফি বছর বিশাল অঙ্কের লোকসান গুনবেন কোনো কারন ছাড়াই এটা ইয়াকিন করার কোনো কারন আমি অন্তত দেখি না। এখানে তাদের ক্রিকেট প্রেমকে কেউ যদি সামনে আনতে চান তবে তা ধোপে টিকবে না। কেননা, বছরের একটি সময় বাদে কোনো দলকেই ক্রিকেটের জন্য কিছু করতে দেখা যায় না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে এখানে এমন কিছু রয়েছে যা বেশ লোভনীয়। সে জন্যই কাগজে কলমে লোকসান দেখালেও কেউই সড়ে যাচ্ছে না।
এখন এ বিষয়টি খেলোয়াড়দের নজরে আসবে না বলে মনে করার কোনো কারন নেই। ফ্রাঞ্চাইজিগুলো লোকসানের বিষয়টা সামনে আনছে মূলত দুটো কারনে, ১) যতটা সম্ভব কর ফাঁকি দেয়া এবং ২) এ সুযোগে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক কমানো। কর কমানোর বিষয়টি ইতোমধ্যেই আলোচনায় এসেছে পিএসএল এর দলগুলোর কল্যাণে। যেখানে তারা আর্থিক লোকসানের বিষয়টা সামনে এনে কর কমানোর আবেদন করেছে। আর এ সব মুনাফা লোভি ব্যবসায়ীদের চরিত্র আমাদের বেশ চেনা। এ ক্ষতির জিকির তুলে তারা চেষ্টা করবেন খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক কমানোর। এমনটি কিন্তু আমরা বিপিএল এর বেলাতেই দেখেছি। এটা বেশ স্পষ্ট যে, যাদের কল্যানে এই অর্থের মচ্ছব সে খেলোয়াড়রাই রয়েছেন সবচেয়ে ঝুকিতে। এমন অবস্থায় আচমকাই যদি দৃশ্যের পরিবর্তন হয় তবে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ আসরগুলোর বাজার। অধিক আহারে রুচী নষ্টের মতন অবস্থা সৃষ্টি করেছে এ আসরগুলো। বছর জুড়েই টি টোয়েন্টি চলার ফলে ইদানিং দর্শকদের আগ্রহের কমতি কিন্তু দেখা যাচ্ছে। চলতি বিপিএল এ আসরের ইতিহাসের সবচেয়ে কম দর্শক দেখছে এবার। অথচ, আইপিএল এর পরে যে কটি আসরের বাজার বড় বলে আমরা এতদিন শুনে এসেছি বিপিএল তার মধ্যে অন্যতম। এবার শুধু মাঠেই না, মাঠের বাইরেও সে অর্থে আলোচনায় নেই আসরটি। অন্যতম জনপ্রিয় বলা যে আসরটিকে তার এ হালতকে হতাশারই বলা যায়। বাজার হারানোর সরাসরি প্রভাব কিন্তু আয়োজকদের ওপর পরবে। কমে যাবে স্পন্সর মানি এবং প্রচার স্বত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থও। আর এমনটি অব্যাহত থাকলে তা আসরের ললাটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন একে দেবে।
শ্রীলঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ কিন্তু ইতোমধ্যেই বন্ধ্য হয়ে গিয়েছে। সাউথ আফ্রিকা বা পাকিস্তানের আসরগুলোও কোনো আশা জাগানীয়া তথ্য দিতে পারছে না। শুধু মাত্র আইপিএল এর উপর ভরসা করে কেউ নিজেকে ফ্রি ল্যান্সার করে দিবেন, এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে জীবিকার জন্য হলেও খেলোয়াড়রা ফিরতে বাধ্য হবেন জাতীয় দলের ‘শৃঙ্খলে’। অনেকে আমার সাথে দ্বিমত করতে পারেন, বলতে পারেন একটি মৌসুম দেখেই এমন উপসংহারে আসাটা আমার অন্যায্য হচ্ছে। হতে পারে, তবে এইটাও ইয়াদ রাখা প্রয়োজন যে, আমি এক বছরেই এমনটা ঘটবে সেটি বলছি না। আমি বলছি কয়েক বছর পরের কথা। স্যামুয়েল বদ্রি, ওয়াইজ শাহ বা কেভিন পিটারসেনের মত বিশ্বমাতানো ফ্রি ল্যান্সারদের কথা বিবেচনায় নিলে এমনটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারনও রয়েছে।