গত কয়েক দিনে ভারত থেকে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, ভারতীয় প্রশাসন জোর করে তাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপাতত এই তথ্যের কোন প্রমাণ না থাকলেও রোহিঙ্গাদের হঠাৎ এইভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টির উপর দৃষ্টি নিবন্ধিত করতে, ভারতের এই তৎপরতাই যথেষ্ঠ। অন্যদিকে গত বছর অক্টোবরে ভারতীয় প্রশাসন মিয়ানমারের কাছে ৭ জন রোহিঙ্গাকে হস্তান্তর করেছিল। তারা ২০১২ সাল থেকে আসামের কারাগারে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আটক ছিল। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার মতো পরিবেশ না তৈরি হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঐ হস্তান্তর ছিল স্পষ্টত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। সেটা বিবেচনায় না নিয়েই তারা এই কাজটি সম্পাদন করেছে। যার ফলে ভারতের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ ফেলে দেবার নয়।
ভারত যদি রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে আশ্রয় দিতে রাজি না হয় তাহলে বাংলাদেশকে আরও ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। অবশ্য ভারতের সিদ্ধান্ত তেমন হবে বলেই মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে নাগরিকত্ব বিল যেখানে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ভিত্তিতে পাশ করা হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য যথেষ্ঠ সহানুভূতি কাজ করবে বলে মনে হয়না। সেক্ষেত্রে ভারতে থাকা ৪০ হাজার (যার মধ্যে ১৭ হাজারের মতো নিবন্ধিত শরণার্থী) রোহিঙ্গাদের পরবর্তী নিবাস হতে চলেছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশে রাষ্ট্রের জন্য দুর্যোগের মতো। অথচ কথায় কথায় বন্ধু রাষ্ট্রের দোহাই দেওয়া বুদ্ধিজীবীরা এখন নিরব। ভারতের এই অমানবিক নীতির বিরুদ্ধে কোন শব্দ তাদের কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে না।
যতদ্রুত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কথা ছিল ততদ্রুতও হচ্ছে না। বরং সরকারের পুনর্বাসনের যে নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশেই — দীর্ঘ এবং স্থায়ী নিবাস হতে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ২০১৭ সালের আগস্টের দিকে যখন মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে আপাত দৃষ্টিতে কিংবা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে আশ্রয় দেয়াটা একটা সাধারণ বিষয় ছিল। যদিও প্রথমে সরকার কোনভাবেই আশ্রয় দিতে চায়নি। সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেয়ার ফলে মৃত্যুর মুখে পড়ছিল অনেক রোহিঙ্গা নারী-শিশু। পরে সরকারই প্রচার করে আমরা তাদের আশ্রয় দিতে রাজি। সরকারের মানবতার দূত সাজার একটা চেষ্টা তখন দৃষ্টিকটুভাবে আমাদের চোখে পড়ে ছিল। যা হোক রোহিঙ্গারা কোন রকমভাবে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারলেও এই সংকটের বিশ্ব চরিত্র ও ভয়বাহতা নিয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ঠ উদাসীনতা আছে।
বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত নয়। এর কারণ হয়তো বৈদেশিক সাহায্য। সরকার একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি খানিকটা হলেও সরিয়ে দিতে সক্ষম। তাছাড়া এই মানবিক ইস্যু বৈদেশিক বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার জন্য সহায়কও।
কিন্তু বিষয়টা জটিল আকার ধারণ করছে দিন দিন। কেননা, রাখাইন অঞ্চলে বসবাসের জন্য রোহিঙ্গারা কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি, এমনকি স্বাধিকার’র লড়াইয়ের কোন বিষয়ও সেখানে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারে নাই। শ্রেফ গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে পাড়ি দিয়েছে নাফ নদী। তাদের দিক থেকে রাখাইনে ফিরে যাবার কোন পথ খোলা নেই। তাদের ফিরে যাওয়ার সবকিছু নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মহলের উপর। বাংলাদেশতো বটেই। স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ‘আরকান আর্মি’র যে প্রচেষ্টা তাও রোহিঙ্গাদের ‘রাখাইন’কে বসবাসের উপযোগী করার জন্য যথেষ্ঠ নয়। আরাকান আর্মি তাদের লড়াইয়ের সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি, এমনকি তাদের যে সামরিক শক্তি তা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও প্রতুল নয়।
বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে খুব একটা চিন্তিত নয়। এর কারণ হয়তো বৈদেশিক সাহায্য। সরকার একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি খানিকটা হলেও সরিয়ে দিতে সক্ষম। তাছাড়া এই মানবিক ইস্যু বৈদেশিক বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার জন্য সহায়কও। কিন্তু ১১ লাখ মানুষের ভরণপোষণ কতটা ব্যয়বহুল সেটাও লক্ষ করা উচিত। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়তে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকেই ইসরায়েলের সাথে তুলনা করছেন। ইতিহাসের পরিক্রমায় হয়তো একদিন বাংলাদেশ দখলের মতো ঘটনা ঘটানোর সাহস সঞ্চয় করবে। স্থানীয়দের সাথে তাদের প্রায়ই দ্বন্দ্বে জড়ানোর খবর সংবাদপত্রগুলোতে উঠে আসে। আমি বলছি না যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ দখল করে নিবে। কিন্তু চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ এখন চরমে। এই অবস্থায় চীনা মদদে মিয়ানমার সেনারা যে গণহত্যা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার আমেরিকা ও জাতিসংঘ। এর রাজনীতির দিকটি যদি নজরে রাখি তাহলে এই পয়েন্টে চীনকে বধ করার জন্য একটা যুদ্ধ সহজেই উস্কে দেয়া সম্ভব। আর এটার পুরো মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশেকে। এই দিকটি আমলে না দিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে সরকার পশ্চিমা বিশ্বের সাথে নিজের সম্পর্ক উন্ননের যে কৌশল নিয়েছে তাতে বাংলাদেশে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উভয়েই ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
এই পয়েন্টে চীনকে বধ করার জন্য একটা যুদ্ধ সহজেই উস্কে দেয়া সম্ভব। আর এটার পুরো মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশেকে। এই দিকটি আমলে না দিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে সরকার পশ্চিমা বিশ্বের সাথে নিজের সম্পর্ক উন্ননের যে কৌশল নিয়েছে তাতে বাংলাদেশে ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী উভয়েই ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমার এই সংকট নিরসনে পুরোপুরি অনিচ্ছুক। হয়নি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন বৈঠকও। তাছাড়া নিয়মিতই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাড়াতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। অতিসম্প্রতি তারা সীমান্তবর্তী খালে ব্রিজ নির্মাণ করছে। কোন রাস্তা ছাড়াই ব্রিজ নির্মাণ করার উদ্দেশ্য নো ম্যানস ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়া। যে মুহূর্তে লেখাটি লিখছি, সেই মুহূর্তে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান করছে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা, সামনে বর্ষায় ওই অঞ্চল তাদের অবস্থানের অনুপযোগী করে তোলার লক্ষ্যেই ব্রিজ নির্মাণ করছে তারা। নো ম্যানস ল্যান্ডের ওই সকল রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য সংকট ও অসুস্থতা ইতিমধ্যে জেঁকে বসেছে। যার ফলে দ্রুতই তাদের প্রবেশ করতে হবে বাংলাদেশে। এভাবে একের পর এক রোহিঙ্গা আশ্রয় দিতে থাকলে রাখাইনের বদলে কক্সবাজার হয়ে উঠবে রোহিঙ্গাদের একমাত্র ঠিকানা। মোট রোহিঙ্গার এক তৃতীয়াংশতো ইতিমধ্যে বাংলাদেশেই রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহলের নজর থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সংকট সমাধানের কোন পথ খুঁজে বের করতে পারেনি। জাতিসংঘও মহাসচিবও এই ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্কের অবনতি। এই সম্পর্কের অবনতি বলতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি— যুদ্ধ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের হয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে যুদ্ধ করে রাখাইনকে রোহিঙ্গাদের উপযোগী করে তুলতে পারে। এরকম যুদ্ধ হলে বা পরিস্থিতি তৈরি হলে পশ্চিমারা বাংলাদেশকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। এবং অবশ্যই তারা উপমহাদেশে সমরসজ্জায় প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাবে। যেটা ভৌগোলিকভাবে ‘রোহিঙ্গা সংকট’র তুলনায় বিপজ্জনক। উপরে সেটা একটু বলেছি।
সুতরাং সরকারের উচিত যে কোনভাবে আলোচনার মাধ্যমে রাখাইনকে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ’ করে তোলা এবং তাদের প্রত্যাবাসিত করা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে কিংবা সাময়িক স্বার্থের জন্য আটকে থাকলে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে।