- চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই জিদানের পদত্যাগ
- বিশ্বকাপ চলাকালীন অবস্থাতেই রোনালদোর জুভেন্টাসে গমন
- নতুন কোচ হিসেবে লোপেতেগুই’র নাম ঘোষণা
- দায়িত্ব নেয়ার তিনমাসের মাথায় বরখাস্ত লোপেতেগুই
- অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসাবে সোলারির নাম ঘোষণা
- মৌসুমের অর্ধেক শেষে লিগ টেবিলের চতুর্থ স্থানে রিয়াল
- নতুন বছরেও অবস্থা ভয়াবহ
নিজেদের বর্ণিল ইতিহাসের জন্য বরাবরই সংবাদমাধ্যম এবং সমর্থকদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে রিয়াল মাদ্রিদ। চলতি মৌসুমেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে, এবার প্রেক্ষাপট সম্পুর্ণ ভিন্ন। যতবারই রিয়াল শিরোনামে আসছে প্রত্যেকবারই যেন সমর্থকদের হতাশ করার জন্য। অলৌকিক কিছু না ঘটলে বার্নাব্যুর ট্রফিকেস এবার যে খালি থাকবে সেটা জোর দিয়েই বলা যায়।
শুরুর ধাক্কাতেই অক্কা!
মৌসুমের শুরুতেই রিয়ালের রুহতে পরিণত হওয়া রোনালদোর বিদায় বেশ বড় একটা ধাক্কা হয়েই এসেছিল রিয়ালের জন্য। বাস্তবতা বিবেচনায় রোনালদোর কোনো বিকল্প এ মুহুর্তে এ কায়ানাতে নেই। সে হিসাবে রিয়াল তার কাছাকাছি মানের কাউকে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করে, নাকি নয়া আবতারে হাজির হয় সেটি দেখার বেশ আগ্রহ ছিল। জানুয়ারির মধ্য পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তা তে আগ্রহের জায়গায় জনম নিয়েছে আশঙ্কা। নিকট অতীতে চলতি মৌসুমের মত মূমূর্ষ রিয়ালকে আর দেখা যায়নি। রোনালদোর বিকল্প তো দূর, বার্নাব্যুর আকাশের নয়া তারা হবার যোগ্য এমন কাউকেই ব্লাঙ্কোস শিবির দলে ভেড়ায়নি। শেষ খবর পর্যন্ত তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। মৌসুমের শুরুতেই জিদান-রোনালদোর শোকে কাতর সমর্থকদের জন্য সামনের সময়টাও যে উপভোগ্য হবে না তা আন্দাজ করা কঠিন কিছু না। যে বিষয়টি বিষম খাওয়াচ্ছে তা হলো সাফল্য বুভুক্ষু বলে পরিচিত পেরেজের আচমকাই যোগ সন্ন্যাসীর মতন মৌন ব্রত পালন। চলতি মৌসুমের হালত কেন তার ভাবনার জগতে ধাক্কা দিতে পারছে না, তা স্পষ্ট না।
জিদানের পদত্যাগের পর দু’জন কোচ দায়িত্ব নিলেও কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়। লোপেতেগুই জিদানের খেলানো ফর্মেশন বহাল রেখেই বের করেছিলেন বিচিত্র এক পদ্ধতি। আচমকাই রিয়ালকে দেখা গিয়েছিল সহজাত কাউন্টার’র বদলে স্বভাব বিরুদ্ধ পাসিং ধাঁচের ফুটবল খেলতে। তার পরিণাম যা হবার তাই হয়েছে। রিয়াল হয়েছে কক্ষচ্যুত আর লোপেতেগুই চাকুরিচ্যুত। তার বদলে হাল ধরা সোলারিও সুখবর দিতে পারছেন না। তিনি নিজেই যেন এক রকম বিভ্রান্ত করণীয় নিয়ে। ফর্মেশনে বদল আনার চেষ্টা করছেন বটে, তবে তাতে নিজেই যেন আস্থা পাচ্ছেন না। এ অস্থিরতার স্পষ্ট প্রভাব রিয়ালের খেলাতেই দৃশ্যমান। কোপা দেল রে তে নিজেদের সর্বশেষ ম্যাচে লেগানেসের বিপক্ষে হেরে বসেছে ব্লাঙ্কোসরা। হারটা চলতি মৌসুমে এতটাই নিয়মিত যে তা নয়া কোনো কিছু বলে মনে হচ্ছে না। ঐদিনের যে বিষয়টা বিস্মিত করেছে তা হলো মধ্যমাঠে মার্সেলো এবং স্ট্রাইকার হিসাবে ভিনুসিয়াসকে নামতে দেখা। বলাই বাহুল্য দু’জনই ব্যর্থ হয়েছেন স্বীয় কর্ম সাধনে। এটি দল বাছাই করার ক্ষেত্রেই রিয়ালের নাজুক অবস্থার এক আশ্চর্য চিত্র বলা যায়।
পা ব্যাথার উপশমের খোজ ঘুমের ঔষধে!
না, রিয়ালের ডাক্তার মহলের আচানক এমন কোনো মতিভ্রম হয়নি। কথাটি রূপক অর্থে বলা। রোলানদোর বিদায়ের পর রিয়াল সবচেয়ে বেশি যে জায়গায় ভুগবে বলা ধারণা করা হচ্ছিলো সেটি হচ্ছে গোল স্কোরিং’এ। সেক্ষেত্রে কোনো স্ট্রাইকারের আগমনই ছিলো প্রত্যাশিত। বিগ বেনজুতে রিয়ালের বিগত সব কোচ আস্থা রাখলেও বর্তমানে তিনি পিওর নাম্বার নাইন নন। সেটি রিয়াল কর্তারা বুঝবেন না এমনটি কারোই মনে হবার কোনো কারণ ছিলো না। কিন্তু, বাস্তবতা বলছে কর্তারা সেটি বুঝতে শুধু ভুলই করেননি, যেটি বুঝেছেন সেটি না বুঝলেই বরং ফায়দা হতো। রোনালদোর বিকল্প হিসাবে রিয়াল দলে ভিড়িয়েছে গোলরক্ষক থিবো কর্তোয়াকে! এটি ইয়াদে রেখে বলাই যায় যে, রিয়াল পা ব্যাথার রাহাত খুজছে ঘুমের ঔষধে!
যেমনটি আগেই বলেছিলাম যে, বিশ্লেষকদের আগ্রহ ছিলো রোনালদের বদলে রিয়াল কাউকে দলে ভেড়ায় নাকি নয়া আবতারে হাজির হয় সেদিকে। দু’টির কোনোটিই না করে রিয়াল কোন কারণে কর্তোয়ায় সমাধা আশা করলো তা সম্ভবত কারো বুঝেই আসেনি। চলতি মৌসুম মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রিয়ালকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে রক্ষণ এবং আক্রমণ। দুটো জায়গার কোনোটিতেই নয়া মুখ এনে অবস্থা বদলের আলামত নেই। কর্তোয়াও যেন বিভ্রান্তির জগতে এসে নিজেকে হারিয়ে বসেছেন। বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক কোনো ভাবেই যেন অক্ষত রাখতে পারছেন না নিজেদের জাল।
বাস্তবতায় অনাগ্রহ
চলতি মৌসুমের রিয়ালকে দেখে মনে হচ্ছে খোয়াবের জগতে বিচরণ করা এক দল। কিছুদিন আগেই ব্যক্তিগত সব পুরষ্কার নিজের করে নেয়া মদ্রিচ মৌসুমের শুরু থেকেই নিজেকে হারায়ে খুজছেন। স্নাইপার টনি ক্রুসের হালতও বেসামাল। মধ্যমাঠের আরেক স্তম্ভ কাসেমিরোও চেনা ছন্দে নেই। এখনই তাদের দল থেকে ছেটে ফেলার কথা কেউ বলছে না; কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় তাদের কিছু ব্যাকআপ এর প্রয়োজন ছিলো। এটিও যেন রিয়াল অনুধাবন করতে পারছে না। ব্যাকআপ খেলোয়াড় হিসাবে বেশ ক’জন তরুণকে দলে ভেড়ালেও তারা রিয়ালের জার্সির ভার বা মদ্রিচ, ক্রুসের জুতোয় পা গলানোর মত পরিপক্ক এখনো নন। এ অবস্থায় একটি ভরসার নাম রিয়ালে ছিলো; কোভাচিচ। আশ্চর্যজনকভাবে তাকে পাঠানো হয়েছে লোনে! রিয়ালের খেলার ধরনের কারণে দুই উইং ব্যাকের সাথে রামোসও প্রায়শই উপরে উঠে যান। সে সময়টা রক্ষণ সামাল দিতে যে ধাঁচের খেলোয়াড় দরকার ভারান ঠিক তেমনটা নন। পেপে যাবার পর এ বিষয়টি রিয়ালকে বেশ ভুগিয়েছে। কিন্তু রোনালদোর আশ্চর্য গোল স্কোরিং দক্ষতার জন্য রিয়াল আক্ষরিক অর্থে সে ভোগান্তিটা কখনোই টের পায়নি। চলতি মৌসুমে যেটি খুব ভালো মতনই চোখে পড়ছে। এ বিষয়টি নিয়েও কারো রা নেই!
লক্ষ্য নির্ধারণে অক্ষমতা নাকি আত্মশ্লাঘা?
এ বিষয়টিও পরিষ্কার না। চলতি মৌসুমের রিয়ালকে দেখে মনেই হচ্ছে না তাদের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য রয়েছে। ঘরোয়া এবং মহাদেশিয় সব আসরেই এখনো শিরোপার লড়াইয়ে থাকলেও এ দলটি কোনো শিরোপা জেতার ক্ষমতা রাখে এমনটি বোধয় ব্লাঙ্কোস সমর্থকরাও ইয়াকিন করেন না। লিগের প্রায় অর্ধের পথ পার হবার পরেও লিগ টেবিলে রিয়ালের অবস্থান চতুর্থ! শীর্ষে থাকা বার্সার সাথে ব্যবধানটাও বেশ বড়। বার্সা, বিশেষ করে মেসি যেমন খেলছেন তাতে বার্সার বদলে রিয়াল লা লিগা জিতবে এটা একরকম দৈব স্বপ্নই বলা যায়। রিয়াল সেটি ভেবেই কি না কে জানে, লিগে চলছে গদাই লস্করি চালে। খেলোয়াড়দের শরীরের ভাষা বা সোলারির পরিকল্পনাতে জয়ের তীব্র ক্ষুধাটাই অনুপস্থিত।
কথিত যে রিয়াল লিগে যেমনই করুক নিজেদের জাত চেনায় চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। গত কয়েক মৌসুম বিবেচনায় এটি সত্য বলে কবুলে কারো কসুর করার কথা না। তবে, এটি মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, সর্বশেষ ন’টি মৌসুমে দলে ছিলেন রোনালদো। যাকে তার নাজাকাতের জন্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বরপুত্র বলা যায়। সার্বাধিক গোল থেকে শুরু করে বহু রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন পর্তুগিজ যুবরাজ। চলতি মৌসুমে সে সার্ভিসটি রিয়াল পাচ্ছে না। বেল রোনালদোর বিকল্প হতে পারেন বলে যারা ভেবেছিলেন তাদের সে ভাবনায় জল ঢেলেছেন বেল নিজেই। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে চলতি মৌসুমে কোনো দলই সে অর্থে একক ফেভারিট তকমা পাবার মতো অবস্থায় নেই। সেটি মাথায় রেখেও রিয়ালকে সাম্ভাব্য শিরোপাধারীদের একটি দল বলা যাচ্ছে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে গত তিন মৌসুমের সাফল্য সম্ভবত পেরেজের বাস্তবোধ বিলোপ করে দিয়েছে। নতুবা, বাকি দলগুলোর পথচলার সাথে নিজেদের মিলালেও তো বোঝা যায় রিয়াল কোন অবস্থায় রয়েছে। এটিতেও যেন আশ্চর্য এক অনীহা দেখা যাচ্ছে। আত্মশ্লাঘাও সম্ভবত সঠিক শব্দ হচ্ছে না। পেরেজের চলতি মৌসুমের অবস্থানটা কেমন যেনো বিভ্রান্তিকর। যেমন, কোচ ছাঁটাই এবং নয়া কোচ নিয়োগে তার পূর্বের যে অবস্থান সেটি মাথায় রাখলে সোলারির বদলে হাই প্রোফাইল কাউকেই ডাগ আউটে দেখার কথা ছিলো। এটি আরো বেশি মনে হচ্ছিলো কারণ, অতীতে যে দুজনের বিষয়ে পেরেজের দূর্বলতার কথা ব্যাপকভাবে শোনা গিয়েছে সেই ওয়েনগার এবং মোরিনহো দু’জনই বেকার বর্তমানে। এ দু’জন না হলেও অন্য কোনো হাইপ্রোফাইল কারো সাথেই রিয়াল যোগাযোগ করেছে বলে শোনা যাচ্ছে না।
ব্যর্থ বেল, ভরসা এক টিন এজার!
রোনালদোর বিদায়ে যে আদমি স্বমহিমায় জ্বলে উঠবেন বলে সবাই আশা করেছিলো তিনি হচ্ছেন গ্যারেথ বেল! বাড়তি দায়িত্ব নিবেন কী? রোনালদোর বিদায়ে যেন ক্রমশ আরো বিবর্ণ হচ্ছেন এই ওয়েলস তারকা। দায়িত্ব নিতে পারছেন না এসেন্সিও বা ভাস্কুয়েজরাও। এমন হালতে সোলারির ভরসার নাম ভিনুসিয়াস! রিয়ালের মত দলে একজন টিন এজার মূল ভরসায় পরিণত হয়েছেন, বিষয়টি স্বাভাবিক না। অথচ, এটি এখন নিয়মিত দৃশ্য। অথচ, ভিনুসিয়াসের যে বয়স তাতে দলের জোয়াল নিজের কাঁধে বইবার বদলে তার খেলাটি উপভোগ করার কথা। শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে পয়লা মৌসুম কাটানো একজন আদমির দিকে কোচ যখন তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকেন, তখন পরিস্থিতির ভয়াবতা সহজেই আঁচ করা যায়
উপসংহার
মৌসুমের এখনো অনেকটা পথই বাকি। অতীত ইতিহাস খেয়াল রাখলে এ সময়ে কোনো দলের ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চিত কোনো ভবিষ্যতবাণী করা খুব ঝুকিপূর্ণ হয়ে যায়। বিশেষ করে দলটির নাম যখন হয় রিয়াল মাদ্রিদ। তারপরেও চলতি মৌসুমে এই ঝুঁকিটা নেয়াই যায়। রিয়াল সমর্থকরা আশা করতেই পারেন, তবে সেটির মাত্রাটা খুব বেশি না হলেই বোধ করি ভালো হবে।