বিয়েতে গায়ে হলুদ : কোন ধর্মের সংস্কৃতি?

বিয়েতে গায়ে হলুদ : কোন ধর্মের সংস্কৃতি?

সংস্কৃতিটা একটা জটিল বিষয়। মার্কিন পণ্ডিত ক্রোয়েবার সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিয়া ৪৩৫ পৃষ্ঠার একটা কিতাব লিখেছিলেন। তবে সংস্কৃতি বলতে আমি বুঝি আচার-ব্যবহার ও শিল্পসাহিত্যের মধ্যে একটা জাতির যে পরিচয় মেলে তাই হল সংস্কৃতি। বিষয়টা আরও জটিল যদিও। এর সাথে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্নটিও জড়িত। তবে আজ আলোচনা করব বিয়েতে গায়ে হলুদ’র যে সংস্কৃতি আমরা দেখি তা নিয়ে। ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, এইটা অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটা সংস্কৃতি। এইটা কি ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, না মুসলমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশকৃত একটা সংস্কৃতি বা আচার? যা এখন বিশাল অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে।

হিন্দু ধর্মে হলুদ

হিন্দুদের জীবনে এমনকি ধর্ম মোতাবেক বিবাহ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। মানুষকে পাপমুক্ত করে  বিশুদ্ধ করবার জন্য হিন্দুদের যে দশবিধ সংস্কার আছে তার মধ্যে বিবাহ হচ্ছে শেষ বা চরম সংস্কার । বিবাহের মাধ্যমে যেহেতু একজন নারী পিতার বংশ ছেড়ে স্বামীর বংশে চলে আসে, সেজন্য হিন্দুনারীর পক্ষে বিবাহ-জীবন চরম একটা সন্ধিক্ষণ। এরূপ সন্ধিক্ষণে যাতে কোন বাধা-বিপত্তি না ঘটে তার উদ্দেশ্যেই হরিদ্রাগণপতির পূজা করে থাকে।

হরিদ্রাগণপতি মানে হলুদ গণেশ, হিন্দু দেবতা গণেশের (গণপতি) একটি রূপ যার গায়ের রং হলুদ। গণেশের এই রূপটি তার ৩২টি সর্বাধিক জনপ্রিয় রূপের অন্যতম। তিনি আবার হলুদ রঙের কাপড় পরিধান করেন।

পার্থিব চাহিদা পূর্ণ করার জন্য (বিশেষত যৌনজীবন-সংক্রান্ত বরলাভের জন্য) তার পূজা করা হয়। তাই হিন্দু সমাজ কল্যাণের আশায় বিয়ের সময় হলুদ কাপড় পরিধান করে এবং গায়ে হলুদ মাখে। যা হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি হিসাবে পালন করে থাকে।

ইসলাম ধর্মে হলুদ

গায়ে হলুদ’টা ইসলামী কোন সংস্কৃতি না। কিন্তু এটা কোনো গুনাহের কাজও নয়। তবে, এটা যদি ইবাদত বা ইসলামের নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে ভুল হবে। এটা ইবাদতের বিষয় নয়। এটা হচ্ছে এধরনের স্থানীয় রীতি বা প্রচলিত সামাজিক আচার। ইসলামের আলোকে এটাকে না দেখাই উত্তম হবে। আরও একটি বিষয় বলা যেতে পারে, ভারতের সমাজে হিন্দু ধর্ম সংষ্কৃতি হিসেবে অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। এমনকি অনেক হিন্দু ধর্ম থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ ইসলাম বরণ করে নেয়াতে তাদের সংষ্কৃতি ও আচারের অনেক কিছুই উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনাচারে থেকে গিয়েছে। তবে এগুলো কোন ভাবেই ইসলামের আচার বলা যাবে না। ইতিহাসের আলোকে দেখলে মনে হয়, এখনকার গায়ে হলুদ সংষ্কৃতিটা অনেকটা হিন্দু ধর্ম বা আচার দ্বারা প্রভাবিত।

তবে সৌন্দর্যের জন্য এটা করা যেতে পারে। বুখারী শরীফে একটি হাদীস আছে যে, একদা হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রাঃ) রাসুল (সঃ) এর দরবারে এলেন। তখনো তার গায়ে হলুদের চিহ্ন ছিল। রাসুল (সঃ) তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন তিনি এক আনসার মহিলাকে বিয়ে করেছেন। (৪৭৭৬ ই ফা.)

এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিয়ের সময় বর ও কনেকে সাজানো অতি প্রাচীনকালের রীতি না হলেও মহানবী (সঃ) এর সময় থেকে এটা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।  রাসূল (সঃ) এর সাহাবীদের মধ্যেও ছিল। ইসলামে হলুদ একটি পছন্দনীয় রঙ। বিয়ের সময় গায়ে হলুদ মাখানো, হলুদ রঙের জামা পরা এবং সুগন্ধি ব্যবহারের অনুমতি আছে। কেননা আবদুর রহমান ইবন আওফ (রাঃ) হলুদ লাগিয়ে রাসূল (সঃ) সম্মুখে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (সঃ) তা অপছন্দ করেন নি এবং তিরস্কারও করেন নি । এই সম্পর্কে ইসলামী মনীষীদের মত হচ্ছেন যে, যে লোক বিয়ে করবে, সে যেন বিয়ে ও অনন্দ-উৎসবের নিদর্শনস্বরুপ হলুদ বর্ণের রঙিন কাপড় পরিধান করেন।

অন্য একটি হাদিসে হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সমস্ত রং ও বর্ণের মধ্যে হলুদ বর্ণই হলো উত্তম ও সুন্দর। তবে অবশ্য ইমাম আবু হানিফা, শাফেয়ী ও তাঁদের সঙ্গী ও সাথীর মতে হলুদ কাপড় কিংবা জাফরানের রঙ লাগানো মাখরুহ। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে গায়ে হলুদ করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ নাযায়েজ। মোমবাতি জালানো, গাইরে মাহরামরা গায়ে হলুদ লাগিয়ে দেয়া, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, যুবতীদের সাজগোজ় করে সৌন্দর্য প্রদর্শন, নিষিদ্ধ বাদ্য বাজানো, অশ্লীল গান এসবই হারাম। গায়ে হলুদের নামে এইসব করা ইসলামি সংষ্কৃতির অংশ নয়।