জিয়াউর রহমান
[১৯৮১ সালের ৮ই জুলাই দৈনিক বাংলায় জিয়াউর রহমান’র বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধ এর একটি নেপথ্য কাহিনী আছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় সফর শেষে পশ্চিম জার্মানি থেকে দেশে ফেরার পথে বিমানে তার তথ্য উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিসকে কাছে ডেকে বসান। তিনি তার ভাবনাগুলো বলে যান। জনাব মজলিস সে কথা ও পয়েন্টস টুকে নেন। তিন ঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠকের ভিত্তিতে দাউদ খান মজলিস একটি নিবন্ধের খসড়া তৈরি করেন। তা প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দেয়া হয়। জিয়া যে রাতে নিহত হন, সে রাতে খসড়াটি তার সঙ্গেই ছিল। সম্ভবত খসড়াটির কিছু সংশোধনের জন্যে তিনি ওটি নিয়ে নিয়েছিলেন। দাউদ খান মজলিসের অনুমতিক্রমে সেই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। লেখাটি নেয়া হয়েছে, গবেষক ও সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ’র ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া : রাজনৈতিক জীবনী’, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০১৬, ঢাকা।]
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরুক রয়েছে। যুগ-যুগান্তরের দেশ প্রেমিকদের হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্ব উৎসাহ, উদ্যেগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী যা এদেশের ঐক্যবদ্ধ জনগনকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপযোগী বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতীকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্বজাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। এর জন্য প্রয়োজন সার্বিক জাতীয় পরিকল্পনার আলকে সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশের বিপুল জনশক্তির ব্যবহার, যে জনশক্তিকে কাজে না লাগিয়ে তার অপচয় করা হয়েছে। তবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, গণমুখী কর্মসূচী দেশের ভেতরের ও বাইরের স্বার্থবাদী মহল ও লোকজনের তীব্র বিরধিতার সম্মুখীন হবে, কারণ আমাদের প্রগতিশীল ও গণমুখী কর্মসূচী স্বার্থবদীদের সমাজ বিরোধী তৎপরতা ও একচেটিয়া মুনাফা লাভের ঘৃণ্য পথ বন্ধ করে দেবে। সেজন্য গ্রাম পর্যায়ে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের ও সব বয়সের প্রতিটি মানুষের কাছে সত্যিকারভাবে পৌঁছানো আমাদের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। গণ-সাক্ষাতের এই প্রয়াসকে হতে হবে বিরামহীন, ঘনিষ্ঠ ও সমাদৃত। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার করুণাতেই আমাদের লক্ষ্য বাস্তবরূপ নেবে, তাই এতে ধর্মের যথাযোগ্য মর্যাদা ও প্রধান ভূমিকা থাকতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার প্রতি আমাদের অটুট ও অবিচল বিশ্বাস থাকতে হবে। একথা স্মরণ রাখতে হবে আমাদের দর্শন এদেশের মাটি, পানি ও গণমানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে রয়েছে এবং তার কোন বিচ্যুতি আমাদের জন্য ধ্বংসই ডেকে আনবে। এদেশের মাটি ও পানি ও জনগণের মধ্যে যে সুপ্ত শক্তি নিহিত রয়েছে, তাকে সংঘবদ্ধ ও সমন্বিত করার জন্য বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। নীতিসমূহের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অর্থ সুস্পষ্ট ধারণা দিতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অর্থ ব্যাখ্যা করতে হবে। এর জন্য ইতিবাচক নমনীতা একটা স্থায়ী অপরিহার্য নিয়ামক। এতে নেতিবচক দৃষ্টিভঙ্গির কোন স্থান নেই।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে জনগনের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মূল এই বিষটির সঙ্গে জড়িত আছে আরো অনেক আনুসাঙ্গিক বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমেই এ সবের সমাধান করতে হবে
আমাদের মূল লক্ষ্য ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে জনগনের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। শোষণমুক্ত সমাজ বলতে মূলত বোঝায় ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। মূল এই বিষটির সঙ্গে জড়িত আছে আরো অনেক আনুসাঙ্গিক বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমেই এ সবের সমাধান করতে হবে। যে বিষয়ে পরে আরো বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। একথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, একটি শোষণমুক্ত সমাজ যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপক্ষতা ও ন্যায়বিচার। এই পর্যায়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়গুলো ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে যা ছাড়া জাতীয়তাবাদী দর্শনের আন্দলন এবং তার মূল লক্ষ্য অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হয়ে পড়বে অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। আমরা বলতে পারি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয়ে, যা হচ্ছে: ১) বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক এলাকা, ২) ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের জনগণ, ৩) আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা, ৪) আমাদের সংস্কৃতি – জনগণের আশা- আকাংখা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ৫) দু’শো বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক, ৬) আমাদের ধর্ম প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-নীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা, ৭) সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বংলাদেশেী জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের উল্লেখ করা যায়। উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সংকীর্ণ পরিসরের এই দেশের পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশ এ দু’টি অঞ্চল বা দু’টি উপমহাদেশের সেতুবন্ধস্বরূপ। এই কারণে আঞ্চলিকভাবে এবং সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। এই কারণেই সুদৃঢ় অতীত থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধরে দখল ও কর্তৃত্ব লাভের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম থেকে এদেশ বারংবার আক্রান্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এদেশের জমির বিপুল উর্বরশক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য শত শত বর্ষ ধরে বারংবার আক্রমণকারীদের এদেশ আক্রমণে প্রলুব্ধ করে এসেছে, যে কারণে আমারা শতাব্দীর পর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিকশাসন ও পরিপূর্ন শোষণের শিকার হয়েছি। এই মহান দেশের জনগণ দুর্বল হয়ে থাকলে ভবিষ্যতেও সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে পড়তে পারে। সেজন্য এদেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমি রক্ষার ব্যবস্থা শিখতে হবে।
আমাদের ভাষা বাংলা। অন্যান্য দেশেও বাংলা ভাষাভাষী রয়েছে, যাদের সঙ্গে আমাদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। তারা পৃথক সত্তা, আদর্শ,আকাঙ্ক্ষা ও মননশীলতার অধীকারী; তাদের মানসিকতা ভিন্ন এবং তারা পৃথক দেশের অধিবাসী। সেজন্য বাংলা ভাষাভাষী হলেও আমাদের যথার্থ পরিচয় বাংলাদেশী। দেশজ কৃষ্টির ধারক ও বাহক আমাদের সংস্কৃতির রয়েছে বিকশ ও সমৃদ্ধি প্রাপ্তির এক অনন্য সাধারণ ঐতিহ্য যা বলিষ্ঠ বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ দেশের সংস্কৃতিকে দিয়েছে যে দুর্বার শক্তি, সেই চেতনার আলোকে এই চেতনার আলোকে এই সংস্কৃতি নিজস্ব পৃথক সত্তা ও বৈশিষ্ট্যে আরো মহিমামণ্ডিত রূপ লাভ করেছে। বাইরের থেকে আমাদের এই সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চলছে এবং সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ছত্রছায়ায় আন্তর্জাতিক ধুয়া তুলে এতে বিদেশী রূপ দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বহু বছরের ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে আামাদের অর্থনীতি হয়েছে সম্পূর্ণ পর্যুদন্ত, জাতীয় সম্পদ হয়েছে লুণ্ঠিত এবং মানব সম্পদ নিপীড়িত। সেজন্য আজ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের বিপুল জনসংখ্যা এবং স্বল্প আয়তনের প্রেক্ষিতে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তি হবে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের গতিশীল প্রেরণা, যে চেতনায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ জাতীয় পুনর্গঠন ও উন্নয়নে শরীক হবে। আমাদের মনে ধর্মের বিশেষ স্থান রয়েছে। আল্লাহতায়ালা এক ও অদ্বিতীয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ ও অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। সেজন্য প্রতিটি মানুষের তার নিজের ধর্ম পালনের পরিপূর্ণ অধিকার আমাদের কাছে স্বীকৃত সত্য। সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একমাত্র আমরাই সর্বাধিক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলাম এবং এই অঞ্চলের অন্য কোন দেশকে তার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হয় নি। স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের মধ্যে ত্যাগের সার্বভৌমত্বের যে মহান প্রেরণায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে সে চেতনা ও প্রেরণার ব্যাপারে কোন আপোষ নেই। যারা আমাদের দেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের ইঙ্গিতে পবিত্র ধর্মের নামে মিথ্যা প্রতারণা ও চক্রান্তের জাল বুনে বিদেশী প্রভুদের নির্দেশ মেনে কাজ করে তারা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও তার জনগণের পরম শত্রু। এমনভাবে তাদের মোকাবেলা করতে হবে যাতে তারা আর কোন দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এর ফলে জাতি নিরুপদ্রবে জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে দেশের জনগণের জন্য নিজেদের ত্যাগ ও পরিশ্রমে বাস্তবায়নাধীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে যেতে পারবে। কাজই একথা বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক বা ধর্মভিত্তিক কোন দর্শন নয়। বস্তুত বিভিন্ন উপাদান এই দর্শনের ভিত্তি এবং সেজন্য তা পুর্ণাঙ্গ ও সবার কাছে সমাদৃত। এর কোন একটি মৌলিক উপাদান দুর্বল হলেও অন্য সব উপাদানের সম্মিলিত শক্তি ও কর্মোদ্যেগের মাধ্যমে এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। এমন একটি শোষণমুক্ত সমাজ তথা এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং পরিপুরক বিষয়ে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। একথা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে সম্পদ ও সার্ভিসের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন হওয়া উচিত। অবশ্য এই কাজ সহজ নয়। সমাজের সম্পদ ও সার্ভিস একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে এই কাজে তাদের কাছ থেকে প্রবল বাধা আসবে। কিন্তু গণ-সংগঠন এবং পরিকল্পিত ও সুসংগত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমরা এই সামাজিক অন্যায় ও বিরোধিতার যথাযথ মোকাবেলা করতে পারবো। এসব মুনাফাখোরী ও স্বার্থবাদী মহলের বিরোধিতার সম্মুখীন হলে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবো যে আমাদের পথ সঠিক হওয়ায় তাদের এই বিরোধিতা এবং সেজন্য বিরোধিতা মোকাবিলা ও তাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নির্মুল করার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া অব্যাহতভাবে জনগণের শক্তিতে সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে হবে এবং বর্তমান দুঃখজনক অবস্থার কারণগুলো তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানতে হবে। শহর ও পল্লি এলাকায় তাদেরকে সুসংগঠিত করতে হবে এবং সেই কাজ করতে হবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে যাতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্ন, শোষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের অন্তরায় হিসেবে বিভিন্ন ধরনের বিদেশী হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা না দেখা দেয়। আমাদের দর্শনের আলোকে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে জনগণের সর্বাত্মক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে যার মাধ্যমে বহুশতক ধরে অগণিত জনগণের সুপ্ত, সুবিশাল ও অন্তর্নিহিত শক্তি বন্ধনমুক্তি পেয়ে জাতীয় কাঠামোর প্রেক্ষাপটে জাতীয় উন্নয়ন সাধন ও সুদৃঢ় করতে কার্যকরী হতে পারে। জনগনের সর্বাত্মক স্বাধীনতার অর্থ রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবদের বাস্তবমুখী রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক কর্মসূচির দর্শনে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিটি মানুষের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে তার ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ও নিষ্ঠাবান করে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে তাদের প্রত্যেককে দেশ ও তার জনগণ এবং বিশ্ববাসীর কল্যাণ করার সুযোগ করে দিতে হবে। একথা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, জাতি হিসেবে নিজেরা শক্তিশালি, সুদৃঢ় ও সফল কর্মী না পারলে আমরা বিশ্বমানবতার সেবা করতে পারব না। পুর্বে উল্লেখিত পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে আমাদেরকে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে যাতে জাতীয় স্বার্থেই গঠনধর্মী বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকবে। দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণ এসব চিন্তা ও কাজের মূল পথ নির্দেশিকা হবে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কর্মসূচীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মানুষের প্রতিভা ও নিজস্ব ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। সেজন্য জনগণকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইউনিটে সুসংগঠিত এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণাকে কাজে লাগান। এজন্য আমাদের দলকে সর্বনিম্ন গ্রাম পর্যায়ে সংগঠিত করে ধাপে ধাপে উপরে আসতে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গদলে সামিল করতে হবে
আজকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এমন এক বিশ্ব-পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শের কর্মসূচী জনগণকে নিষ্ক্রিয় ও নির্বাক করে দেয়। যার ফলে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনগণের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত শক্তি কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয় এবং দুঃখ, কষ্ট, ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গ্লানি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব সম্পদ ও সম্ভাবনার দ্বার আজ যখন মানুষের অগ্রগতির ও জাগরণের পথরুদ্ধকারী সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণের আদর্শ মানুষের একক ও সম্মিলিত কাজের শক্তি খর্ব করে না বরং তা মানবসমাজকে অগ্রগতির পরিবর্তে পশ্চাদগামী করে পরিণতিতে অবশ্যম্ভাবী আত্মবিন্যাস ডেকে আনে। নিয়ন্ত্রিত ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য স্বভাবতই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবে এবং যদিও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় তবে তা পূর্বের আদর্শবাদভিত্তিক থাকবে না, যথার্থভাবেই হবে প্রতিক্রিয়াশীলতা। যদি তারা পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকে তবে তারা বহুমুখী সমস্যার আবর্তে ক্রমান্বয়ে আত্মবিনাশের সম্মুখীন হবে। এই ক্রমিক প্রক্রিয়া অঞ্চলবিশেষ ও বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ামকের দ্বারা প্রভাবান্বিত হবে। প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা মানুষকে স্বাধীন স্বত্ত্বা দান করেছেন। মানুষ যাতে তার নিজস্ব শক্তির পূর্ণ ব্যবহার ও ক্ষমতা দ্বারা তার বহুমুখী প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারে সেজন্য তাকে যথাযথ সুযোগ দিতে হবে।
আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কর্মসূচীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মানুষের প্রতিভা ও নিজস্ব ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। সেজন্য জনগণকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইউনিটে সুসংগঠিত এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারণাকে কাজে লাগান। এজন্য আমাদের দলকে সর্বনিম্ন গ্রাম পর্যায়ে সংগঠিত করে ধাপে ধাপে উপরে আসতে। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গদলে সামিল করতে হবে। এজন্য আমাদের দলে যুবক, মহিলা, কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন অঙ্গদল রয়েছে। আমরা গ্রামের সর্বনিম্ন পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক ইউনিট হিসেবে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার গড়ে তুলেছি যা হবে একটি আত্মনির্ভরশীল সরকার এবং তা খাদ্য, সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও আইন-শৃংখলার মতো মৌলিক মানবিক প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট থাকবে। জাতীয় বিবেচনার আলোকে এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে মহিলা, যুবক, তরুণী, শিশুদের সুসংগঠিত করা হবে যাতে কাজের সমন্বয় সাধিত হয় এবং কর্মীদের একাত্মতা প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের কাজে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এভাবে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন তথা সার্বিকভাবে জনগণকে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচীতে সামিল করতে হবে। শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচীতে রয়েছে :
১) জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করা। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন একটি সুষম পররাষ্ট্রনীতি। একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সমগ্র দেশবাসীকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। ছোট হলেও একটা সদা প্রস্তুত কার্যকর সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে থাকবে আধা-সামরিক বাহিনী ও জনগণের মিলিশিয়া। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ ক্যাডেট কোরের মাধ্যমে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। ২) কৃষি সংস্কার : আমাদের খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুন করতে হবে। মাছের চাষ, হাঁস, মুরগী ও গবাদি পশুপালন ও প্রজনন কয়েকগুণ বাড়াতে হবে। সারা দেশকে সেচের আওতায় আনতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জিত হবে প্রায় আগামী পাঁচ পছরের মধ্যে। জমির মালিকানা ব্যবস্থ্য দেশবাসীর কাচে সহজ-গ্রহণযোগ্য একটা পন্থায় পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্র থেকে জমি উদ্ধার করা, বনসম্পদ বৃদ্ধি ও পর্যাক্রমে কৃষি ও চাষী সমবায় গঠন করা। ৩) শিক্ষা সংস্কৃার। ৪) পরিবার পরিকল্পনা। ৪/ক) ব্যাপকভাবে শিল্প উৎপাদন ও দেশব্যাপী বিদ্যুতিকরণ। ৫) সমাজ সংস্কার : যাতে থাকবে মানুষে-মানুষে সাম্য আর ন্যায়বিচার ভিত্তিক সুষ্ঠ সমাজব্যবস্থা ও সুষম বন্টন। ৬) প্রসাশনিক সংস্কার। ৭) ধর্মকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে মূল পরিচালক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। ৮) আইন সংস্কার। ৯) শ্রম আইন সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিকদের অবস্থার সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। ১০) জনশক্তির উন্নয়ন/পুরুষ নারী সকলকে। ১১) খনিজ তথা সকল প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান, আহরণ ও পূর্ন সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করা। ১২) সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করব, যাতে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উৎপাদনের ব্যবস্থা হয় এবং জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সে সুবিধা ভোগের সুযোগ পায়। কাজই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার পুরো প্রক্রিয়া বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাব তা প্রকৃতির নিয়মের মতোই আবর্তনশীল। এখন সংশ্লিষ্ট চার্ট পরীক্ষা করে দেখা যাক। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য আর্থাৎ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে শোষণ সমাজ প্রতিষ্ঠা সার্বিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেবে যা আবার বহুমুখী গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেবে যা আবার বহুমুখী গণন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করবে যার ফরে শান্তি পূর্ণ বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় [বিপ্লব যেহেতু বহু বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের দরুন আমাদের হারানোর শতাব্দীরও বেশী সময়ের ক্ষতিপূরণের জন্য আমাদের সল্পসময়ে অনেক কাজ করতে হবে] বহুমুখী মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থেকে সর্বোচ্চ জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার সুযোগ থাকবে। জনগণের পূর্ন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিসহ জাতীয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করবে যার ফলে ন্যায়সঙ্গত বন্টনের সুযোগ সৃষ্টির দরুন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সূচিত হবে। তাই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী সমন্বিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আবর্তনধমী ও প্রকৃতির বিধানের অনুরুপ। প্রধানত : সংঘঠন, পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বের উপরের এই কর্মসূচীর সাফল্য নির্ভর করবে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিসমূহ বেস বা জনগোষ্ঠী, স্বধীনতা যুদ্ধ, বাংলা ভাষা, ধর্ম, ভৌগোলিক এলাকা সংস্কৃতি ও অর্থনীতি।