গত বছরের ন্যায় চলতি বছরেও শিল্প-সংস্কৃতি জগতের সৃজনশীল মানুষদের মৃত্যুর ধারা অব্যাহত। ৪ জানুয়ারি সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত এবং কবি পিনাকী ঠাকুর পরলোকগমন করার পর আজ তাদেরই জগতে চলে গেলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক অতীন বন্দোপাধ্যায়। কিছুদিন আগে স্নানাগারে সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ার ফলে হঠাৎ মেঝেতে পড়ে যান তিনি, গুরুতর আঘাত লাগে মস্তিষ্কে। লেখককে অবিলম্বে ভর্তি করা হয় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট নিকটস্থ সেন্টিনারি হাসপাতালে। ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা চলছিল লেখকের চিকিৎসক পুত্রের তত্ত্বাবধানে। সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও দিনকয়েক ধরে ক্রমশ শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। দিনকয়েক আগে মৃত্যুর গুজবও রটেছিল। সেন্টিনারি হাসপাতালে ১৯ জানুয়ারি ভোর ৩:৪০ নাগাদ মৃত্যু হয় লেখকের। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
১৯৩৪ সালের ১ মার্চ অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন সোনার গাঁও পানাম বিদ্যালয়ে। দেশভাগ হওয়ার পর তার পরিবার ভারতে পাকাপাকিভাবে চলে এসে বসবাস শুরু করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমার্স শাখায় ১৯৫৬ সালে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি এবং পরবর্তীকালে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তরুণ বয়সে জীবন নির্বাহের জন্য বিচিত্র সব কাজকর্ম করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। রোজগারের জন্য তিনি ট্রাক পরিষ্কার করার কাজ করেছেন। পেটের টানে হয়েছেন জলজাহাজের খালাসি এবং কারখানার ম্যানেজার। শিক্ষকতা করেছেন বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে, প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন নিপুণতার সঙ্গে। কর্মসূত্রে বহরমপুর শহরে থাকাকালীন ‘অবসর’ নামে একটি স্থানীয় পত্রিকায় তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতা এসে বসবাস শুরু করেন এবং যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। বহু ছোটগল্প-সহ লিখেছেন বেশ কিছু পাঠকপ্রিয় উপন্যাস। তার লেখা ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসে স্বকীয় রচনাশৈলী নজর কাড়ে সাহিত্য জগতের বিশিষ্টজনদের। এই উপন্যাস ‘গ্রিক ট্রাজেডির সঙ্গে তুলিতব্য’ বলে দরাজ প্রশংসা করেন প্রথিতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বহু গল্প, উপন্যাসে প্রাণ পেয়েছে সর্বহারা মানুষদের দুঃখদীর্ণ আকুতি, দেশভাগের দগদগে ক্ষত! তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘রাজার বাড়ি’, ‘নীল তিমি’, ‘উড়ন্ত তরবারি’, ‘হীরের চেয়েও দামি’, ‘গিনি রহস্য’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’, ‘নগ্ন ঈশ্বর’, ‘ঋতুসংহার’ ইত্যাদি। সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ২০০১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে মানিক স্মৃতি পুরস্কার এবং ১৯৯৮ সালে বঙ্কিম পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার এবং ভূয়ালকা পুরস্কারও আছে তার অর্জনের ঝুলিতে। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল, মনে করছেন বিদ্যৎজনেরা। শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে। আগামীকাল লেখকের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার কথা।