নীরোগ জীবনের জন্যে পঞ্চকর্মা

নীরোগ জীবনের জন্যে পঞ্চকর্মা

সময়টা যিশুর জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে। গৌতম বুদ্ধ একদিন উদর যন্ত্রনায় অসম্ভব কাতর। তার এ অবস্থায় সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এমন সময় এক চিকিৎসক এলেন গৌতম বুদ্ধের কাছে। হাতে তার একগুচ্ছ সুগন্ধি পাতা। তার একটি গৌতমের নাকের সামনে রাখতেই পেটের ব্যথা নিমেষে উধাও। গৌতম বুদ্ধের চিকিৎসায় উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম পথিকৃত জীবকের সেই বনৌষধি প্রয়োগ বহু জনশ্রুত। এরকমই আরেকটি ঘটনা- চল্লিশ বছর ধরে গুরুগৃহে শাস্ত্র অর্জনের পর আশ্রম ছেড়ে আসার সময় এক ছাত্র তার বিদ্যাদাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন- তিনি তার কাছে কী গুরুদক্ষিণা চান। প্রত্যুত্তরে আশ্রমগুরু বললেন, আমাকে এমন একটি গাছ তুলে এনে দাও যার মধ্যে কোনো ভেষজ গুণ নেই। গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে ছাত্রটি গাছ সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়ল। কিন্তু প্রায় তিন চার মাস ঘুরে বেড়িয়েও নির্গুণ বনস্পতি খুঁজে পেল না। অবশেষে পরিশ্রান্ত দেহে আশ্রমে ফিরে গুরুকে বলল- আমি ব্যর্থ। সারাদেশ ঘুরেও এমন কোনো ওষধি বা গাছ পেলাম না যার কোনো গুণ নেই। শিক্ষক তার ছাত্রের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তোমার জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হয়েছে, এজন্যই নির্গুণ বনস্পতি তুমি খুঁজে পাওনি। আর এখানেই আমার তৃপ্তি, এটাই আমার গুরুদক্ষিণা। এশিয়া মাইনরের নমেটিক উপজাতিরা ঘুরতে ঘুরতে একসময় এসে পৌঁছান হিমালয় উপত্যকা অঞ্চলে। এই প্রথম ঘন সবুজ বিভিন্ন গাছগাছড়ার সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তারা নানান রোগ নিরাময়ে এই সব বনস্পতির ব্যবহার শুরু করেন। আসলে শাস্ত্রের উৎপত্তি কিন্তু বৈদিক যুগেরও বেশ কিছুটা আগে।

খ্রিস্টজন্মের প্রায় তিন হাজার পাঁচশো বছর আগে ভেষজ এবং প্রাকৃতিক উপাদানকে কাজে লাগিয়ে আয়ুর্বেদ চর্চা শুরু হয়। আর এই চিকিৎসা বিজ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছিল আগুলিটি নেটিভ আর হিটাহিট ভাষারীতিতে। পড়ে তার সংস্কার হয় সংস্কৃতে এসে এই দেশে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির নাম আয়ুর্বেদ। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, সুমেরীয় সভ্যতায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে রোগ নিরাময়ের প্রচলন থাকলেও তা ছিল মূলত খনিজ নির্ভর। কারণ সে সব অঞ্চলে পর্যাপ্ত বনসম্পদ ছিল না। তাই ঐসব চিকিৎসা ছিল অনেকটাই যৌগের পরিমাণ ও প্রাথমিক গণিত নির্ভর। কারণ খনিজের পরিমাণ নির্ভুল না হলে রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পুরোটাই ছিল পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ ফল। বনৌষধি ব্যবহারে পরিমাণ অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পরবর্তীতে পরিমাপ এবং গণিতের উন্নতিতে আয়ুর্বেদেও ওষধি ও বনস্পতি ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল্যতত্ত্ব দেহ, অনুভূতি, মন আর আত্মার সমন্বয়। এখানে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শরীরের ভেতর আর বাইরের শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে রোগনির্মূল করাই এর কাজ। দেহে উপস্থিত উপাদান ভারসাম্য, পরিপাক, পুষ্টির ওপরই শারীরিক স্থিতি নির্ভরশীল। একটির তারতম্য ঘটলেই শরীরে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়। আয়ুর্বেদে বাত, পিত্ত, কফ এই তিন শক্তি একত্রে দোষ নামে পরিচিত। এদের সংমিশ্রণে শারীরিক সুষম গঠন ঠিক করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, স্নায়ুর দুর্বলতা কাটানো, রক্তশোধন এবং রক্তের সচলতা রক্ষা করা, মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখাই এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। আয়ুর্বেদে সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা রীতি-পঞ্চকর্ম। বমন, বিরচন, বস্তি, নাস্যা এবং রক্তমোক্ষণ- এই পাঁচটি প্রক্রিয়ায় রোগ নির্ধারণ করে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ওষধি তেল, ঘি, বনজ দ্রব্যের নির্যাস এবং সুগন্ধি দ্রব্যের সংমিশ্রণে এই চিকিৎসা করা হয়। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই চিকিৎসা রীতি সমস্ত রোগ প্রতিরোধে অতুলনীয়। শ্বাসনালীর মধ্যে জমা কফ, টক্সিন শরীর থেকে নির্মূল করার পদ্ধতির নাম বমন। শরীর থেকে পিত্ত বের করে আনার নাম বিরেচন। সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এই প্রক্রিয়ায় শরীর রোগমুক্ত এবং ঝরঝরে হয়ে ওঠে। বাত, পিত্ত এবং কফ এই তিন দোষকে নির্মূল করার প্রধান প্রক্রিয়া হল বস্তি। এটি মূলত দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এতে ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে রোগ সারতে। ভেষজ তেল নাকের ভেতর ঢেলে কফ পরিষ্কার, গলার ব্যথার জন্য নাস্যা খুব উপকারি। রক্তের শোধন এবং স্নায়ুর চিকিৎসায় রক্তমোক্ষণ পঞ্চকর্মের সর্বশেষ পদ্ধতি। সাধারণ পঞ্চকর্মার মধ্যে চিকিৎসকেরা এই পদ্ধতি করার পরামর্শ দেন না, কারণ এটি কঠিন চিকিৎসা। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য, মেদ কমানোর ক্ষেত্রেও পঞ্চকর্মা ভীষণ উপকারী।

এই উপমহাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও প্রাচীন এই শাস্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়। তাই অনেকেই আজকাল নীরোগ শরীর পেতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের শরণাপন্ন। এর সমস্ত ওষধি গাছ, লতা পাতা থেকে তৈরি। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার মেডিকেল সেন্ট্রাল অ্যাক্ট অনুযায়ী এক বিল পাস হয়েছিল, যার ফলে ১৮০ ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছিল সমগ্র ভারতে। যেখানে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করা হয়। আমেরিকা, চিন, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও আয়ুর্বেদকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। চটজলদি আরোগ্য লাভ সবার কামনার বিষয়। যে- কোনো কারণে মুঠো মুঠো ওষুধ খাওয়া পরিণত হয়েছে নেশার মতো। আদি যুগে গাছপালার মাধ্যমেই মানুষের চিকিৎসা করা হতো। কোনো প্রকার ক্যাপসুলের ব্যবহার ছিল না। আর রোগমুক্তিও ঘটত খুব তাড়াতাড়ি। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বর্তমানে “অলটারনেটিভ ট্রিটমেন্ট” নামে পরিচিতি লাভ করেছে। উন্নত বিশ্বে এর কদর বাড়ছে। অ্যালোপ্যাথি ওষুধ রোগ সারানোর পাশাপাশি মানব শরীরকে দুর্বল করে ফেলে এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি, যৌন ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। দেহের রাসায়নিক ভারসাম্য ভীষণভাবে ব্যহত হয়। তাই মানুষ এখন প্রাকৃতিক চিকিৎসায় অনেক বেশি আস্থাশীল হচ্ছেন। কারণ এখন প্রাকৃতিক চিকিৎসায় অনেক বেশি আস্থাশীল হচ্ছেন। কারণ প্রকৃতির মাঝে আনন্দে থাকার ইচ্ছে সবার। জীবনের মূলমন্ত্র হোক নিজে বাঁচুন, প্রকৃতিকেও বাঁচান।