তাহা সিদ্দিকী, পাকিস্তানি সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বর্তমানে ফ্রান্সে নির্বাসিত রয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, দি টেলিগ্রাফে কলাম লিখেন নিয়মিত। গত ১৩ জানুয়ারি আল জাজিরা’য় লিখেছেন পাকিস্তানের ‘পাখতুন আন্দোলন’র ভবিষ্যৎ নিয়ে। লেখাটি জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, মাশকুর রাতুল।
বছর খানেক আগে নাকিবুল্লাহ মেহসুদ নামের এক যুবক তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ঘটনাটি ঘটে পাকিস্তানের দক্ষিনাঞ্চলের বন্দর নগরী করাচিতে। পুলিশ দাবি করেন, মেহসুদ একজন তালেবান সদস্য ছিল। তারা জানায় সন্ত্রাসীদের গুপ্ত আশ্রয়ে অভিযান চালানোর সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নাকিবুল্লাহ মেহসুদ। মেহসুদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে খুব দ্রুতই তা প্রশ্নবিদ্ধও হয়। তার স্বজন এবং কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার বরাতে জানা যায় মেহসুদ পেশায় একজন দোকানদার ছিলো এবং মডেলিং ছিল তার স্বপ্ন! তবে অচিরেই পুলিশের ওই সাজানো নাটকে শুধুই মেহসুদের স্বপ্নই শুধু নয়, শেষ হয়ে যায় তার তাজা যুবক প্রাণটিও!
মেহসুদের ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব ছিল সাধারণ মানুষও। নতুন করে তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। পুনঃতদন্তের ভার পড়ে খোদ পুলিশের উপর। অবশেষে প্রমাণিত হয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বানোয়াট ছিল! মেহসুদ ছিলো নির্দোষ। পাকিস্তান পুলিশের একটি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর নামে প্রায়ই আসে বানোয়াট বন্দুকযুদ্ধের অভিযোগ। মেহসুদ হত্যায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে সাজার আওতায় আনা হয়, বিচার কাজ এখনো প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে। মেহসুদের মত নিরীহ মানুষকে প্রায় বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টারে নিহত হতে শোনা যায়। অনেক আগে থেকেই হচ্ছে এসব, প্রায়ই ঘটছে নতুন গল্পে নতুন কোন ‘বন্দুকযুদ্ধ’।
এর আগে ঘটে যাওয়া সকল বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডগুলোকে অগ্রাহ্য করে এসেছে সরকার। বাহিনীগুলোও কোন রকম জবাবদিহিতা ছাড়াই অভিযান চালিয়ে আসছে। মেহসুদ পাখতুন জাতিগোষ্ঠীর একজন ছিল। তাই তার হত্যাকাণ্ডে তাদের জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিল সোচ্চার। এর কারণেই সরকার বাধ্য হয় তার হত্যার তদন্ত করতে এবং পরবর্তীতে সে নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হয়। ঐ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পাখতুন জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়। পাখতুন তাহাফুজ (নিরাপত্তা) মুভমেন্ট (পিটিএম) ব্যানারে শুরু হয় আন্দোলন।
পিটিএম আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে মানবাধিকারকর্মী মানজুর পাখতিন। মেহসুদ হত্যার পর মূলত পাখতুনদের ক্ষোভ থেকেই এই আন্দোলন শক্ত অবস্থানে যেতে থাকে। আফগান সীমান্তে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দারাই এই পাখতুন জনগোষ্ঠী। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃগোষ্ঠি এই পাখতুন জনতা।
অনেক আগে থেকেই নানান হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে এই জনগোষ্ঠী। ৯/১১ এ যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর থেকে যে ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, পাকিস্তানে তার সবচেয়ে বড় শিকার এই পাখতুনরা। আফগানস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের পাখতুন অধ্যুষিত অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে প্রচুর আফগানস্তানি ঠাঁই পান। এরপর থেকেই সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগে সেখানে প্রায়ই হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনীগুলো। এখনো থামেনি এই বর্বরতা। সন্ত্রাস দমনের নামে চলছে সরকারী রাহাজানি, সন্ত্রাস। হামলা হচ্ছে সাধারণ বেসামরিক মানুষের উপর। মারা যাচ্ছে যুবক থেকে শিশু অনেকেই। তারপরেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠিকই বেড়েই চলেছে! সরকার নিরব!
এই যে এত হানাহানি এর পেছনে আছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। পাখতুনরা আঙুল তুলেছিল বরাবর সরকারের উপরেই! তাদের অভিযোগ ছিল সরকারই চায় না ঐ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ কমুক বা নির্মূল হোক কারণ সেই সন্ত্রাসের কর্তা স্বয়ং সরকার! সন্ত্রাস নিধনের নামে আসলে চলছিল পাখতুন নিধন।
ন্যায়ের আর্তনাদ
মেহসুদ হত্যার পর ওয়াজিরিস্তান থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত মার্চ শুরু করে মানজুর পাখতিন। হাজারো পাখতুন নাগরিক সেই মিছিলে আংশগ্রহণ করেন। তাদের ঐ আন্দোলন শুধু মেহসুদ হত্যাকাণ্ড নিয়েই ছিল না, ঐ আন্দোলনটি ছিল পাখতুনদের উপর চলতে থাকা নিপীড়ন আর বঞ্চনার ক্ষোভের চুড়ান্ত একটি প্রতিফলন। ঐ মিছিলটি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পাকিস্তান জুড়ে। সেখান থেকেই শুরু হয় পিটিএম আন্দোলন। পাখতুন অধ্যুষিত অঞ্চলে কিছু চরমপন্থি সংগঠনকে হটাতেই হামলা করে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। তবে চরমপন্থিদের দৌরাত্ম যেন থামছেই না। আর পিটিএম আন্দোলনে পাখতুন জনগোষ্ঠী এই প্রশ্নই তুলেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন ঐ চরমপন্থিদের থামাতে ব্যর্থ? কেনইবা চলছে সাধারণ পাখতুনদের উপর আক্রমন? তবে কি পাকিস্তান সরকার চায়ই না এই চরমপন্থিদের দৌরাত্ম থামুক?
পাকিস্তানে এই আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন একটি শ্লোগান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেখানে। “ইয়ে যো দেহশাদগার্দি হে, ইসকে পিছে ওয়ার্দি হে”! বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় : এই যে এত হানাহানি এর পেছনে আছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। পাখতুনরা আঙুল তুলেছিল বরাবর সরকারের উপরেই! তাদের অভিযোগ ছিল সরকারই চায় না ঐ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ কমুক বা নির্মূল হোক কারণ সেই সন্ত্রাসের কর্তা স্বয়ং সরকার! সন্ত্রাস নিধনের নামে আসলে চলছিল পাখতুন নিধন।
এদিকে আন্দোলন মেহসুদ হত্যার পর শুরু হলেও তার কেন্দ্র শুধু মেহসুদই ছিল না। ঐ আন্দোলন থেকে দাবি আসে বিচারহীনভাবে যত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে তার সবগুলোর স্বাধীন বিচার করা হোক। কারণ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ছিলো পাখতুন জনগোষ্ঠী। এছাড়াও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে কারিগর এই অদক্ষ বাহিনীগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সোচ্চার দাবিও ছিল। মোট কথা ঐ আন্দোলনের মাধ্যমে পাখতিনসহ পুরো জাতি সরকারকে চাপ প্রয়োগ করেছিল যেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর থেকে কড়া আইনগুলোর নিষ্পত্তি করা হয়। সে সকল আইন মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। মূলত সে সকল আইন— যেগুলো উপজাতীয় জনগোষ্ঠী জীবন কোনঠাসা করে রেখেছিল। একটি আইনের জেরে একজন সন্দেহভাজনের খোঁজে পুড়ছিল পুরো পরিবার কিংবা পুরো গ্রাম।
আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর সরকার তাদের প্রতি সংহতি বা আলোচনার আহ্বান জানানো দূরের কথা সব কিছু থামিয়ে দিতে প্রয়োগ করল কঠোর সব ব্যাবস্থা। পুলিশি হামলা –এমন কি নিয়োগ করা হল সেনা! গণমাধ্যমকে বাধ্য করা হল পাখতুন আন্দোলনের কোন খবর প্রচার না করতে। পুলিশি আটক শুরু হল গুরুতরভাবে। আন্দোলনের নেতাদের যে কোন মিছিল শুরু করতে বাধা দেওয়া হল। এমনকি এখনো অনেক নেতাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এসকল কিছুর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া সেলের একজন মুখপাত্র পাকিস্তানের গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন। তার ভাষ্যে তিনি আন্দোলনের নেতাদের উপরেই দোষারোপ করলেন। তার অভিযোগ ছিল ঐ আন্দোলনকারীরা পাকিস্তান বিরোধী একটি প্রোপাগান্ডা দাঁড় করাতেই বিদেশি উস্কানিতে রাস্তায় নেমেছে। পাকিস্তানী ঐ সেনা কর্মকর্তার এমন কথা নতুন নয়, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ হরহামেশায় সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পেতে এমনটা বলে থাকে।
পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতার কারণেই আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাজপথে কখোনই এত মানুষ এক সাথে নামেনি। যদিও আন্দোলনের শুরু হয়েছিল অহিংস অবস্থা দিয়ে। তবে আন্দোলনে মানুষের সংহতি বাড়াতে সহিংসতার আশংকাও তীব্র হতে শুরু করল। আর ঐ রকম সহিংসতা হলে কি ঘটতে পারে তা পাকিস্তান আগেও দেখে এসেছে।
অনেকটা একই রকম আন্দোলনের কবলে পড়ে পাকিস্তান এবং আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়, সাধারণ একটি অধিকারের লড়াই রূপ নেয় স্বাধিকার আন্দোলনে। এরপর হত্যা-ধর্ষণ, সেনা অভিযান, যুদ্ধ অতঃপর স্বাধীন হয় বাংলা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ আর দ্বিখণ্ডিত হয় পাকিস্তান
ইতিহাসের শিক্ষা
পূর্বে অনেকটা একই রকম আন্দোলনের কবলে পড়ে পাকিস্তান এবং আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়, সাধারণ একটি অধিকারের লড়াই রূপ নেয় স্বাধীকার আন্দোলনে। এরপর হত্যা-ধর্ষণ, সেনা অভিযান, যুদ্ধ অতঃপর স্বাধীন হয় বাংলা, জন্ম নেয় বাংলাদেশ আর দ্বিখণ্ডিত হয় পাকিস্তান। সাল ১৯৭১।
১৯৬০ এর দিকে বাঙালি জণগোষ্ঠী ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী। যাদেরকে বরাবর রাখা হয়েছিল অবহেলায়, চাপিয়ে দেওয়া আইনি ব্যাবস্থায় চলেছিল নিপীড়ন। ঐ অত্যাচার আর নিপীড়ন এর মূলে ছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান। তাদের প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা না নিয়ে তখনকার সরকার উল্টো নিরীহ মানুষের উপর সেনাবাহিনীর দানবীয় অভিযান চাপিয়ে দেয়, বাঙালি শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রাম! যার ফলেই ভাগ হয় পাকিস্তান।
ইতিহাসের ঐ ঘটনার প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তবুও মনে হচ্ছে পাকিস্তানের এলিট শাসক গোষ্ঠী এখনো তেমন শিক্ষা পায়নি। তারা আবার আগের গলদের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করছে। তারা ভুলে গেছে রক্তক্ষয়ী নিপীড়নের চূড়ান্ত পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। তারা ‘৭১ থেকে কোন শিক্ষা-ই এখনো কাজে লাগাতে পারেনি। তারা ব্যর্থ।
পিটিএম তথা পাখতুন আন্দোলনের এক বছর গড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনীর এখনই সময় ইতিহাস থেকে পাওয়া শিক্ষার সুষ্ঠু প্রয়োগ করার। পাখতুন জনগোষ্ঠীর উপর চলে আসা সকল নিপীড়নের বিচার করে তাদের অধিকার তাদের বুঝিয়ে দেওয়া। পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি পরিপূর্ণ মর্যাদা রেখেই তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর এখনই নিশ্চয়তা দান করা।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এখনই তাদের প্রাপ্ত শিক্ষার প্রয়োগ করতে না পারলে ‘পিটিএম’ একটি অনুঘটকে পরিণত হবে এবং এই আন্দোলনও দানা বাধবে একটি স্বাধিকার তথা স্বাধীনতার আন্দোলনে। পাকিস্তান ইতিমধ্যে একটি ভগ্ন রাষ্ট্র আর যদি এমনটা হয় তবে আবারো একটি রাষ্ট্রীয় অঘটনের মুখে পড়বে দেশটি।