ক্লোনিং

ক্লোনিং

ও তো ঘরে নেই বাবা, দরজা খুলে দিবো ভেতরে বসবে? বলতে বলতে রাবেয়া পর্দা ফাঁক করে সামনের বারান্দার জানালার দিকে তাকায়। যারা নক করেছিল দুয়ারে তারা চলে যাচ্ছে। গা টা ছমছম করে উঠে রাবেয়ার শরীর ঘেমে শীতল হয়ে গেল। একই চেহারার দুটো ছেলে একটা ছোট আরেকটা বড় তবে দু’জনেই তার ছেলে তিনু’র সুরতের, হুবহু। তারা যেন এই এলাকায় একেবারেই নতুন আর অস্বাভাবিক রকমের এদিক সেদিক তাদের তাকানো।

কিছু করার নেই মা। ওরা যেহেতু জানে আমি তাগোর বশ্যতা স্বীকার করিনা ফলে আমার মতোই দুইটা ক্যারেক্টার হুবহু আমি ই যেন, তৈরি করে নিয়েছে। আর আমাকেই না, শুনেছি যারাই তাগোর বশ্যতা মেনে নেয়নি সবারই এমন ক্লোনিং তৈরি করে নিবে, নিচ্ছে, যাতে সব চরিত্রগুলোকে ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারবে।– কথাগুলো তিনু খুব স্বাভাবিক ভঙিতে বললেও তার মা কাঁপতেছে ভয়ে। তিনু মা’কে কিছু টিপস আর স্থির সাহস দেয়ার লাইগাই কথাগুলো প্রস্তুতি নিয়েই বলছে যেন। রাবেয়া যখন ছেলে দুটোর কথা বলতেছিল তখন তিনু মাকে সাহস নিয়া রসিকতার স্বরে বলল –‘ মা, তাইলে তো একবার ওদের লগে দেখা হওয়া উচিত না সামনাসামনি, দেখতাম আমারে কেমন দেখায়’ বলেই ভয় কমানোর একটা নকল হাসি হেসে খাবার প্লেটে হাত ধুইলো তিনু।

একটু সাহস আর কৌশলে দিন যাপন করতে বলে গেল রাবেয়ার ছেলে। গা ঢাকা দিয়ে কাজ করে বেড়ায় কোথায় কোথায় সারাদিন। তিনুর ডান হাতের তালুতে একটা বড় কাটা দাগ আর কানের একটা অংশ সামান্য কাটা যা ওই গ্রুপের চোখে না পড়ার কথা, আর পড়লেও ক্লোনিং মানবদের ওইভাবে হাত, কান কাটেনি নিঃশ্চয়ই! এইসব কথাই বলে বেরিয়ে গেছিল সকাল সকাল।

রাবেয়া গোসল করতেছিল আর চিন্তা করে করে গায়ে পানি ঢালতেছে। কি এক দুঃসহ ভ্রান্তি নিয়ে পার করতে হবে সময়। কে জানে, এমনও তো হতে পারে যারে আজ রাতে বাতাস দিতে দিতে পাশে বসিয়ে ভাত খাওয়াবে, রাতে যেই ছেলেকে নিজের ছেলে মনে করে একসাথে থাকবে সে যদি তিনু না হয়ে ওই বানানো তিনু হয়! কি করবে সে, ভাবতে ভাবতে গায়ে এক মগ পানি ঢালে আবার ভাবে, কেন এভাবে অল্টার্নেটিভস তৈরি করতে হল তাদের, সব নিয়ন্ত্রণ করতে এমন কুপদক্ষেপ কি করে নিতে পারে? গোসলখানায় একেবারেই হালকা ধরণের পর্দা টাঙানো, চট আর দুয়েকটা টিন পিটিয়ে। দরজার মতো যে চটটুকু টাঙানো সেখানে তিনুর মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে। রাবেয়া গায়ে কাপড় জড়িয়ে হাতের দিকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করে। না, ঠিকাছে, হাত আর কানের ওখানটায় কাটা দাগ আছে।

‘কিছু বলবি’? রাবেয়া প্রশ্ন করল। কিন্তু উত্তর পেল না। রাবেয়া কিছু একটা অনুভব করতেছে। তাকে শক্ত হতে হবে। দূরে দাড়ানো একটা ছেলে যাকে রাবেয়ার সেদিনের ছোট ছেলেটার মতো মনে হচ্ছে। রাবেয়া বলল, ভেতরে আয় তিনু। এই বলে সে তার গায়ে পানি ঢালছে আর কখনো উরু, কখনো বুক, কখনো মেদযুক্ত পেট ডলার স্টাইলে দেখানোর চেষ্টা করল। রাবেয়া স্পষ্ট বুঝতে পারল,–এ তিনু না। সে চোখ গরম করে পানি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করলো–‘কি চাই?’ ভেগে গেল ছেলে দুটি। রাবেয়ার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে–‘গতকাল রাতে তাহলে যারে ভাত খাইয়েছি, যে আমারে আমার ছেলেকে চিনার টিপস দিল সে আমার তিনু ছিল না!’

রাতে হন্তদন্ত হয়ে তিনু বাসায় ফিরল। মন-মেজাজ কিছুটা খারাপও বটে। পেটে প্রচন্ড খিদে তাই খেতে খেতে মন খারাপ আর গত দুইদিন তার বাসায় না থাকায় তৈরি হওয়া জটিলতা নিয়া মায়ের সাথে কথা বলবে ভাবছে। মায়ের চেহারা এত বেশী শুষ্ক! খেতে বসছে তিনু। কিন্তু মা রহস্যভরা চোখে তিনুকে দেখছে আর খাবার-দাবার এগিয়ে দিচ্ছে। পাশে বসে ধীর চোখে দেখতে দেখতে তিনুর সামনে তার মা ব্লাউজ খুলে ফেলল! তিনু হতবাক হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল–‘মা, প্লিজ কি করছ এসব!’ রাবেয়া নিশ্চিত হোল, এ তার সন্তান তিনু। সে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলেও তিনু মুখ ভার করে আছে। এক পর্যায়ে বাড়ি ফেরার পথে লোকমুখে শুনে আসা মায়ের কর্মকাণ্ড মাকে জিজ্ঞেস করবে এমন সময় তার মা গতকালের কথা তোলে। শুনে বিভ্রান্তিতে ডুবে যায় তিনু–‘তাহলে সত্যিই মা বুঝি গ্রামের কোনো এক ছেলেকে গোসলখানায়.. ছি:, এখন বিচার তো বসাইবোই শুনছি, মোটে মাতুব্বর মুনশি সুযোগ পায়না…, জানি না কতটা লজ্জিত আর ত্যাগ স্বীকার করতে হতে পারে’।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রুনাকে ফোন দেয় তিনু। দেখা করবে, হালকা হওয়া যেতে পারে যদি কিছুটা। ‘তিনু, তোমার বাবার কি কোনো জমজ ভাই ছিল, বলো তো!’

-না, তুমিও কি আমারে এখন বিভ্রান্ত করবা নাকি? বলো কি হয়েছে।

‘রাগ করো না। দেখো আমি নিজ চোখে দেখেছি, হুবহু তোমার বাবার মতো একটা লোকের সাথে তোমার মা রিকশা করে গতকাল কই যেন গেল, অথচ তোমার বাবা মারা গেছেন তো সেই কবেই!’ তিনু কিছুই বলল না। সে বুঝতে পারলো, কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। এটা খুব সহজ কিছু না। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।

এসে দ্যাখে, ঘরভর্তি মেহমান। তার খালা আর কারা যেন। সামনের খাটে শুয়ে শুয়ে পা নাড়াচ্ছে তিনু। এমন সময় তার মতো হুবহু কাদেরকে সে দেখতে পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসে। মাকে ডাক দেয়। রাবেয়া দৌড়ে পানি নিয়ে আসে আর কোমল স্বরে বলে–‘একটু ধৈর্য ধর বাজান, আমিও শুনছি রুনা নাকি ইদানিং তোর বাপের বয়সি বুড়া এক লোকের লগে রাস্তায় কথা কয়, তোর খালায়ও নাকি আসার সময় পথে একটু আগে দেইখা আসছে। নে বাপ পানি খা, আমি তরে একটা ভাল মাইয়া বিয়া করামু।’

তিনু মাকে জিজ্ঞেস করে–‘আপনার নাম রাবেয়া তো?’ প্রশ্ন শুনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিকে ফ্যালফ্যাল কইরা তাকাইতে থাকে আর একটা দোয়েল কাপলা গাছে বসে তার পূর্বসুরীদের কথা এক ধ্যানে মনে করতে থাকে!