ম্যাচের ‘ভিলেনও’ হতে পারতেন তিনি। এক ওভারে দুই দুটি ক্যাচ মিস করে ম্যাচ হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যেতে পারতো। ম্যাচ শেষে পরাজয়ের গ্লানির ভীড়ে আঙ্গুল উঠতো তার দিকেই। কিন্ত ম্যাচের রঙ বদলানোর দায়িত্ব তিনি নিলেন নিজ হাতেই। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক ম্যাচে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে মাঠে নেমে ‘ভিলেন’ থেকে হিরো হলেন তিনিই। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের উঠতি ক্রিকেটার অ্যালিস আল ইসলামকে নিয়ে। হ্যাটট্রিক করে গ্যালাক্সির সব আলো নিজের করে নিলেন অ্যালিস। অভিষেকেই ইতিহাস গড়লেন তিনি। ২২ বছর বয়সী এই অফ স্পিনার হ্যাটট্রিক করে বসলেন। রংপুরের বিপক্ষে জেতালেন ঢাকাকে, পাশাপাশি ম্যাচ জয়ের নায়কও হয়ে রইলেন। অ্যালিসের মতো হ্যাটট্রিক করে ম্যাচের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছেন অনেক বোলারই।
ক্রিকেট খেলায় একজন বোলার ধারাবাহিকভাবে তিনটি বল ছুড়ে তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যাটসম্যানকে আউট করার মাধ্যমে তিনটি উইকেট লাভ করলে, তখন ক্রিকেটের পরিভাষায় তা হ্যাটট্রিক নামে পরিচিত। ১৮৫৮ সালে ‘হ্যাটট্রিক’ ক্রিকেট খেলায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। এইচএইচ স্টিফেনসন নামের একজন ক্রিকেটার ধারাবাহিকভাবে তিন বলে তিনটি উইকেট লাভ করে এ সম্মাননার মালিক হয়েছেন। স্টিফেনসনের এ অর্জনের প্রেক্ষিতে তাঁকে একটি হ্যাট প্রদান করা হয়েছিল। অবশ্য কাগজে-কলমে হ্যাটট্রিক শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৭৮ সালে। পরবর্তীকালে ফুটবল, ওয়াটার পোলো, হ্যান্ডবলসহ বিভিন্ন খেলায় ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৮৫৮ সালে শেফিল্ডের হাইড পার্ক গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত অল-ইংল্যান্ড ইলাভেনের হয়ে হাল্লাম দলের বিপক্ষে এইচএইচ স্টিফেনসন পরপর তিন বলে তিন উইকেট দখল করেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেট খেলায় এটি দারুণ সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু বিরল ঘটনা হিসেবেও বিবেচ্য। ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুই সহস্রাধিক টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র ৪৩ বার এ ধরণের হ্যাটট্রিকের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিকটি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলার এফআর স্পফোর্থ। তিনি মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ২ জানুয়ারি, ১৮৭৯ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে এ রেকর্ড গড়েন। সর্বশেষ হ্যাটট্রিকের ঘটনাটি ঘটে ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার খেলায়। ইংল্যান্ডের ডানহাতি বোলার মঈন আলি ২০১৭ সালে বিরল কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার হন। আজ থেকে ১৬ বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো হ্যাটট্রিক অর্জনের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। সাদা পোশাকের লড়াইয়ে পাকিস্তানের পেশওয়ারে স্বাগতিকদের বিপক্ষে অলোক কাপালির হাত ধরে অভিনব এ অর্জনের দেখা পায় বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে পরপর তিন বলে শাব্বির রহমান, দীনেশ ক্যানেরিয়া ও উমর গুলকে আউট করে রেকর্ড বইয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হ্যাটট্রিক অর্জন করার খাতায় নাম লেখান তিনি। বাংলাদেশি ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মধ্যে অলোক কাপালির পর দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক লাভ করেন সোহাগ গাজী। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্রগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে সোহাগ গাজী হ্যাটট্রিকসহ ৬ উইকেট ও সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন।
একই টেস্ট ম্যাচের দুই ইনিংসে দুইটি হ্যাটট্রিক লাভের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একবার। অস্ট্রেলীয় লেগ স্পিনার জিমি ম্যাথুস ১৯১২ সালের ২৮ মে তারিখে ওল্ড ট্রাফোর্ডে অনুষ্ঠিত ত্রি-দেশীয় প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দারুণ রেকর্ডটি গড়েন। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি উভয় হ্যাটট্রিকই পূর্ণ করেন দক্ষিণ আফ্রিকার টমি ওয়ার্ডকে আউট করার মাধ্যমে। অস্ট্রেলিয়ার আরেক বোলার এইচ ট্রাম্বল ১৯০২ ও ১৯০৪ সালে একই ক্রিকেট গ্রাউন্ড মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও টি-২০ বিশ্বকাপ উভয়েই হ্যাটট্রিক করার বিরল কীর্তি আছে অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার ব্রেটলি’র। পাকিস্তানের কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ চারবার হ্যাটট্রিক করেন। তিনজন খেলোয়াড় টেস্ট ক্রিকেট অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করার বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করেন। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের মরিস অলম, ১৯৭৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বোলার পিটার পেথেরিক এবং ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ড্যামিয়েন ফ্লেমিং অভিষেক টেস্টে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলার জিওফ গ্রিফিন হ্যাটট্রিক করলেও পুরো টেস্ট জীবনে মাত্র আট উইকেট লাভ করেছিলেন। হ্যাটট্রিক করার পর ঐ টেস্টেই থ্রোয়িংযের মাধ্যমে নো বল করার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। এছাড়াও পরবর্তীতে প্রদর্শনীমূলক খেলায়ও একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটান। পরে নিষেধাজ্ঞার কারণে আর কখনো টেস্ট ক্রিকেটে অংশ নেননি তিনি।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে এ পর্যন্ত মাত্র ৪৫ বার হ্যাটট্রিকের ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ওডিআই হ্যাটট্রিকটি করেছেন পাকিস্তানি বোলার জালালুদ্দিন। তিনি ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই কৃতিত্ব গড়েন। সর্বশেষ হ্যাটট্রিকটি করেছেন নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বোলার ট্রেন্ট বোল্ট, ২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে। বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার শাহাদাৎ হোসেন ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, রুবেল হোসেন ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, তাসকিন আহমেদ ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এবং স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক ২০১০ ও তাইজুল ইসলাম ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বিরল কৃতিত্বের অন্যতম অংশীদার হন। এদের মধ্যে তাইজুল নিজের অভিষেক ম্যাচেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন। একমাত্র বোলার হিসেবে তিনবার হ্যাটট্রিক করেন শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা। এছাড়া দু’টি করে হ্যাটট্রিক করেন পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম ও সাকলাইন মুশতাক এবং শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাস।
বিশ্বকাপের আসরে একদিনের ম্যাচে এ পর্যন্ত নয়বার হ্যাটট্রিক হয়েছে। প্রথমবারের মতো ১৯৮৭ সালে হ্যাটট্রিক করেন ভারতের চেতন শর্মা। সর্বশেষ রেকর্ডটির মালিক দক্ষিণ আফ্রিকার জেপি ডুমিনি। তিনি ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পরপর চার বলে চারজন ব্যাটসম্যানকে আউট করে দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হন শ্রীলঙ্কার বোলার লাসিথ মালিঙ্গা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি এই অনন্যসাধারণ রেকর্ডটি গড়েন। মালিঙ্গাই একমাত্র বোলার যিনি দু’টি বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করেছেন। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরাম এবং পেসার মোহাম্মদ সামি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এবং টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করেছেন। পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার আকিব জাভেদ সর্বকনিষ্ঠ হ্যাটট্রিকধারী বোলার। মাত্র ১৯ বছর ৮১ দিনে তিনি ভারতের বিপক্ষে এ রেকর্ড করেন। অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার ব্রেট লি একমাত্র ক্রিকেটার যিনি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এবং টি২০ ক্রিকেটে হ্যাটট্রিককারী একমাত্র বোলার।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের মতো ক্রিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণে হ্যাটট্রিকের সংখ্যা মাত্র ছয়টি। প্রথম হ্যাটট্রিকটি করেন ব্রেট লি, বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০০৮ সালে কেপটাউনে তিনি এই রেকর্ডের মালিক হন। সর্বশেষ হ্যাটট্রিকটি আসে পাকিস্তানের ডানহাতি বোলার ফাহিম আশরাফের ঘূর্ণি থেকে। আবুধাবিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনি এই কীর্তি গড়েন। এছাড়া নিউজিল্যান্ডের ডানহাতি ফাস্ট বোলার জ্যাকব ওর্যাম ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, ওর্যামের সতীর্থ আরেক ফাস্ট বোলার টিম সাউদি ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে, শ্রীলঙ্কান ডানহাতি ফাস্ট বোলার থিসারা পেরেরা ২০১৬ সালে ভারতের বিপক্ষে, লঙ্কান আরেক তারকা ক্রিকেটার লাসিথ মালিঙ্গা ২০১৭ সালে কলম্বোতে বাংলাদেশের বিপক্ষে এই কীর্তি নিজের নামের পাশে খোদাই করেন।