অরুন্ধতী রায়কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নাই। তবে একজন বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর কেমন হওয়া উচিত তিনি তারই আদর্শ নমুনা হয়ে আছেন। গত ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ আগে বোস্টন রিভিউ অরুন্ধতী রায়ের এই সাক্ষাৎকাটি নেয়। এই আলাপে, সাহিত্য, নাগরিক সমস্যা, উপনিবেশ, সাম্রাজ্য নিয়ে নতুন চিন্তার ইশারা, স্বৈরাচার থেকে শুরু করে তার গল্পের কাহিনী, সেন্সরশিপ, এবং ঔপনিবেশিক পরবর্তীকাল (Post-colonialism) এই টার্ম নিয়ে তার ধরাণাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বরেছেন। সাম্প্রতিক কালে এতো বিস্তারিত আলাপ তিনি আর খুব একটা করেন নাই।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এ অরুন্ধতী রায় সরাসরি একটি প্রশ্ন করেন, “ভালো মানের সাহিত্যের জন্য আবেগের গ্রহণযোগ্যতা কতখানি?” বাস্তব জগতের ভয়াবহতা, অবিচার, ক্ষমতা এবং কল্পনার জগত -এ দু’য়ের মধ্যকার সম্পর্কই তার প্রথম এবং বুকার জয়ী উপন্যাস “দি গড অব স্মল থিংস”-র মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল।
তার প্রথম এবং দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশের মাঝে ছিল বিশ বছরের বিরতি। এই সময়ে এই ভারতীয় লেখিকা উচ্চস্বরে এবং প্রকাশ্যে তার রাজনৈতিক ভিন্নমত পোষণ করে এসেছেন। এর ফলে অনেকেই আতঙ্কিত বোধ করেন বিশেষ করে যারা তার কাহিনীকে বেশি পছন্দ করতেন এবং ৯/১১ এর কাছাকাছি সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতির পালাবদলের কারণে বেশ স্বস্তিতে ছিল অনেকেই।
প্রধান ভারতীয় সংবাদ পত্রিকাগুলোতে রায়ের অসংখ্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ, বড় বড় বাধ, কর্পোরেট বিশ্বায়ন, ভারতের বর্ণপ্রথা, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থান, সাম্রাজ্যবাদের বহু দিক, এবং মার্কিনী অস্ত্রশস্ত্র —এইসব বিষয়গুলো তার লেখায় উঠে এসেছে। এ লেখাগুলো কখনো ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে আবার কখনো রোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, দেশের আদালতের দুর্নীতি, কাশ্মিরে ভারতীয় রাষ্ট্রের নৃশংস সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে কড়া সমালোচনা করায় অরুন্ধতী রায়কে গণমাধ্যমের রোষের শিকার হতে হয়েছে। রাজদ্রোহের অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হয়েছে তাকে। কখনো আবার ‘আদালত অবমাননা’র কারণে তাকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এত কিছুর পরেও এখনও তিনি যথেষ্ঠ স্পষ্টভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই সাক্ষাৎকারে, তার সাহিত্যে নান্দনিকতা এবং রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ক, ক্ষমতা এবং এর প্রভাব নিয়ে তার চিন্তাভাবনা এবং উপনিবেশ পরবর্তী যুগের লেখার মান এবং জীবনধারণ এসব বিষয় মূলত উঠে এসেছে। বোস্টন রিভিউ’র এসোসিয়েট এডিটর আভনি সেজপাল’র নেয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন, উম্মে সালমা।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে। আমাদের চলাফেরা, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সচেতনতা, তথ্য; এমনকি আমাদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের অনুভূতি পর্যন্ত —সব কিছুই ক্রমবর্ধমান গতিতে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক কঠোর প্রহরায় থাকছে যা সম্পর্কে আমরা খুব কমই ওয়াকিবহাল।
আভনি সেজপাল : ‘এন অর্ডিনারি পারসন’স গাইড টু এম্পায়ার’ (২০০৪), আপনার এই বইটিতে আপনি একটি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বায়ন এবং নব্য উদারনীতিবাদ, সুদৃঢ় সামরিক ব্যবস্থা এবং কর্পোরেট মিডিয়া-এসকল স্তম্ভের কথাই বইতে উল্লেখ করেছেন। আপনি লিখেছেন, “কর্পোরেট বিশ্বায়নের এই প্রকল্পটি গণতন্ত্রে ফাটল ধরিয়েছে। অবাধ নির্বাচন, মুক্ত সাংবাদিকতা এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে যখন মুক্ত বাজার সর্বোচ্চ করদাতার কাছে বিক্রয়ের জন্য পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়”। বর্তমানে আপনি এটাকে কিভাবে আপডেট করবেন?
অরুন্ধতী রায় : এটা আসলে চৌদ্দ বছর আগের কথা! বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্ণবাদ, জাতিভেদ প্রথা (হিন্দু ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ কর্তৃক অনুমোদিত) এবং লিঙ্গ ধর্মান্ধতা (এটিও প্রায় প্রত্যেকটি পবিত্রগ্রন্থ কর্তৃক অনুমোদিত) এগুলোকে ব্যবহার করে বৃহৎ পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে। আর এটি (পুঁজিবাদ) এভাবেই জটিল এবং কল্পনাপ্রসূত উপায়ে নিজেকে শক্তিশালী করেছে, গণতন্ত্রের ভিত্তি দূর্বল করেছে এবং বিরোধী দলের প্রতিরোধ শক্তিকে নিঃশেষ করছে। ভারতের সমাজে শ্রেণি-সংঘাত এবং পুঁজিবাদের সর্বাধিক পাশবিক ব্যবস্থা মজবুত থাকার ফলে নতুন করে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই পুঁজিবাদ একটি ইঞ্জিন যা গোটা ভারতকে পরিচালনা করে। জাতিভেদ প্রথার কোনো কালার বা রঙ নেই। যদি তাই থাকতো এবং যদি এটি খালি চোখে দৃশ্যমান হতো, তবে দেখা যেত ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে জাতিবিদ্বেষের চর্চা চলছে সব সময়েই। আরেকটি কথা এই বিষয়টির ব্যাখার ‘আপডেট’র ব্যাপার নিয়ে আমাদের অবশ্যই চিন্তাভাবনা করতে হবে। এই যে নতুন নতুন প্রযুক্তির আগমন এটি এখন নিশ্চিত করবে যে বিশ্বের এখন আর একটি বিশাল শ্রমিক-শ্রেণির কোনো প্রয়োজন হবে না। তখন এমন একটি জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটবে যারা অর্থনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে না। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একজন কর্মীর দরকার হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে। আমাদের চলাফেরা, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সচেতনতা, তথ্য; এমনকি আমাদের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের অনুভূতি পর্যন্ত —সব কিছুই ক্রমবর্ধমান গতিতে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক কঠোর প্রহরায় থাকছে যা সম্পর্কে আমরা খুব কমই ওয়াকিবহাল। আর কতদিন পরে এলিটরা অনুধাবন করবে যে পৃথিবীর সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব যদি এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা থেকে তারা কখনো পরিত্রাণ পায়? যদি তারা স্বপ্রণোদিতভাবে এই নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে বিনাশ করতে চায় একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে— অবশ্যই তারা মানবিক এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার নামে তারা যদি এই উদ্যোগ নেয় তবে শিল্পখাতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। যেমনটা হয়েছিল গ্যাস চেম্বার, ফ্যাট ম্যান এবং লিটল বয়েজ ব্যবহারের ফলে। ডিজিটাল উপায়ে যদি কাজ হয়, তাহলে আধুনিক সমরাস্ত্র এবং পরমানু বা জীবানু যুদ্ধের আর কেন প্রয়োজন?
কীভাবে উগ্র-জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং একটি বিশাল জনসংখ্যা আপনার সমস্যা নির্ণয়ের গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন এনেছে?
উগ্র জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তাবাদের সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর দিক। জাতীয়তাবাদ দীর্ঘকাল ধরেই কর্পোরেট বিশ্বায়ন প্রকল্পের অন্যতম একটি অংশ হিসেবে বিদ্যমান আছে। বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজিবাদ যত সহজতর হচ্ছে, জাতীয় সীমানা ততই কঠিনতর হচ্ছে। ঔপনিবেশিক যুগে প্রয়োজন ছিল বৃহৎ জনসংখ্যাকে ক্রীতদাস এবং চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণি হিসেবে খনি এবং আবাদি জমিতে কাজে নিয়োগ করার। কিন্তু বর্তমানে যে নতুন নিয়ম তৈরি হয়েছে সেখানে প্রয়োজন জনগোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ রেখে অর্থ উপার্জনের জন্য তাগাদা দেওয়া। সুতরাং নতুন ফর্মুলা হলো মুক্ত পুঁজিবাদ এবং অবরুদ্ধ শ্রমব্যবস্থা। এখানে মুনাফাই হলো একমাত্র স্থির ও অপরিবর্তনীয়। এটি একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে কাজ করেছে। কিন্তু এখন পুঁজিবাদের যুদ্ধ মূলত সম্পদ এবং কৌশলগত ক্ষমতা (অন্যভাবে একে ‘শুধুমাত্র যুদ্ধ’ বলা যায়) লাভের জন্য। এই যুদ্ধের ফলে অনেক রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং এর ফলে একটি বিশাল জনসংখ্যা শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত অভিবাসীদের অবিরাম ঢল এখন মূর্তিমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতির তৈরি করেছে। এবং বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী এবং জাতীয়তাবাদীদের যে সমাবেশ হচ্ছে সেখানে এই উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর চামড়ার রঙ অথবা এদের ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
যখন ঝড় ওঠে, এই উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বাতাসকে নিজেদের আয়ত্তাধীনে আনার চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং একে অপরকে সাহস যোগায়। ইসরায়েলে সম্প্রতি একটি নতুন বিল পাশ হয়েছে। সেখানে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এই ইসরায়েল ইহুদীদের জন্য জাতীয় মাতৃভূমি। এবং অ্যারাবিয়ান নাগরিকবৃন্দকে দ্বিতীয় শ্রেণি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটা বেশ অস্বস্তিকর হলেও এখনো দারুণ নির্লজ্জের মতোই টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের বাকি দেশগুলোতে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিত হয়ে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে মুসলমানদের সুন্নি-শিয়া বিভেদকে আরো শাণিত করার জন্য। যার সর্বনাশা সমাপ্তি ঘটতে পারে ইরানের উপর আক্রমণ চালিয়ে। ইউরোপের জন্যও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রাক্তন সহযোগী স্টিভ বেনন ‘দি মুভমেন্ট’ নামে একটি সংগঠন পরিচালনা শুরু করেছেন। এই সংগঠনের সদর দপ্তর হলো ব্রাসেলস’এ। এই সংগঠনের লক্ষ্য হলো, “ইউরোপে রাজনৈতিক জনপ্রিয় নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনের জন্য একটি ক্লিয়ারিং হাউজ তৈরি করা যেখানে তথ্য সংগ্রহ এবং আদান-প্রদান হবে।” এই সংঘটনটি আরো জানায়, তারা ইউরোপের রাজনীতিতে ‘আমূল গঠনমূলক পরিবর্তন’ (tectonic shift) আনতে চায়। এই ধারণাটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে অসাড় করে দেবে বলেই মনে হচ্ছে। এই ইউনিয়নের পৃথকীকরণের ফলে সমগ্র ইউরোপে অর্থনৈতিক সংযোজনের ক্ষেত্রে তেমন ক্ষতিকর নাও হতে পারে। তবে আমেরিকা সরকারের শোষণ এবং দর কষাকষির ক্ষেত্রে আবার অধিকতর সহজ হবে। ঠিক একই সময়ে ইউরোপ এবং আমেরিকান আধিপত্যবাদীরা একত্রিত হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য যা তারা হারিয়ে ফেলেছে।
ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি —রুদ্ধকর পরিস্থিতি, শিশু সন্তানদের সাথে তাদের পরিবারের পৃথকীকরণ; এ সকল ব্যাপার নিয়ে যথেষ্ঠ সমালোচনা করা হয়েছে। বারাক ওবামার সময়ে এই অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। তবে এখন এই ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনে সম্পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে। ভারতেও এখন এই অভিবাসন নীতি শুরু হয়ে গিয়েছে। বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদের এই যুগে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প ডানপন্থী (alt-right) দলগোষ্ঠীর সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যদি পুরো পৃথিবীর হালচাল সংক্ষেপে অনুধাবন করতে চান, তবে ভারতের দিকে তাকান। ২০১৮ সালে জুলাইয়ের ৩০ তারিখে আসামের নাগরিকবৃন্দের জাতীয় নিবন্ধন প্রকাশ করে। বস্তুত, অভিবাসন নীতির বিকল্প হিসেবেই এই নিবন্ধনের তালিকা প্রকাশিত হয়। ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এই তালিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। যে বছরে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধের কারণে প্রচুর শরণার্থীর ভারতে আগমন ঘটে। এর অধিকাংশই আসামে বসতি স্থাপন করে। এর ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যারা আদিবাসী ছিল তাদের উপর সবচেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়। এটি ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এর প্রেক্ষিতে গত দশকে কয়েক দফা গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৮৩ সালে কমপক্ষে ২০০০ মুসলমান হত্যা করা হয়। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে। বর্তমানে যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) ক্ষমতায়, মুসলমানদের জনসম্মুখে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া, স্থানান্তরকরণের মাধ্যমে এই যে লাখ লাখ জনগণ যাদের ‘বৈধ কাগজপত্র’ যেমন, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভূমির দলিলপত্র, অথবা বিবাহের সনদপত্র— কোনো কিছুই নেই। এর ফলে অপরিকল্পনীয় মাত্রায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। চার লাখ মানুষ যারা আসামে বসবাস করছে এবং কাজ করছে বছরের পর বছর তাদেরকে রাষ্ট্র ছাড়তে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ১৯৮২ সালে বার্মার রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। তারা এখন তাদের বসত ভিটা, পৈতৃক সম্পতি সবই হারাতে বসছে যা তারা বংশ পরম্পরায় অর্জন করেছিল। সর্বাপেক্ষা উত্তম হয়, এই ভাসমান উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে মোকাবেলা করার একটা উপায় হলো এদের সস্তায় শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো। আর পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক হলে, এদেরকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করা যেতে পারে। এই যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সংশয়াপন্ন এবং অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাদেরকেও রোহিঙ্গাদের মতো ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।
বিজেপি পশ্চিম বাংলায় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ করার ঘোষণা দিয়েছে। যদি তাই ঘটে, তবে দশ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হবে। এর ফলে, আরেকটি বিভাজনের সৃষ্টি হবে। অথবা স্রষ্টা না করুন, রুয়ান্ডার মতো পরিস্থিতির (ব্যাপকহারে গণহত্যা) সৃষ্টি হতে পারে। এর আসলে শেষ নেই।
এখন কাশ্মির উপত্যকায় ইসরায়েলের মতো উপনিবেশ গড়ে উঠতে পারে। বিগত ত্রিশ বছরে, কাশ্মিরে স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়। সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ প্রতিহত করতে গেলে মহাপ্রলয় অর্থাৎ ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বর্ণ, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, অথবা জাতীয়তার কারণে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার, শোষণ এবং নির্বাসনের মতো ঘটনা ঘটছে গোটা ভারতে। যার ফলে তারা এখন নিজেদের সংঘবদ্ধ করছে যে কোনো অত্যাচার এবং নির্বাসনসহ সকল প্রকার স্বৈরাচারমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধ করার জন্য।
অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাম্মু এবং কাশ্মিরে বিজেপি ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করতে চায়। এই পরিচ্ছদ ১৯৪৭ সালে এই সকল অঙ্গরাজ্যকে স্বায়ত্ত্বশাসিত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। এর অর্থ দাঁড়ায়, এখন কাশ্মির উপত্যকায় ইসরায়েলের মতো উপনিবেশ গড়ে উঠতে পারে। বিগত ত্রিশ বছরে, কাশ্মিরে স্বাধীনতার লড়াইয়ে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়। সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ প্রতিহত করতে গেলে মহাপ্রলয় অর্থাৎ ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
বর্ণ, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, অথবা জাতীয়তার কারণে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার, শোষণ এবং নির্বাসনের মতো ঘটনা ঘটছে গোটা ভারতে। যার ফলে তারা এখন নিজেদের সংঘবদ্ধ করছে যে কোনো অত্যাচার এবং নির্বাসনসহ সকল প্রকার স্বৈরাচারমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধ করার জন্য। সত্যি বলতে, নৈতিক অবস্থান থেকে এটি বলা খুবই সহজ যে এই সমস্যা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। কেননা এটি আসলেই কোনো সমস্যা নয়। এটি বিশাল আন্দোলন এবং প্রকট অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ মাত্র। বিভিন্ন সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদ, উপ-জাতীয়তাবাদ, শোষক শ্রেণি ও শোষিত শ্রেণি সকলের দাবি-দাওয়া সম্মিলিত দাবিতে রূপ নিয়েছে। এবং প্রত্যেকের দাবি সম্পত্তির (পানি, ভূমি, চাকরি, টাকা) উপর থাকায় খুব দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যে অগ্নিখেলা তারা শুরু করেছে, হাজার বছর জুড়ে এই আগুনে জ্বলে পুড়ে মরবে। এখন যদি আমরা ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় চলে যাই এবং সেখানে অবস্থান করি, যদি আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে একটি বাক্সে আবদ্ধ করে ফেলি এবং বিশ্বাস করতে শুরু করি যে, যা দৃশ্যমান তার বাইরে অন্য কিছু দেখার কোনো বিকল্প পন্থা নেই, তবে জটিল, ব্যাপক এবং তীব্র সংঘাতের মধ্যে নিজেদের খুঁজতে হবে। আর এভাবেই হয়তো পরিস্থিতি এইসব রহস্য উদঘাটনের দিকে নতুন করে মোড় নিতে পারে।
আপনি একটা প্রবন্ধে লিখেছিলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ “তাই অর্জন করেছিলেন যা অর্জন করার জন্য লেখকবৃন্দ, পণ্ডিতবর্গ এবং সক্রিয় কর্মীগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করে থাকেন। এই বুশ রাজনীতির যত অলিগলি পথ আছে তা একেবারে জনসম্মুখে প্রদর্শন করেছেন। তিনি আমেরিকান সাম্রাজ্যের রহস্য উন্মোচনের কলকব্জার খুঁটিনাটি, এর বিভিন্ন অংশসমূহ একেবারে জনসম্মুখে দৃশ্যমান করেছেন।” আপনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? এখনো কি আমেরিকান সাম্রাজ্যের রহস্যময় প্রকৃতি যথেষ্ঠ স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন?
৯/১১ এর ঘটনা এবং আফগানিস্তান ও ইরাকের উপর আক্রমণ চালানোর পর বুশের কথায় স্বচ্ছতা এবং বুদ্ধিমত্তার ছাপ পাওয়া যায় নি সেটা আমি আমার আরেকটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। এটি যুক্তরাষ্ট্রের গভীর স্তরের কিছু তথ্য প্রকাশ্যে উন্মোচন করে দিয়েছিল যদিও। যখন ডেমোক্রেট দল ক্ষমতায় অর্থাৎ ওবামার সময়ে এই স্বচ্ছতা পুরোপুরি গায়েব হয়ে যায়। ওবামার সময়ে আপনাকে অবশ্যই কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল যে কতগুলো বোমা ফেলা হয়েছে এবং কত লোকজন নিহত হয়েছে। এমন কি সেই সময়ে চমৎকার বক্তব্য প্রদানের জন্য ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পরেও এ তথ্যগুলো আপনাকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। যাই হোক, তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও এটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে ডেমোক্রেটদের বৈদেশিক নীতি রিপাবলিকানদের মতোই আক্রমণাত্মক। এখন আমরা ট্রাম্পের যুগেই বসবাস করছি। যেখানে আমরা অবগত হয়েছি যে বুদ্ধিমত্তা এবং স্বচ্ছতা আপেক্ষিক শব্দমাত্র। এবং বুশকে যখন ট্রাম্পের সাথে তুলনা করা হয়, দেখা যায় বুশই একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি প্রতি ঘন্টায় পুরো বিশ্বে প্রকাশিত হচ্ছে। আপনি এর থেকে স্বচ্ছতা আর কোথাও খুঁজে পাবেন না। কেউ কি কখনো ভেবেছিল যে অবাস্তব রহস্য উদঘাটন —এটিও সম্ভব হতে পারে? কিন্তু এটি বর্তমানে সম্ভব —আরো অনেক বেশি সম্ভব এবং আগামীতে এটি আরো দ্রুতগতিতে সম্ভবপর হবে যদি ট্রাম্প ইরান আক্রমণে কোনো মারাত্মক ভুল করে বসেন।
গত দুই দশকের ব্যবধানে প্রকাশিত আপনার ‘দি গড অব স্মল থিংস’ এবং ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ উভয় উপন্যাসে রচনাশৈলীগত যথেষ্ঠ পার্থক্য লক্ষণীয়। উভয় উপন্যাসেই রাজনীতি এবং সহিংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘দি গড অব স্মল থিংস’ এই উপন্যাসে লিরিক্যাল রিয়েলিজম (বাস্তববাদের সাথে ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির মিশ্রণ) এর যথেষ্ঠ প্রভাব রয়েছে। যেখানে নান্দনিকতা অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। এবং এই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে আশাবাদী ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে, ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ সংবেদনশীল এবং নীরস একটি উপন্যাস যেখানে বিপন্ন পরিবেশে টিকে থাকাই অনেক কঠিনতর একটি কাজ। ঔপনিবেশিক পরবর্তী (Post-Colonialism) এবং সর্বজনীন স্বীকৃত উপন্যাসে (global novel) এই যে লিরিক্যাল রিয়েলিজমের (বাস্তবতার সাথে নিজস্ব আবেগ অনুভূতির মিশ্রণ) প্রভাব —এটি কি উপন্যাসে সর্বজনীন রীতি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে? এবং ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এই উপন্যাস কি ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুনর্বিবেচনা করার একটি পরোক্ষ আহ্বান?
‘দি গড অব স্মল থিংস’ এবং ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী উপন্যাস। দু’টো উপন্যাসের কাহিনীও আলাদা। তবে উপন্যাস দুটি লেখার সময় ভাষার আধুনিক গঠন ও বিকাশের দিকে মনোযোগী ছিলাম। আমি আসলে ‘রচনাশৈলী’ নিয়ে খুব বেশি সচেতন নই। ‘দি গড অব স্মল থিংগস’ এই উপন্যাসে আমি একটি ভাষার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম যেটি ইংরেজি ও মালয়লাম —এ দুটি ভাষা ধারণ করে। আর এই ভাষার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট স্থান এবং সেই স্থানের লোকজনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। আবার ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ এই উপন্যাসটিকে সাহসী উদ্যোগ বলা যায়। এটি লেখা হয়েছে ইংরেজিতে তবে কল্পনা করা হয় অনেক ভাষায় যেমন, হিন্দু, উর্দু, ইংরেজি প্রভৃতি। উপন্যাস লেখার সময় আমি চেষ্টা করতাম এটি যেন নিছক কোনো গল্প না হয় যেখানে একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষাপটে কিছু চরিত্র ভূমিকা পালন করবে। আমি উপন্যাসে বর্ণনামূলক উপায়ে কল্পনার একটি জগৎ চিত্রায়নের চেষ্টা করতাম যেন এটি আমার নিজস্ব পৃথিবীতে একটি অন্যতম মহানগরী হয়ে উঠে। এটি হোক প্রাচীন বা আধুনিক অথবা কল্পিত এবং অপরিকল্পিত। এখানে মহাসড়ক এবং সংকীর্ণ গলি থাকবে, পুরাতন চত্ত্বর এবং নব্য মুক্ত রাস্তাও থাকবে। এই গল্পে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন তবে আপনাকেই ফিরে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে। গল্পের ভেতর পাঠক ঢুকে যেতে পারে, তবে একেবারে হারিয়ে যাবে না। আমার গল্পে দেখা যায়, কোনো ক্ষুদ্র চরিত্র, তারাও আপনাকে তাদের নাম বলবে, তাদের কাহিনী শুনাবে। শুধু তাই নয়, তারা আপনাকে জানাবে কোন জায়গা থেকে তারা এসেছিল এবং কোথায় তারা যেতে চায়।
একটি ব্যাপারে আমি সহমত প্রকাশ করছি যে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ যথেষ্ঠ সংবেদনশীল এবং খণ্ড-বিখণ্ড একটি উপন্যাস। প্রায় দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখা এই উপন্যাসের সংবেদনশীলতাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তবে আমি এটাকে কখনোই নীরস বলতে রাজি নই। এখানে দেখা যায় বেশিরভাগ চরিত্রই দুঃখ দুর্দশার কাছে হেরে যেতে রাজি নয়। বরং তারা সকল প্রকারের ক্ষণস্থায়ী প্রেম-ভালোবাসা, রসবোধ এবং অশ্লীলতাকেই প্রাণবন্ত করে তুলেছে। উভয় উপন্যাসে এই চরিত্রগুলোর জীবনে ভালোবাসা, কষ্ট, হতাশা এবং আশা —এগুলোই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ কারণে আমি নিশ্চিত নই যে কোনটিকে অবসাদগ্রস্ত বলা যায় আর কোনটিকে আশাবাদী বলা যায়।
আমরা যে দেশকে ভারত বলি সে দেশের সীমা পরিসীমাও তো বৃটিশদের কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। তাহলে ‘ভারতীয় ইংরেজি’ (Indian English) এর অর্থ কি? এটি কি তাহলে পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশি ইংরেজি থেকে ভিন্ন? না কি কাশ্মিরি ইংরেজি থেকে ভিন্ন? ভারতে প্রায় ৭৮০ রকমের ভাষার প্রচলন আছে। এর মধ্যে ২২টি ভাষা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত।
আপনার কিছু প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আমার কাছে নেই কেননা সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। যেমন, ‘সার্বজনীন’ উপন্যাস কি এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি মনে করি, আমার উপন্যাসগুলো অনেকবেশি স্থানীয়। আমি কখনো বিস্মিত হই এই ভেবে যে এই দুটি উপন্যাস বহু সংস্কৃতি এবং ভাষায় ছড়িয়ে পড়েছে। উভয় উপন্যাস চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্তু এই কারণে কি এই উপন্যাস দুইটি ‘সার্বজনীন’ বা ‘বিশ্বজনীন’ হয়ে গেছে? আবার, ‘উপনিবেশ পরবর্তী’ (পোস্ট কলোনিয়াল) এই টার্মটি আমাকে বেশ অবাক করে দেয় যদিও আমি নিজেও মাঝে মাঝে এই টার্মটি ব্যবহার করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি বর্তমানে উপনিবেশ যুগের পরবর্তী যুগ (পোস্ট) চলছে? উভয় উপন্যাসে এই একটি প্রশ্ন বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। এখনো সুরক্ষিত এবং ছদ্মবেশে উপনিবেশবাদের (colonialism) এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমরা কি একে পুরোপুরি বিদায় করতে পারি না? এমন কি ‘ভারতীয় ইংরেজি গল্প’ (Indian English Fiction) অবশ্যই একটি চমৎকার বিভাগ। কিন্তু এর দ্বারা আসলে কি বুঝায়? আমরা যে দেশকে ভারত বলি সে দেশের সীমা পরিসীমাও তো বৃটিশদের কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে। তাহলে ‘ভারতীয় ইংরেজি’ (Indian English) এর অর্থ কি? এটি কি তাহলে পাকিস্তানি অথবা বাংলাদেশি ইংরেজি থেকে ভিন্ন? না কি কাশ্মিরি ইংরেজি থেকে ভিন্ন? ভারতে প্রায় ৭৮০ রকমের ভাষার প্রচলন আছে। এর মধ্যে ২২টি ভাষা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের অধিকাংশ ইংরেজিগুলো আমাদের পরিচিত একটি অথবা ততোধিক ভাষার সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হিন্দি, তেলেগু, মালয়লাম ভাষাভাষীদের ইংরেজি বলার ধরণ ভিন্নরকম হয়। আমার গল্পের চরিত্রগুলো অসংখ্য ভাষায় কথা বলে এবং একে অপরকে বুঝার জন্য অনুবাদ করে দেয়।
আমার লেখায়, অনুবাদ শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রাথমিক ধাপ। প্রকৃতপক্ষে, আমি নিজেকে কখনোই ভারতীয় ইংরেজি ফিকশনের লেখিকা বলে মনে করি না। বরং নিজেকে একজন লেখিকা হিসেবে দেখি যার লেখায় চরিত্ররা অসংখ্য ভাষায় কথা বলে। আমি মনে করি আমার গল্প মূলত উদ্ভূত হয় একটি জায়গা থেকে যে জায়গাটি অনেক বেশি প্রাচীন এবং অনেক বেশি আধুনিক এবং অবশ্যই জাতিগত ধারণার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ কি ভারতীয় ইংরেজি উপন্যাসের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুনর্বিবেচনা করার একটি পরোক্ষ আহ্বান? সচেতন ভাবে যদি বলি, এর উত্তর হবে— না, কখনোই না। তবে একজন সচেতন লেখকের মূল অভিপ্রায় থাকে একটাই আর তা হলো কিভাবে গল্পে সার্থকতার সাথে যবনিকাপাত টানবে? যখন আমি কোনো গল্প লিখি, আমার মূল উদ্দেশ্য থাকে একটাই আর তা হলো একটি মহাবিশ্ব তৈরি করা যেখানে আমি পাঠকবর্গকে আমন্ত্রণ জানাই বিচরণ করার জন্য।
‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ —উপন্যাসের শেষ ভাগে একটি চরিত্র প্রশ্ন করে, “কিভাবে একটি খণ্ডবিখণ্ড গল্প (a shattered story) বলা যায়? উপন্যাসটি কিছু চরিত্র দ্বারা সমৃদ্ধ যাদের জীবনের গল্পগুলো রাষ্ট্রীয় ধ্যানধারণা কর্তৃক প্রভাবিত। এবং তাদের কাহিনীগুলো সবসময় রসবোধ, ক্রোধ, জীবনীশক্তিতে ভরপুর। যেখানে প্রতিনিয়ত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের নিত্যনতুন ঘটনাবলির কারণে জনসাধারণের জীবন বিপর্যস্ত, সেখানে আপনি কিভাবে গল্পের ছলে এইরকম কাহিনী উপস্থাপন করলেন?
‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ —উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে জাতীয় অনুভূতি এবং রাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া কাহিনিগুলোকে মোকাবেলা করে চলতে হয়। তাদেরকে জাতিগোষ্ঠী, ধর্মান্ধতা,লিঙ্গ বিশেষীকরণ এসকল সীমাবদ্ধতা এবং কিছু নির্বোধ লোকদের মধ্যে সমন্বয় করে চলতে হয়। বর্তমানে ইতিহাসের কাহিনী উপস্থাপিত হচ্ছে পৌরাণিক ছদ্মবেশে এবং পৌরাণিক গল্পগুচ্ছ (myth) বর্ণিত হচ্ছে ইতিহাসের ছদ্মবেশে। এটি অবশ্যই একটি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। এবং এটি সর্বদা বিপদজনক গল্প বলার চেষ্টা করে। বর্তমানে ভারতে, এই ভয়ংকর ঘটনাগুলো শুধুমাত্র রাষ্ট্রের. কারণেই ঘটে না; এর পেছনে দায়ী ধর্মান্ধরা, নির্দিষ্ট গোষ্ঠী, চৌকিদারেরা,এবং একদল দুর্বৃত্ত। এরাই রাজনৈতিক সুরক্ষা উপভোগ করে। শুধু তাই নয়, এরাই সিনেমা হলে আগুন দেয়, লেখকদের বাধ্য করে তাদের উপন্যাস প্রত্যাহার করার জন্য। এরাই সাংবাদিকদের হত্যা করে। এই ভয়াবহতা বর্তমানে নির্বাচনকেন্দ্র এবং রাজনৈতিক সংঘঠনগুলোতেও অনুমোদন পেয়েছে। সাহিত্য, চলচ্চিত্র এবং শিল্পকর্মেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে যেন এগুলোই রাজনৈতিক এজহার অথবা পার্লামেন্টে বিল পাশ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। প্রতিটি স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিয়োজিত অংশীদারদের (stockholders) ধারণা এসব চলচ্চিত্র, সাহিত্য এবং শিল্পের মাধ্যমেই তারা, তাদের গোষ্ঠী, তাদের ইতিহাস উপস্থাপিত হবে। এটি আশ্চর্যের কোনো বিষয় নয় যে দিন দিন এই সমস্ত ভণ্ডামি, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা আরো ফুলে ফেঁপে উঠছে। এবং যাদের কোনো রাজনৈতিক পটভূমি বা সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল নেই তারাও এদের রোষের শিকার হচ্ছে। আমি সম্প্রতি প্রগতিশীল রাষ্ট্র কেরালায় একটি মালয়ালাম চলচ্চিত্র দেখেছি। যার নাম হলো আব্রাহামিন্ডে সান্থাথিকাল (আব্রাহামের পুত্র)। এখানে দেখানো হয়েছে অসৎ, নির্বোধ, অপরাধী, দুর্বৃত্তরাই হলো কালো আফ্রিকান মানুষেরা। প্রকৃত পক্ষে, কেরালায় আফ্রিকার কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র গল্পের একটি দৃশ্যে অভিনয়ের প্রয়োজনে এদেরকে আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছে। এর জন্য কিন্তু আমরা রাষ্ট্রের উপর দোষ চাপাতে পারি না। আসলে এই রকম চিন্তাভাবনাই হলো মূল সমস্যা। এটাই সমাজ। এর নাম হলো জনগণ। শুধুমাত্র কালো চামড়ার কারণে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পীগোষ্ঠী, চলচ্চিত্র নির্মাতাবৃন্দ, অভিনয়শিল্পীরা, লেখকচক্র প্রতিনিয়ত উত্তর ভারতীয়দের কাছে উপহাসের শিকার হচ্ছেন। ঠিক একই কারণে আফ্রিকানদের অবমাননা করা হয়। এইরকম একটা পরিবেশে কোনো কিছু লেখার চেষ্টা করা, চলচ্চিত্র তৈরি করা অথবা সত্যিকার অর্থে পেশাদারি সাংবাদিকতা করা —এধরনের কাজ করতে গিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এইরকম একটা পরিবেশে কোনো কিছু লেখার চেষ্টা করা, চলচ্চিত্র তৈরি করা অথবা সত্যিকার অর্থে পেশাদারি সাংবাদিকতা করা —এধরনের কাজ করতে গিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একদল দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠী যেন সবসময়ই একটা স্থায়ী প্রাচীর গড়ে তুলেছে। তবে বাস্তব গল্পগুলো অবশ্যই তুলে ধরতে হবে।
একদল দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠী যেন সবসময়ই একটা স্থায়ী প্রাচীর গড়ে তুলেছে। তবে বাস্তব গল্পগুলো অবশ্যই তুলে ধরতে হবে। কিভাবে একটি খণ্ডবিখণ্ড গল্প(a shattered story) কিভাবে বলা যায়? এই প্রশ্নটি করেছিল ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র তিলো —তিলোত্তমা। যিনি দিল্লীর একটি সমাধিক্ষেত্রের একটি অবৈধ বাসভবনে বসবাস করেন। তিনি তার নোটবুকে হিজিবিজি বা দুর্বোধ্য কিছু লিখেছিলেন। এসবের ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ধীরে ধীরে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠা? অবশ্যই না। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি জিনিস হয়ে ওঠা। (“By slowly becoming everybody? of course not. By slowly becoming everything”) তিলো একজন স্থপতি। তিনি যত অদ্ভুতুড়ে সবকিছু যেমন, একজন অন্তিমশয্যাশায়ীর শ্রুতিলেখক ও একজন শিক্ষক এবং অদ্ভুত এক লেখক, অপ্রকাশিত গল্পগুচ্ছের সংরক্ষক। তার নোটবুকে যে হিজিবিজি লেখা আছে সেগুলো জনগণ, প্রাণী, আত্মা এবং জ্বীন জাতি নিয়ে গভীর চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। তিলোর এই জগৎ নিয়ে যখন আমাদের চারপাশে বিতর্কের ঝড় ওঠে তখন তিলোকে সম্ভবত অনেক ভর্ৎসনা করা হয়েছে। তিলো হয়তো বলতে পারতো, ‘পর্যায়ক্রমে স্বতন্ত্র লাভ করা’ অথবা একেবারে মন্দ অর্থে, ‘প্রতিটি বস্তু’তে রূপান্তরিত হওয়া বাস্তবিক বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যথার্থ নয়। অথচ এটি চরম সত্য। যাই হোক, একজন গল্পকথকের জন্য এসব কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। আমাদের এই ভঙ্গুরতা এবং এই উন্মাদের সমাজে “ধীরে ধীরে প্রতিটি বস্তু হয়ে ওঠা” (“By slowly becoming everything”) বা হওয়ার চেষ্টা করা একজন লেখকের কাজ শুরু করার জন্য সম্ভবত অনেক ভালো একটি ক্ষেত্র।
একজন ঔপন্যাসিক ছাড়াও আপনি একজন প্রতিভাবান প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক সক্রিয় কর্মী। আপনি কি এই ফিকশন এবং নন ফিকশনকে একে অপরের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখেন?
আমার এই অনমনীয়তা, দ্বিধাহীন চিত্তে নিরন্তর ছুটে এগিয়ে চলার কারণেই কি একজন ভালো কর্মী হতে পেরেছি এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমি মনে করি ‘লেখক’ হয়ে ওঠার জন্য যা করার দরকার কম বা বেশি তাই আমি করেছি। আমি কখনোই আমার উপন্যাস এবং প্রবন্ধগুলোকে একে অপরের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখি না। এরা সম্পূর্ণ আলাদা। যখন আমি উপন্যাস লিখি, আমি সময় নিই। ধীরে সুস্থে, ত্বরাহীন গতিতে আমি লেখা শুরু করি যা আমাকে অনেক অনেক আনন্দ প্রদান করে। আমি কিন্তু বলেছিলাম, আমি একটি মহাবিশ্ব তৈরি করার চেষ্টা করি যেখানে আমার পাঠকদের অবাধ বিচরণ থাকবে।
কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে জনগণকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে এক একটি প্রবন্ধ রচিত হয়। আমার প্রবন্ধগুলোতে তর্ক-বিতর্ক, রাষ্ট্রীয় মামলা প্রভৃতি এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আর তাই এগুলো কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। আমার প্রথম রাজনৈতিক রচনা ‘দ্য এণ্ড অব ইমাজিনেশন’ লিখেছিলাম ১৯৯৮ সালে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার পরে। আর দ্বিতীয়টি ‘দি গ্রেটার কমন গুড’লেখা হয়েছিল যখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নর্মদা নদীতে সারদার সারোভার বাঁধ প্রকল্পের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। আমি তখন আসলে উপলব্ধি করিনি যে এগুলোই ছিল মাত্র শুরু যার ধারাবাহিতায় আগামী বিশ বছর ক্রমাগত প্রবন্ধ লিখে যাব। সেই সময়ে লিখালিখি, ভ্রমণ করা, আদালতের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়া, এমনকি কারাগারে যাওয়া —এই বিষয়গুলো আমার চিন্তাভাবনাগুলোকে অনেক বেশি গভীর করে তোলে বিশেষ করে এই দেশ সম্পর্কে যেখানে আমি বসবাস করি এবং জনসাধারণ সম্পর্কে যাদের সাথে আমি বসবাস করি। এই অনুধাবনগুলো আমার ভেতরে আস্তরণের পর আস্তরণ হয়ে গড়ে উঠেছে।
আমি যদি বিগত ২০ বছর ঠিক এভাবেই লিখালিখি না করতাম, তবে আমি কখনোই ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’র মতো উপন্যাস লিখতে সমর্থ হতাম না। যখন আমি উপন্যাস লিখি, অবশ্যই রাজনৈতিক প্রবন্ধ নয়; আমি যুক্তি, সংগত কারণ, বিতর্ক, প্রকৃত ঘটনা এসকল স্থান থেকে লিখি না। আমার উপন্যাসের পটভূমি আসে বছরের পর বছর ধরে গভীর চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ শ্রমের ফসল হিসেবে। আর এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার চামড়া ঘর্মাক্ত না হয়ে উঠে। যে সময়ে ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ লিখা শুরু করেছিলাম, আমার কাছে মনে হয়েছিল একটি পাললিক শিলা নিজেই একটি উপন্যাসে পরিণত হচ্ছে।
‘ইন পাওয়ার পলিটিক্স’ (২০০১) এ আপনি লিখেছিলেন, “ব্যাপারটি এমন যেন দুটো ভারী ট্রাকের (একটি বিশাল বড় এবং একটি ক্ষুদ্র) বহর ভারতের জনগণকে সুসংবদ্ধ প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করছে। উভয় বহর দুটি বিপরীত অভিমুখে যাত্রা শুরু করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সর্বাপেক্ষা ছোট বহরটি পৃথিবীর শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য যাত্রা শুরু করে। আবার অন্য বহরটি অন্ধকারে বিগলিত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভারতে আমাদের কারো কারো জীবনটাও দু’টি ট্রাকের মাঝে নিষ্পেষিত অবস্থায় আছে। আর এই বহরগুলোকে এমনভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিহীন করা হয়েছে যার ফলে এগুলোর দেহজ আর অবশিষ্ট নেই। যা আছে তা হলো বুদ্ধিমত্তা আর আবেগ।” সমগ্র পৃথিবীতে অপ্রত্যাশিত এবং দ্রুততর গতিতে বিশ্বায়ন এবং নব্য-উদারতাবাদ শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আপনি কি বলতে পারেন, যে বহরটি পৃথিবীর শীর্ষে উঠে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে?
এই বহরটি এখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় নাই। তবে এর চাকাগুলো কর্দমায় ডুবে গেছে এবং ইঞ্জিন অতিমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে আছে। যাকে বর্তমানে আপনি কর্পোরেট হিন্দু জাতীয়তাবাদ বলেন, তাকে সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি’র অন্য সদস্যদের মতো মোদিও রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত সংঘ (Rashtriya Swayamsevak Sangh) এর একজন সদস্য। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংঘটন (RSS) আজকের ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান। বিজেপি এই RSS (Rashtriya Swayamsevak Sangh) এর শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক শাখা। এই আরএসএস’র প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২৫ সালে। এখন এই দলটির লক্ষ্য হলো ভারতীয় সংবিধানে একটি দীর্ঘ পরিবর্তন আনা এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে একটি হিন্দু জাতি ঘোষণা করা। মোদি তার মূলধারার রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করেন ২০০১ সালের অক্টোবরে। এসময় তিনি তার দল কর্তৃক গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত (নির্বাচনের মাধ্যমে নয়) হন। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে (৯/১১ এর আন্তর্জাতিক ইসলামোফোবিয়ার পরে) গুজরাটে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়। এ সময় প্রকাশ্যে দিবালোকে হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং দশ হাজার মুসলমান বাস্তুচ্যুত হয়। এই একই মাসে ভারতের অসংখ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগঠনগুলোর নেতাবৃন্দ মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রচুর উৎসাহ প্রদান করে। তাদের ধারণা ছিল মোদি একজন স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন এবং কঠোর রাজনীতিবিদ হবেন যিনি নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন এবং দেশের অভ্যন্তরে চলমান সকল প্রকারের আন্দোলন এবং অস্থিরতা দমন করতে পারবেন।
যাকে বর্তমানে আপনি কর্পোরেট হিন্দু জাতীয়তাবাদ বলেন, তাকে সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি’র অন্য সদস্যদের মতো মোদিও রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত সংঘ (Rashtriya Swayamsevak Sangh) এর একজন সদস্য। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংঘটন (RSS) আজকের ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান। বিজেপি এই RSS (Rashtriya Swayamsevak Sangh) এর শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক শাখা।
যাই হোক, এর বারো বছর পর ২০১৪ সালের মে মাসে মোদি পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রপ্রধানেরা তাকে এই বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এবং তারা বিশ্বাস করতেন যে তিনি ভারতকে আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থানের স্বপ্নের গন্তব্যে পরিণত করবেন। যদিও অচিরেই সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। কেননা তার ক্ষমতালাভের কয়েক বছরের মধ্যে তার প্রিয় সংগঠনগুলো এবং ঘনিষ্ঠ মিত্র পক্ষের লোকেরা তাদের সম্পদকে দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি করে। মোদির নেতৃত্বে কাঠিন্য এবং মুক্ত বাজারে দক্ষতার পরিচর পাওয়া যায়নি যা জনগণ আশা করেছিল। এর জন্য প্রধানত দায়ী ভাবাদর্শের তুলনায় স্বৈরাচারীমূলক চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়া। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ২০১৬ সালের নভেম্বরের এক রাতের শেষ ভাগে মোদি টেলিভিশনের সামনে হাজির হন এবং ‘মুদ্রা বাজেয়াপ্তকরণ’ (Demonetization) এর ঘোষণা দেন। সেই মুহূর্ত থেকে, শতকরা ৮০ ভাগ ভারতীয় মুদ্রা অবৈধ মুদ্রায় পরিণত হলো। ‘কালো টাকার’ (Black money) মজুতদারদের মাথায় যেন বজ্রপাত পড়লো। পূর্বে কোনো সরকারই এই ধরনের পদক্ষেপ নেয় নি। এটাকে সরকারের একপ্রকারের সার্বভৌম একনায়কতন্ত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বলা যেতে পারে। পুরো সপ্তাহব্যাপী, দৈনিক মজুর শ্রমিকেরা, ক্যাব চালকেরা, ছোট দোকানী ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টার দাঁড়িয়ে থাকতো এই আশায় যেন সঞ্চিত যৎসামান্য টাকা নতুন ব্যাংক নোটে রূপান্তরিত হয়। সমস্ত নোটগুলো, সর্বশেষ রূপি ‘কালো’ এবং ‘সাদা’ ব্যাংকে ফেরত যায়। এর ফলে অনেক বড় বাজেট মারাত্মক ধ্বসের শিকার হয়েছে।
মুদ্রা বাজেয়াপ্তকরণ এবং নব্য পণ্য ও সেবা করের এই প্রকট বিশৃঙ্খলতা ছোট ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সরকারের এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ যাকে বলা হয় ‘ব্যবসা-বান্ধব’ (Business -friendly), এটি বড় বড় বিনিয়োগদাতা অথবা খুব সাধারণ ব্যক্তির জন্য ছিল একরকমের প্রাণঘাতীমূলক আচরণ।
এই ভারতে একজন নারী হওয়ার তুলনায় গরু হওয়াটা অনেক বেশি নিরাপদ।
মুদ্রারহিতকরণ ভারতের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থভাণ্ডার শূন্য করে দিয়েছিল। কেননা তাদের অগণিত বেহিসাবি সম্পদগুলো সাধারণত নগদেই মজুত রাখা হতো। অন্যদিকে, এই বিজেপি’র রহস্যজনকভাবে সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল হিসেবে উত্থান ঘটে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ব্যাপক হারে গণহত্যা এবং ভয়ানক ধর্মান্ধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। কয়েক মাস আগে, সুপ্রিম কোর্টের চারজন বয়োজ্যেষ্ঠ বিচারকগণ সতর্কতা জারি করেন যে ভারতের গণতন্ত্র মারাত্মক বিপদজনক অবস্থায় আছে। এখনকার মতো পরিস্থিতি আগে কখনো ঘটে নি। এসকল দলের প্রতি একটু একটু করে ঘৃণার জন্ম হচ্ছে জনসাধারণের মনে। প্রতিদিনই আমাদের মতো দুর্বল চিত্তের মানুষদের সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইউটিউবে মুসলমানদের উপর দুর্বৃত্তদের কর্তৃক লাঞ্চনা —নির্যাতনের ভিডিও দেখতে হয়। আমাদের শুনতে হয় প্রকাশ্যে দলিতদের নির্যাতন এবং বিতাড়নের খবর। শুধু তাই নয়, ধর্ষনের দায়ে আটককৃত লোকদের সমর্থনে মিছিল চলে। গুজরাটের দাঙ্গায় গণহত্যার অভিযোগে যাদের জেলে নেয়া হয়েছিল তাদেরও মুক্তি দেওয়া হয়। অথচ রাজদ্রোহের মামলা দেখিয়ে মানবাধিকার কর্মীদের এবং হাজার হাজার আদিবাসীদের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। বাচ্চাদের ইতিহাসের পাঠ্যবই লিখিত হয় নির্বোধ ব্যক্তিদের দ্বারা।
সবইতো ঠিক আছে। কেননা, আমরা (ভারতীয়রা) অত্যধিক পরিমাণে অস্ত্র ক্রয় করছি ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর আমরা (ভারতীয়রা) এ প্রতিযোগিতায় অন্য যে কোনো দেশ থেকে এগিয়ে। ভারত হলো একটি দেশ যেখানে বৃহৎ জনসংখ্যার একটি অংশ হলো অপুষ্টিকর শিশু। এই দেশেই শত শত হাজার হাজার ঋণে জর্জরিত কৃষক এবং কৃষাণিরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এই ভারতে একজন নারী হওয়ার তুলনায় গরু হওয়াটা অনেক বেশি নিরাপদ। এবং এখনো গরুকে ক্রমবর্ধমান এবং দ্রুতগতির অর্থনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়।
‘সাম্রাজ্য’ এই শব্দটি ইউরোপ এবং আমেরিকার একটি স্বতন্ত্র সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যে ভারত এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক পরবর্তী (Post-Colonial) জাতিগোষ্ঠী নব্য ভূ-রাজনৈতিক আচ্ছাদনের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের পুরানো ধ্যান-ধারণাকে আকড়ে আছে? আপনি ‘দি মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’এ দেখিয়েছেন কিভাবে ভারতীয় সরকার সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপ এবং কঠোর প্রহরার কৌশলগত উন্নয়ন করেছে। একে সহজভাবে বলা যায়, সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতার বিস্তৃতকরণ। আমরা কিভাবে এই ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটিকে শুধু দক্ষিণাঞ্চলে (global South) সীমাবদ্ধ রাখতে পারি, যখন একই সময় আমরা দেখি পরবর্তী-ঔপনিবেশিক (post-colonial) জাতিগুলো তাদের পুরানো ঔপনিবেশিক প্রভুদের নীতিসমূহ অনুসরণ করে?
এটি আসলে অনেক ইন্টারেস্টিং একটি ব্যাপার। যে দেশগুলো নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করছে, যেমন: ভারত, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র; তারা সামরিক দখলদারিত্বের প্রতি অত্যধিক মনোযোগী। কাশ্মির অন্যতম একটি ভয়াবহ এবং সামরিক অধ্যুষিত ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা। বস্তুত ভারত রাতারাতি ঔপনিবেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়। বৃটিশরা ভারত ত্যাগ করে ১৯৪৭ সালের অগাস্টে। তখন থেকেই ভারতে মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম, কাশ্মির, জম্মু, হায়দারাবাদ, গোয়া, পাঞ্জাব এবং এখন ছত্রিশগড় এবং ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড —এসকল এলাকায় ‘নিজস্ব জনগোষ্ঠী’র বিরুদ্ধে বর্ডারগুলোতে সামরিক এবং উপ-সামরিক বাহিনীর মোতায়েন ঘটে। কারা এত ভয়ানক নাগরিক যাদের বিরুদ্ধে এই সামরিক ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজন হয়? এরা হলো আদিবাসী জনগণ, ক্রিশ্চিয়ান, মুসলমান, শিখ, কমিউনিস্ট লোকজন। এটি পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান যে হিন্দু সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষেরা সবাইকে শত্রু হিসেবে দেখে। অনেকেই হিন্দুয়ানিকে ঔপনিবেশের আরেকটি রূপ হিসেবেই দেখে থাকে। কেননা, ইতিহাসের পাতায় দ্রাবিড় এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো উল্লেখ নেই অথচ এদের আর্য শাসকদের হিন্দু পুরাণে অশুর এবং বিজিত অপদেবতা রূপে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এই পৌরাণিক যুদ্ধের কাহিনিগুলো যুগ যুগ ধরে রূপকথায় এবং স্থানীয় গ্রামীণ উৎসবের পুঁথিপত্রে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এখানে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মের এই ‘দানব’ সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে ‘দেবতা’র মর্যাদা লাভ করেছে। ঠিক এই কারণেই ঔপনিবেশিক-পরবর্তী (post-colonial) এই শব্দটিতে আমি অস্বস্তিবোধ করি।
ট্রাম্পের যুগে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বিরোধীমতের স্বাধীনতার আলোচনা অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ দিয়ে কখনো কখনো প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়। তবে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলো উন্নয়ন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে প্রতিবাদ কি কখনো আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারবে? এবং এরকম পরিবেশে, এই ধরনের মত-বিরোধমূলক সংলাপ কি সাম্রাজ্যবাদের ইমারতে ফাটল ধরাতে সমর্থ হবে?
আপনি ঠিক বলেছেন। সুসংগঠিত উপায়ে এই বিরোধীমূলক আলোচনার মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে পারে। যখন আপনি যুক্তরাষ্ট্রের সফল নাগরিক অধিকার আন্দোলনের দিকে তাকাবেন, অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের কথা চিন্তা করবেন; আপনি আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না যে সত্যিকারের প্রতিবাদ সম্ভব। এটি অবশ্যই সম্ভব।
কাশ্মিরে নিরস্ত্র গ্রাম্যবাসীদের সেনাবাহিনীর বুলেটের মুখে জীবন যাপন করতে হয়। কেন্দ্রীয় ভারতের সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রাম দেশের শীর্ষস্থানীয় কতিপয় ধনী সংগঠনগুলোর গতিপথ থামিয়ে দিয়েছে। এই জনসাধারণের অসামান্য বিজয়কে গুরুত্বসহকারে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। যদিও এদের সাহসীমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় কোনো প্রতিবেদন তৈরি হয় না। জনগণকে অসহায়, ক্ষমতাহীন এবং নৈরাশ্যবাদী করা রাজনৈতিক নীতিমালার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমরা নিজেরাই নিজেদের বোকা বানাই কেননা আমরা বিশ্বাস করি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং একজন নতুন রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী এসে একই বুনিয়াদি ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিলেই অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সুদিন আসবে। অবশ্যই বুড়ো খচ্চরদের (old bastard) কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে দিয়ে নতুনদের স্বাগত জানানো প্রয়োজন।
পুরো বিশ্বের আনাচে কানাচে এবং চতুর্দিকে এসব কি অরাজকতা ঘটে চলেছে এবং ইতিমধ্যে অনেক দূর অতিক্রম করেছে। একে থামাতেই হবে। তবে কিভাবে? প্রকৃত অর্থে, সকল ব্যাধি নিরাময়ের ঔষধ বা প্রতিকার আমার কাছে নেই। তবে আমি মনে করি এসকল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহী হয়ে উঠতে হবে। আমার ধারণা ক্ষমতা অবৈধ চর্চার ফলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সামনেই সেই দিনের সূচনা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের উপর আক্রমণের ফলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটি অচিন্ত্যনীয় বিশৃঙ্খলার সূচনা করবে এবং অনিশ্চিত যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে। সবচেয়ে বিপদজনক হলো যে ঝড়ের প্রবাহ উঠবে তা আগাম যে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাকে নিষ্ক্রিয় করে দিবে। আমরা নিজেরাই নিজেদের বোকা বানাই কেননা আমরা বিশ্বাস করি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং একজন নতুন রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী এসে একই বুনিয়াদি ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিলেই অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সুদিন আসবে। অবশ্যই বুড়ো খচ্চরদের (old bastard) কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে দিয়ে নতুনদের স্বাগত জানানো প্রয়োজন। অকপটে বলতে গেলে, যতক্ষণ না আমরা ‘সম্পদ’র (resources) নিরবচ্ছিন্ন উৎস খুঁজে পাব, যতক্ষণ না স্বতন্ত্র অধিকার রক্ষা করতে পারব, যতক্ষণ না বিভিন্ন সংগঠনগুলোর অগণিত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব, যতক্ষণ না আমরা বিশ্বাস করব যে আমাদের সকলের খাদ্য, পোষাক, বাসস্থান, শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই; ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সকল আলোচনা হবে নিছক ভণিতা মাত্র। কেন এই সাধারণ জিনিসগুলো জনগণকে এতো ভীত করে তুলছে, এগুলোই তো স্বাভাবিক এবং সার্বজনীন হওয়া উচিত। সকলে মিলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, অবাধ বা মুক্ত বাণিজ্য মানেই মুক্ত বা স্বাধীন নয় এবং এটি ন্যায়বিচার বা সমতার সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয় না।
আধিপত্যের বিরুদ্ধে সহিংস সংগ্রামের উদ্বেগজনক এই প্রশ্নটি ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। ফ্রানজ ফ্যানন’র লেখায়, গান্ধী, ফিলিস্তিন, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এবং নকশাল আন্দোলন এরকম আরো অনেক কিছুতেই এটি একটি বিতর্কিত অনুষঙ্গ। এই প্রশ্নটি আপনার ফিকশন এবং নন ফিকশনগুলোতেও উঠে এসেছে। স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
আধিপত্যবিস্তার এবং সহিংস আন্দোলন —উভয়েরই বিরোধিতা করি আমি। আসলে এই ব্যাপারটি যথেষ্ঠ হাস্যকর, তাই নয় কি? আমার কাছে, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম নীরব প্রতিরোধ একটি যুদ্ধের কৌশলগত পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং একটির মাঝেও কোনো ভাবাদর্শ নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যে সকল আদিবাসী জনগণ যারা বনের গভীরে বসবাস করে তারা কিভাবে নিঃশব্দে প্রতিহত করবে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের এবং হাজার হাজার উপ-সামরিক বাহিনীদের? এরাই চারিদিক অবরুদ্ধ করে এবং রাতের অন্ধকারে অগ্নিসংযোগ করে এই আদিবাসীদের পুড়িয়ে হত্যা করে। বিশ্বায়নের এই রাজনৈতিক মঞ্চে নিঃশব্দে প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন একজন সহানুভূতিশীল শ্রোতার। কিন্তু বনের গভীরে এরকম একজনও নেই। তবে কীভাবে এই অনাহারী জনগণ অনশন —ধর্মঘট চালিয়ে যাবে?
কোন কোন পরিস্থিতিতে, অহিংস ধর্মপ্রচারণা একরকমের সহিংসতা ঘটাতে পারে। এছাড়াও এটি এমন একটি পারিভাষিক শব্দ যেটি কি না ‘মানবাধিকার’ আলোচনাকে নিখুঁতভাবে বিলীন করে দেয়। শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা এবং ন্যায়বিচার চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে। যার ফলে সমস্ত দলগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
এই পরিস্থিতিকে একটি ভলিউমে বা সমষ্টিগতভাবে বলা যায় ‘বিপদজনক রাষ্ট্র’ (Evil Empire); যে টার্মটি সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে রোনাল্ড রিগ্যানের একটি লেখা থেকে নেয়া হয়েছে। এই লেখায় তিনি বলেছিলেন, কিছু মানুষ আছে যাদের ধারণা এই সাম্রাজ্যবাদই একটিমাত্র টেকসই প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কলকব্জা যা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে পরিচালনা করতে পারে। আমরা কিভাবে আধিপত্যবাদীদের কণ্ঠস্বরকে মোকাবেলা করতে পারি, যেখানে Niall Ferguson এর মতো ব্যক্তিত্ব যার পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা সাম্রাজ্যবাদের মূলে নিহিত থাকে? অন্যদিকে, আমরা কিভাবে উদারপন্থীদের কথা বলতে পারি, যারা ৯/১১ এর পরবর্তী সময়ে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সামরিক ব্যবস্থার উপর তাদের সকল বিশ্বাস স্থাপন করে? এই সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাভাবনার গ্রাস থেকে বের হওয়ার কি কোনো রাস্তা আপনি দেখেন?
‘শোষিত জনগণ’র ধারণা নেবার জন্য ফার্গুসনের শাসনসংক্রান্ত প্রেক্ষাপটের দিকে তাকানোর বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। শাসকবৃন্দ যাকে স্থায়িত্ব হিসেবে দেখেন, সেটাকেই জনগণ নিজেদের উপর জুলুম হিসেবে চিন্তা করে। একে কখনোই স্থিতিশীল বলা যায় না বরং এটি সাম্রাজ্যবাদকে আরো জোরালো করে। এই দিকটি আসলে ভয়াবহ। এবং একে কখনোই আমি যুদ্ধ বলব না যেখানে মানুষে মানুষে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বরং আমি এটাকে মৃতপ্রায় এই গ্রহের বিরুদ্ধে মানসিক সংঘাত বুঝাতে চেয়েছি। সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকেরা সাধারণত যে কোনো সাম্রাজ্যের সমর্থক, এই কথা আমি কখনোই বিশ্বাস করি না। তারা শুধুমাত্র আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক। সত্যি কথা হলো, পুঁজিবাদ হলো নতুন সাম্রাজ্য। আর সাদা চামড়ার পুঁজিবাদীরাই এই পুঁজিবাদ ব্যবস্থা পরিচালনা করে। সম্ভবত, চীনা সাম্রাজ্য অথবা ইরানি সাম্রাজ্য অথবা আফ্রিকান সাম্রাজ্য একই উষ্ণ অনুভূতি তৈরি করে না। আপনি যাকে ‘সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাভাবনা’ (imperial thinking) বলেন, এটি কেবল তাদের ভেতরই জেগে ওঠে যারা এর মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। আর যারা এর থেকে কোনোরকম উপকার পেতে চায় না এবং কখনো পাওয়ার প্রত্যাশাও করে না তারাই একে প্রতিরোধ করে।
সাম্রাজ্যবাদ কেবল একটি ধারণা নয়। এটি একরকমের গতিবেগ এবং একটি চালিকাশক্তি যা পুরো সীমানা জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং অবশ্যই আত্মঘাতী, ধ্বংসাত্মক। যখন নির্দিষ্ট সময় পর জোয়ারভাটার পরিবর্তন হবে, এবং একটি নব্য সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটবে, শাসকও পরিবর্তিত হবে। এবং আমাদের নতুন শাসক আসবে নতুন আড়ম্বরপূর্ণ জটিল ভাষা নিয়ে। এবং অবশ্যই একটি নতুন জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটবে যারা জেগে উঠবে এবং এই ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করবে।