ধারাভাষ্য-আম্পায়ারিং’র বেহাল দশা এবং বিসিবির দায়

ধারাভাষ্য-আম্পায়ারিং’র বেহাল দশা এবং বিসিবির দায়

  • বিপিএল ও প্রশ্নবিদ্ধ আম্পায়ারিং এর মান; ফিল্ড আম্পায়ারদের সাথে ভুল সিদ্ধান্ত দিতে দেখা গিয়েছে থার্ড আম্পায়ারকেও!
  • প্রশ্নবিদ্ধ ধারাভাষ্যও; সবেধন নীলমণি সেই আতাহার আলী খান
  • প্রতি আসর শেষে প্রতিশ্রুতি থাকলেও নেই সমাধান

আমার ঘরেও জ্বালা বাইরেও জ্বালা…

প্রয়াত বারি সিদ্দিকির এই জনপ্রিয় গানটার মতনই হালত যেন বিসিবির। বিপিএল বা ঘরের মাঠে কোনো সিরিজ হলেই অপ্রিয় সব সাওয়ালের মুখোমুখি হতে হয় বোর্ড কর্তাদের। মাঠ ঠিক তো আম্পায়ারিং এ ঝামেলা। সেটা যদি একটু ভালো হয় পেরেশানি বাড়ানোর দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নেন সম্প্রচারের সাথে যুক্ত আদমিরা। সব মিলিয়ে বিচিত্র এক অবস্থা।

আম্পায়ার যেন অথর্ব মূর্তি এক 

বাংলাদেশের আম্পায়ারদের মান নিয়ে বহুদিন ধরেই সাওয়াল থাকলেও সেটি চূড়ান্ত রুপ ধারণ করেছে বাংলাদেশ উইন্ডিজ সর্বশেষ সিরিজ থেকে। তানভীরিয় কর্মে লজ্জায় নত কর্তারা বিপিএল’এ বিশেষ নজর রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা কতটা কার্যকর হয়েছে তা তো আমরা খোলা চোখেই দেখছি।

ফিল্ড আম্পায়ারের পরে আসছি, থার্ড আম্পায়ার, যিনি রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত দেবার জন্য অবারিত সময় এবং সুযোগ পান তারাও যে ঝলক দেখাচ্ছেন তাতে চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম। ওয়ার্নার’র যে রান আউটটি থার্ড আম্পায়ার দিয়েছিলেন তা তে ওয়ার্নার তো বটেই বিস্মিত হয়েছিলেন পর্দায় চোখ রাখা সকলেই। ওয়ার্নারের সতীর্থ ক্রিজ থেকে বের হবার পরেও ক্রিজে না ঢুকেই কী করে নট আউট ছিলেন তা বোধ করি কারোর কাছেই পরিষ্কার নয়।

ফিল্ড আম্পায়ারিং নিয়ে নতুন করে কীই বা বলার আছে? ঢাকা-রংপুর হাই ভোল্টেজ ম্যাচে রাসেলের যে বলটিতে আম্পায়ার ওয়াইড কল করেছেন; সেটি দেখা যায় শুধু মহল্লার ক্রিকেটে। যখন আম্পায়ার থাকেন ‘কমিটির’ পক্ষের লোক এবং ব্যাটিংয়ে থাকে কমিটির দল! বিসিবির যেহেতু নিজের কোনো দল নেই; সুতরাং আম্পায়ারকে কমিটির দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে হবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি বলেই আমাদের বিশ্বাস। তার পরেও কেন আম্পায়াররা কমিটির আম্পায়ারদের মতন আচরণ করছেন সেটি তদন্তের দাবি রাখে।

এ আসরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জমজমাট ম্যাচ হয়েছে খুলনা এবং চিটাগাং এর মধ্যে। সে ম্যাচেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জঘন্য একটি সিদ্ধান্ত আমরা দেখেছি। ব্যাটসম্যান ফ্রাইলিঙ্ক যেখানে বারবার আর্জি জানাচ্ছিলেন থার্ড আম্পায়ারের সহায়তা নেয়ার জন্য, সেখানে ফিল্ড আম্পায়াররা অটল থাকেন তাদের সিদ্ধান্তে। হ্যাঁ, খেলোয়াড় চাইলেই যে আম্পায়ার থার্ড আম্পায়ারের সহায়তা নিতে বাধ্য এমন নয়। কিন্তু, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী সে সময় নিজেরাই ঐরকম সিদ্ধান্ত না দিয়ে থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠালে সেটিই হতো বুদ্ধিমানের কাজ। ঐ ম্যাচে যদি চিটাগাং হারতো তাহলে তার মূলে থাকতো আম্পায়ারদের ঐ বাজে সিদ্ধান্ত।

যে তিনটি উদাহারণ টানলাম তার প্রত্যেকটিতেই ভুক্তভোগী বিদেশি খেলোয়াড়রা। ওয়ার্নার সেরকম প্রতিক্রিয়া না দেখালেও রাসেল এবং ফ্রাইলিঙ্ক ক্ষোভ দেখিয়েছেন প্রকাশ্যেই। তারকার সমাবেশ চিন্তা করলে চলতি বিপিএল সবচেয়ে আকর্ষনীয়। সেখানে এমন আম্পায়ারিং ভবিষ্যতে বিদেশি খেলোয়াড়দের বিপিএল বিমুখ করে তুলতে পারে।

ধারাভাষ্য বিনোদনের অপর নাম 

মেঘমুক্ত মাঠ কর্দমাক্ত আকাশ…

এই ঐতিহাসিক লাইনটা যেন বাংলাদেশের ধারাভাষ্যের এক প্রতীক হয়ে রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট বহুদুর এগিয়ে গেলেও এ জায়গাটিতে আমাদের হালত ভয়াবহ। বিচিত্র ক্রিকেট জ্ঞান, অদ্ভুত বাচন ভঙ্গি এবং সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে এই শিল্পের যতটা সম্ভব শ্রীহরণ করে চলেছি আমরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধারাভাষ্য খেলার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। এ জায়গাটিতে আমরা এতটা উদাস কেন তা আমার বুঝে আসে না।

গতকালের ম্যাচেই বহুল সমালোচিত এক ভাষ্যকার, যিনি একাই দু’জনের কথা চালিয়ে নেন; তিনি আবারো অদ্ভুত এক বয়ান দিয়েছেন। বাংলাদেশের ভাষ্যকারদের মধ্যে সবেধন নিলমণি হয়ে রয়েছেন এক আতাহার আলী খান। টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার আঠারো বছর পার হয়ে গেলেও এক জন মাত্র ব্যক্তিকেই কেন দেশ বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে সেটি বিস্ময়কর। অথচ, এই সময়কালে আমরা টেস্ট, ওয়ান ডে, টি টোয়েন্টিতে বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার পেয়েছি; বিসিবি হয়ে গিয়েছে বিশ্বের পঞ্চম ধনী ক্রিকেট বোর্ড।

বিসিবি দাবি করে থাকে দর্শক আকর্ষণের দিক দিয়ে বিপিএল এর অবস্থান আইপিএল’র ঠিক পরেই। এবং এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সম্প্রচারিত হয়। সে সব দেশের সাধারণ দর্শকরা এহেন ধারাভাষ্য শুনে আমাদের সম্পর্কে কী ধারণা করছেন তা কি আমরা ভেবেছি? আমাদের হালত কী এতটাই খারাপ যে ইংরেজি ভাষায় দখল রাখা একজন আদমিও আমরা খুঁজে পাই না?

বর্তমানে দেশে ক্রিকেট নিয়ে দর্শকদের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এমন অনেক ছেলে মেয়ে রয়েছে যারা ক্রিকেট এবং ইংরেজি ভাষার ওপর দারুণ দখল রাখেন। তাদের একটা সুযোগ আমরা কেন করে দেই না? হ্যাঁ, দেশে যে পরিমাণে শিক্ষিত বেকার রয়েছে তা তুলনায় এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব কম। কিন্তু যদি পাঁচজন যোগ্য ব্যক্তির কর্মসংস্থান করা যায় তাই বা কম কিসে?

ক্রিকেটে যারা জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার তাদের বেশিভাগেরই ক্রিকেটের ব্যকগ্রাউন্ড রয়েছে। খেলার সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকাটা নিঃসন্দেহে তাদের বাড়তি সুবিধা দেয়। কিন্তু মাঠে না খেলে কেউ যে একদমই পারবে না এটা বাস্তব সম্মত চিন্তা না। আপনি ভারতের জনপ্রিয় ভাষ্যকার হার্শা ভোগলেকে দেখুন। তার ক্রিকেটের বলার মতো কোনো ব্যাক গ্রাউন্ডই নেই। কিন্তু ক্রিকেট জগতে তিনি ব্যাপক সমাদ্রিত। আমাদের ছেলে মেয়েদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে খেলাটির প্রতি। শুধু প্রয়োজন সুযোগের।

যেখানে বিসিবির দায় 

আম্পায়ারিং’র মানের এই দুরাবস্থার দায় সরাসরি বর্তায় বিসিবির ওপরেই। বিসিবি প্রধান যদিও এ বিষয়টি সমাধার কথা বলেছেন, কাজটা তার একার পক্ষে করা বেশ কঠিনই হবে। শুধু মাত্র বিপিএল বা জাতীয় দলের সিরিজে আম্পায়ারিং নিয়ে আলোচনার পর তা ভুলে যাবার প্রবণতা বিসিবির রয়েছে; অন্তত অতীত বিবেচনায় তাই দেখা যায়। এটি দূর করার জন্য শাস্তি কোনো সমাধান না। বিসিবিকে ঘরোয়া আসরগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। আম্পায়াররা তো বের হয়ে আসেন সেখান থেকেই।

যতদিন ঘরোয়া লিগে বিশেষ কিছু দলকে সুবিধা দেয়ার রাওয়াইয়্যাত অব্যাহত থাকবে ততদিন আম্পায়ারিং এর মানের যে কোনো হেরফের হবে না তা বলাই বাহুল্য। কোড অফ কন্ডাক্ট’র শেকল না থাকলে বাংলাদেশের কোনো আম্পায়ারই বোধহয় ম্যাচ ইজ্জতের সাথে শেষ করতে পারতেন না। ওপরে তিনটি উদাহারণ দিয়েছি। চিটাগাং-খুলনা ম্যাচ শেষে ভেবেছিলাম অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটবে। তা যে দুরাশা ছিল, তা গতকালই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। চিটাগাং এবং কুমিল্লা ম্যাচেও সেই একই ভুল!

হ্যাঁ, আম্পায়ারদের এমন ভুল করতে বিসিবি উৎসাহ দেয় না। কিন্তু এমন মানহীন আম্পায়ারিং এর ক্ষেত্রটা যেহেতু তৈরিতে পরোক্ষ ভূমিকা তাদের; তাই বিসিবির প্রয়োজন একটা গাইড লাইন ধরে দেয়া। তাতে, রাতারাতি অবস্থা বদলে যাবে না; কিন্তু বিতর্ক কিছুটা হলেও কমবে।

সম্প্রচারের দায়ও সরাসরি বিসিবির না। কিন্তু দিন শেষে সমালোচনা সইতে হয় বিসিবিকেই। এখন, যদি তারা গণ্ডারকে আদর্শ মেনে নীরবতাকেই শ্রেয় মানেন তবে তো কিছু বলার নেই। আমরা বিশ্বাস করি বিসিবি এখনো এতটা মোটা চামড়ার অধিকারি হয়নি। তাই, এ বিষয়ে আশু একটি উদ্যোগ কাম্য।

বিপিএল ক্রেজ যে এখন আর আগের মত কাজ করছে না তা গ্যালারি দেখলেই বোঝা যায়। বাসে-চায়ের দোকানের আড্ডাতেও আগের মতন বিপিএল নিয়ে আলোচনা নেই। এর পিছনে অন্যতম মূখ্য ভূমিকা যে সব বিষয়ের আম্পারিং এবং ধারাভাষ্য তার অন্যতম। এটি অনুধাবনে যদি বিসিবি আরো দেরি করে, তাহলে সোনার ডিম পারা এই টুর্নামেন্টের ভবিষ্যতে শনি ভর করবে তা বলাই যায়।