ভারতের ‘প্রাক্তন’ সিবিআই শীর্ষকর্তা অলোককুমার বর্মাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ রাজনৈতিক চাপানউতোর যেন অবশেষে সমাপ্ত হল! ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্ট ৮ জানুয়ারি অলোককুমার বর্মাকে পুনর্বহাল করার নির্দেশ দেয়। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বেঞ্চ অলোক বর্মাকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়। পাশাপাশি খারিজ করা হয় ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা হিসাবে যুগ্ম-অধিকর্তা নাগেশ্বর রাওকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত। বুধবার সকালে তিনি কাজে যোগ দেন এবং পূর্ণ উদ্যমে শুরু করেন ঘুঁটি সাজাতে। আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত এবং যোগ্য কর্মকর্তাগণকে দিল্লির সিবিআই সদর দফতরে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন তিনি, একাধিক নির্দেশ জারি করেন। সিবিআইয়ের যে-বিশেষ শাখায় প্রতিরক্ষা বিষয়ে দুর্নীতির তদন্ত করে, বর্মা সেই শাখার দায়িত্ব ন্যাস্ত করেন যুগ্ম অধিকর্তা এ কে শর্মাকে। রাফাল চুক্তিতে তদন্তের এফআইআর দায়ের করতে বেশি সময় নেবেন না অলোক বর্মা, অবগত ছিল সমস্ত রাজনৈতিক শিবির। মোদি সরকার যে আরও বেকায়দায় পড়তে চলেছেন, মনে করছিলেন বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। বিপদের খাঁড়া নেমে আসার পূর্বাভাস পেয়ে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অলোক বর্মাকে সিবিআই শীর্ষকর্তা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন তিনি। বুধবার রাতেই বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়্গের আপত্তি সত্ত্বেও বৈঠক ডাকা হয়, সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকালে ফের বৈঠক ডাকা হয়। নরেন্দ্র মোদি, মল্লিকার্জুন খাড়্গে এবং প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর প্রতিনিধি এ কে সিক্রি বৈঠকে বসে অলোক বর্মাকে অপসারণের জন্য ভোট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন। নরেন্দ্র মোদি এবং বিচারপতি এ কে সিক্রি অলোক বর্মাকে অপসারণের পক্ষে অবস্থান নিলেও বিরুদ্ধ মত জানান মল্লিকার্জুন খাড়্গে। তিনি যুক্তি দেন, বর্মার সম্বন্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তার বক্তব্য শোনা উচিত। নরেন্দ্র মোদি পাল্টা যুক্তি দেন, বর্মা তার বক্তব্য ভিজিল্যান্স কমিশনের নিকট জানানোর সুযোগ পেয়েছেন। ঐক্যমত হয়নি, যথানিয়ম খারিজ হয় খাড়্গের দাবি। বৈঠকে বর্মাকে সিবিআই শীর্ষকর্তা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ভারতের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের প্রধান অধিকর্তা অলোককুমার বর্মা এবং বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানা গত বছরে মল্লযুদ্ধে মত্ত ছিলেন। পদাধিকারে অলোক বর্মা এক নম্বর এবং রাকেশ আস্থানা দুই নাম্বার। গত বছরে বিশেষ অধিকর্তা রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ ও তোলা আদায়ের অভিযোগ ওঠে এবং তদন্ত শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে কড়া সমালোচনা করেন শীর্ষকর্তা অলোক বর্মা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজধানীর অলিন্দের গোপন সূত্র অনুযায়ী রাকেশ আস্থানা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশেষ আস্থাভাজন। তাই রাকেশ আস্থানার ঘুষ ও তোলা আদায় তদন্তে নিযুক্ত ১৩ জন অলোক বর্মার ঘনিষ্ঠ সিবিআই অফিসারকে ছলেবলে অবদমিত ও নিয়ন্ত্রিত করার উদ্দেশ্যে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয় গত বছরের ২৩ অক্টোবর মধ্যরাত্রে। অলোক বর্মা এবং রাকেশ আস্থানা দুই অধিকর্তাকে অনির্দিষ্টকালীন ছুটির নির্দেশ সম্বলিত পত্র ধরায় প্রধানমন্ত্রীর দফতর। সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেন বর্মা। মাত্র দু’দিন আগে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, পুনর্বহাল করতে হবে বর্মাকে। দায়িত্বভার গ্রহণ করে বর্মা ‘কাজ’ শুরু করেন। তার তৎপরতায় চাপ বাড়তে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি সরকারের। বৃহস্পতিবার সকালে কংগ্রেস সুপ্রিমো রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তোলেন, “বর্মাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? এর উত্তর একটাই- রাফাল তদন্ত।” অলোক বর্মাকে সিবিআই শীর্ষকর্তা পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আবারও প্রমাণ করলেন, জেপিসি-ই হোক বা সিবিআই; রাফাল চুক্তির তদন্ত নিয়ে তিনি ভীষণ আতঙ্কিত!”
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্যানেল অর্থাৎ বাছাই কমিটি অলোক বর্মাকে সিবিআই শীর্ষকর্তা পদ থেকে সরিয়ে কার্যত গুরুত্বহীন দমকলের ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আগামী ৩১ জানুয়ারি অলোক বর্মার অবসরের দিন নির্ধারিত ছিল। মাত্র ২০ দিনের জন্য বর্মাকে ডিজি (ফায়ার সার্ভিসেস, সিভিল ডিফেন্স, হোম গার্ড) পদে বদলি করা হয়েছিল। নতুন দেওয়া পদ নিতে অস্বীকার করে তিনি কর্মজীবনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই ইস্তফা দিলেন চাকরি থেকে। শুক্রবার কর্মিবর্গ দফতরের সচিব সি চন্দ্রমৌলিকে পত্র মারফত বর্মা জানিয়ে দেন, ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করলেন তিনি এবং নতুন পদে যোগ দেওয়ার বয়স তার নেই। এক বিবৃতি মারফত সাফ জানিয়েছেন তিনি, “স্বাভাবিক ন্যায়বিচার হয়নি। গোটা প্রক্রিয়া এমন কৌশলের সঙ্গে সাজানো হয়েছে, যাতে আমাকে সিবিআই অধিকর্তা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়।” সংবাদসংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ উগরে দেন ১৯৭৯ ব্যাচের আইপিএস অফিসার অলোক বর্মা। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “অন্যান্য বিষয়ে বাইরে থেকে আমার উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল৷ সিবিআই-এর মতো তদন্তকারী সংস্থার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছিল৷ আমি সংস্থার স্বতন্ত্রতার পক্ষে সওয়াল করেছিলাম৷” তার দাবি- মিথ্যা, গুরুত্বহীন এবং প্রমাণহীন অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিবিআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে বাইরের প্রভাবমু্ক্ত হয়ে কাজ করা উচিত, কিন্তু সেটা ধ্বংস করার পুরোদস্তুর চেষ্টা হয়েছে। আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ মন্তব্য করেন, “রাফাল কেলেঙ্কারিতে এফআইআর-এর ভয়েই বর্মাকে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মোদি সরকার।” বিরোধী শিবিরের দাবি, রাফাল চুক্তি-সহ আরও সাতটি ফাইল বর্মার টেবিলে ছিল যার অবধারিত তদন্ত করতেন বর্মা। তদন্ত হলে প্রধানমন্ত্রী এবং কর্তাগণের পর্দা ফাঁস হয়ে যেত! ২৩ অক্টোবর মধ্যরাত্রে তাকে ছুটিতে পাঠানোর সঙ্গে ১১ জানুয়ারি বদলির সিদ্ধান্তে স্পষ্ট যোগসূত্র রয়েছে।
সরকার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলছে, “বর্মার বিরুদ্ধে দশ দফা অভিযোগ ছিল।” এই দশ দফা অভিযোগের মধ্যে চারটি ভিত্তিহীন পরিগণিত হয়েছে এবং চারটি আরও তদন্তের সুপারিশ করেছে ভিজিল্যান্স কমিশন। দু’টি অভিযোগ আপাতত ‘সঠিক’ ধরে নিয়ে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ফৌজদারি তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্মার বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগ হল: ১) মাংস ব্যবসায়ী মইন কুরেশির থেকে দুই কোটি টাকা ঘুষ নেওয়া। ২) আইআরটিসি কেলেঙ্কারি (লালুপ্রসাদ ও তেজস্বী যাদবের নাম জড়িত এই কেলেঙ্কারিতে) থেকে এক অভিযুক্তর নাম বাদ দেওয়া। বর্মা বলেছেন, “মাত্র এক ব্যক্তি (রাকেশ আস্থানা) যে আমার বিরোধী; তার সারসত্যহীন, মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে বদলি করা হল। অথচ সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চলছে।” সিবিআই শীর্ষকর্তা পদে নতুন কাউকে নিয়োগ করার আগে পর্যন্ত এম নাগেশ্বর রাওকে ভারপ্রাপ্ত পদে বহাল করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর বর্মাকে ছুটিতে যাওয়ার নিদান দেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদির ‘প্রিয়পাত্র’ এবং ‘আস্থাভাজন’ এই নাগেশ্বর রাওকে অন্তর্বর্তীকালীন সিবিআই শীর্ষকর্তা করা হয়েছিল!
অলোক বর্মাকে বদলি প্রসঙ্গে পক্ষে-বিপক্ষে জোর তরজা চলছে দেশব্যাপী। প্রথম থেকেই বিরোধী শিবির দাবি করছে, নরেন্দ্র মোদির ‘হাতের পুতুল’ হতে চাননি বর্মা, তাই সুকৌশলে তাকে বদলি করা হল! অন্য দিকে সরকার পক্ষের যুক্তি, সিবিআই শীর্ষকর্তা হিসাবে যে ‘সততা’ থাকা আবশ্যক, তা ছিল না অলোক বর্মার মধ্যে। সিবিআইয়ের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য অলোক বর্মাকে বদলির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের জোর তরজা দেখে ভারতীয় আমজনতার মনে প্রশ্ন উঁকি মারছে, অলোককুমার বর্মা ‘ডক্টর জেকিল’ না ‘মিস্টার হাইড’?