টি টোয়েন্টির বিশেষজ্ঞ তৈরির কারখানা বিপিএল

টি টোয়েন্টির বিশেষজ্ঞ তৈরির কারখানা বিপিএল

টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের দীর্ঘসূত্রিতায় ক্রিকেট যেন একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিল। এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিতেই ২০০৮ সালে প্রথম সংক্ষিপ্ত সংস্করণে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের (আইপিএল) যাত্রা শুরু হয়। প্রথম আসরের সফলতার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ভারতকে অনুসরণ করে বাংলাদেশেও শুরু হয় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) যাত্রা। গত ৫ জানুয়ারি পর্দা  উঠলো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেটের ষষ্ঠ আসরের। প্রতি মৌসুমেই সবাই আশায় থাকে এই টুর্নামেন্ট থেকে উঠে আসবে দারুণ কিছু খেলোয়াড়। কিন্তু কতটা উঠে আসতে পারে তারা? কতটা আলোর মুখ দেখে এই আয়োজন?

ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে বরাবরই দারুণ ভূমিকা রাখে টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। বিপিএল নিয়ে দর্শকদের উন্মাদনাও লেগেই থাকে। সারা বাংলাদেশেই  ক্রিকেটের প্রচার ও প্রসারে সহায়ক হিসেবে কাজ করে এই টুর্নামেন্ট।। ক্রিকেটারদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটায় বিপিএল। জাতীয় দলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটের ভালো পারফরমাররাও এ থেকে দারুণভাবে উপকৃত হয়। ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের উন্নতিতেও বড় ভূমিকা রাখে বিপিএল। ২০১২ সালে প্রথম বিপিএল’র পর পরই দেশের মাটিতে বাংলাদেশের এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা তার বড় প্রমাণ। ভালো ভালো কর্পোরেট হাউস ক্রিকেটের সাথে সংযুক্ত হন।

প্রথম কয়েকটি আসরে তেমন কোনো আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার পায়নি বিপিএল। তাই সে সময় তেমন জমজমাটও ছিল না বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘরোয়া এই টুর্নামেন্ট। কিন্তু গত তিন আসরে ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালামদের মতো ক্রিকেটাররা খেলেছে এখানে। এসব তারকার অন্তর্ভূক্তি সবার আগ্রহ তৈরি করছে। ফলে উন্নতির দিকে এগোচ্ছে বিপিএল। বাংলাদেশ দলের জন্য ক্রিকেটার তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখছে বিপিএল। এর মূল কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের আগমনের ফলে তাদের সাথে দেশের তরুণ খেলোয়াড়দের একসাথে খেলার সুযোগ ঘটে। ফলে অভিজ্ঞতার আদান-প্রদানের ফলে দেশীয় ক্রিকেটাররা নিজেদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ পান। বর্তমানে টি-টোয়েন্টির প্ল্যাটফর্ম বিপিএল বেশ প্রতিযোগিতামূলক আসর। এখানে ক্রিকেটারদের প্রতিনিয়ত মানসিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। একটু পা হড়কে গেলেই সেই জায়গা দখল করার জন্য মুখিয়ে থাকেন অনেকেই। যার ফলে প্রত্যেকেই নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এখানে টিকে থাকতে। এই ফরম্যাটে তাই ক্রিকেটাররা অনেক বেশি শক্তিশালী। বিপিএলের প্রথম তিন আসরের আয়োজন নিয়ে সন্তুষ্টি ছিল না। পরিচালনা পর্ষদও সঠিকভাবে পরিচালনা করেননি। তবে এর পরের আসরগুলোতে টুর্নামেন্টটি মোটামুটি ঠিকভাবেই চলছিল এবং তখন থেকেই মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটাররাও খেলতে আসতে শুরু করলেন। যদিও ভালো মানের টুর্নামেন্টের জন্য বিপিএলকে আরো কিছু মৌসুম সময় দিতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের আনাগোনা দেশীয় ক্রিকেটারদের পারফর্ম্যান্সেও প্রভাব ফেলছে। বেশ কিছু তরুণ ক্রিকেটার প্রতি বছর ঝলক দেখাচ্ছে। এমনকি তারা জাতীয় দলের বিবেচনায়ও এসেছে। যারা এইচপি দলে আছে তারাও উত্তরোত্তর উন্নতি করছে। এর মূলে রয়েছে টুর্নামেন্টের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব। এমন মনোভাব বিপিএল তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। খেলতে আসা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের সাথে দেশি ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতা আদান- প্রদান করার দারুণ মাধ্যম এই প্ল্যাটফর্ম। তরুণরা মাঠের বাইরেও ড্রেসিং রুমে অভিজ্ঞদের সাথে নিজেদের মনোভাব আদান-প্রদান করতে পারে, নিজেদেরকে আরো পরিপূর্ণ ও দক্ষ ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় পরামর্শ পায়। যদিও সুদক্ষ ক্রিকেটার গড়ে উঠতে সময় লাগবে, তবে সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বিপিএল।

বিশ্বের ক্রিকেটাঙ্গণে বাংলাদেশ দারুণ সাফল্য পাচ্ছে, ধরাশায়ী হচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়লরা। বিপিএলের কারণে টি- টোয়েন্টি ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এর বড় প্রমাণ। শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টাইগাররা ভারতকে প্রায় টুর্নামেন্ট থেকে বের করে দিয়েছিল। বিপিএলের মতো আয়োজন ক্রিকেটের ভিত তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখে বলেই আত্মবিশ্বাসের সাথে যে কোনো শক্ত প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিজেদের সেরাটা মেলে ধরা সম্ভব টাইগারদের।

নাজমুল হোসেন শান্ত, আরিফুল হক, মেদেহী মিরাজের মতো ক্রিকেটাররা উঠে এসেছে বিপিএল থেকে। মিরাজ এখন জাতীয় দলের পরিচিত মুখ। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ঘরের মাঠে সদ্য সমাপ্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই তরুণ নিজেকে দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে বেশ ভালোভাবেই প্রমাণ করেছেন। শান্ত ও আরিফুলও বাংলাদেশ দলের বিবেচনায় আছেন। বলা চলে, বিপিএলের সেরা সাফল্য এ পর্যন্তই। বিপিএলের এই আসরকে কেন্দ্র করে দেশের ক্রিকেটাররা তাদের প্রতিভা আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু আশানুযায়ী খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে না। উপরন্তু যারা ঝলক দেখাচ্ছে তারাও নিজেদের ঠিকভাবে প্রমাণের আগেই ঝরে যাচ্ছে। আগের আসরগুলোর তুলনায় আস্তে আস্তে অনেকটাই গোছানো আয়োজন হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হচ্ছে যথেষ্ট।  ভবিষ্যতের টি-টোয়েন্টির বিশেষজ্ঞ তৈরিরও কারখানা বলা যায় বিপিএলকে। সে লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার। উদীয়মান ক্রিকেটারদের ধরে রাখার জন্য বিসিবিকেই বিপিএলের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে। প্রয়োজনীয় সুযোগ- সুবিধা ও সঠিক পরিচর্যা করলে আজকের বিপিএলের মাঠ কাঁপানো তরুণরাই অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে আনবে, নিঃসন্দেহে।