উন্নয়নের নামে গ্রামহত্যার মিশন বন্ধ করতে হবে

উন্নয়নের নামে গ্রামহত্যার মিশন বন্ধ করতে হবে

আক্ষেপ করে বলতে হয়, দাও ফিরিয়ে সে সুজলা সুফলা গ্রাম, লও এ জঞ্জালে ভরা শহর! এবারের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারে জোর গলায় বলা হচ্ছিল, নৌকায় ভোট দিলে গ্রাম হবে শহর। এই ধরণের ধ্বংসাত্মক প্রচারের পরে ভোট ডাকাতি করে অনির্বাচিত বা নিজেরাই নিজেদের নির্বাচিত করে ক্ষমতা দখলের ফলে গ্রাম ও আমাদের জাতীয় আগ্রগতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। গ্রাম রক্ষার জন্য আমাদের সোচ্চার না হলে বাংলাদেশেকে রক্ষা করা যাবে না। আজ সংক্ষেপে কিছু বিষয় তুলে ধরছি।

বাংলাদেশের গ্রামের জন্য খুব দরকারি কয়েকটি বিষয় হল-

১. গ্রামে গ্রামে কৃষি ভূমি সমীক্ষা করে তা রক্ষা করতে হবে। যাতে চাইলেই কৃষি ভূমি ভরাট করে আবাসন, কিংবা ব্যবসা বা শিল্প না করা হয়। এর জন্য দরকার সমন্বিত ভূমি মহা পরিকল্পনা। প্রতিবছর অন্তত ১.৫% থেকে ২% কৃষি ভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ আবাসন ও শিল্পের মডেল ঠিক করে এই কৃষি ভূমি আগ্রাসন থামানো যায়।

২. কৃষি ভূমির উপরিভাগ কেটে ইটের ভাটায় নিয়ে মাটির প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক উর্বরতা এবং হিউমাস নষ্টের দীর্ঘমেয়াদী চক্রান্ত বন্ধ করা। উপরিভাগের হিউমাস যুক্ত মাটি দিয়ে ইট বানানো হচ্ছে তাতে অন্তত বিশ বছরের জন্য একটি জমি উর্বরতা হারিয়ে ক্ষতিকর ও খরুচে রাসায়নিক চাষের খপ্পরে পড়ছে। টপ সয়েল দিয়ে বানানো ইটার ব্যবহার বন্ধের পদক্ষেপ নিতে হবে ধাপে ধাপে এবং বিদেশে ইটা রপ্তানি বন্ধ করতে হবে স্থায়ীভাবে। বিকল্প পরিবেশ বান্ধব ইটার বাধ্যতামূলক ব্যবহার নেয়া চাই।

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কথা মনে আছে? এই প্রকল্পে বেছে বেছে ক্ষমতাবলয় সংশ্লিষ্ট তৃণমূলের কর্মীদের ঋণের টাকা বিরতণ এবং তা গায়েব করা ছাড়া কোন আশাব্যঞ্জক অর্জন আসেনি।

 

৩. গ্রাম থেকে পলিথিন রিসাইকেল অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির একটি। এটা চূড়ান্ত লজ্জা ও হীনমান্যতার বিষয় যে, পলিথিন বাজারজাতকরণের পরে বিগত চার দশকে পলিথিন ব্যাগ ও প্যাকেজিং পলিথিন রিসাইকেল করা হয়নি। এই পলিথিন আমাদের জল স্থল সব বিষিয়ে দিয়েছে। বিষিয়ে দিচ্ছে আমাদের হাওড়, নদী এমনকি সমুদ্র উপকূলের ফ্লোরা ও ফাউনা। এই নির্লজ্জতা সীমাহীন, নিদারুণ!

৪. গ্রামে যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আছে তাকে উন্নত ও দক্ষ করা- গ্রামে নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি করা, সুনির্দিষ্ট শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও নিরাপত্তার অবকাঠামো গড়ার অঙ্গীকার।

৫. গ্রামীণ কৃষি অফিসগুলোকে অফিসার সর্বস্ব না করে বরং কৃষি সরঞ্জামের টুল হাউজ করে তোলা।

৬. গ্রাম ভিত্তিক কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের পরিসংখ্যান তৈরি ও নতুন নতুন স্কিল্ড ও সেমি স্কিল্ড কর্মসংস্থান বাড়ানোর টার্গেটের মাথাপিছু সংখ্যা ভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া। গ্রামীণ পরিসরের ব্যবসা ও কৃষির সেমি স্কিল্ড কর্মসংস্থানের কারিগরি সংশ্লিষ্ট ডোমেইন গুলোকে মধ্যমেয়াদি সার্টিফিকেশন কেন্দ্রিক এবং হ্যান্ডস অন ট্রেনিং কোর্স’র আওতায় এনে কাজের দক্ষতা বাড়ানোর অবকাঠামো তৈরি।

৭. গ্রামের পরিবেশ ও খাল রক্ষা করা, অপরিনামদর্শী জলাভূমি ভরাট বন্ধ এবং জলাবদ্ধতা বন্ধের টেকসই উদ্যোগ নিতে হবে।

৮. গ্রামীণ বনায়ণকে একচেটিয়া ব্যবসায়িক মডেলে ঠেলে না দিয়ে প্রাণ ও পরিবেশ বান্ধব করা, পাখি ও বন্যপ্রাণির খাদ্য চাহিদার আলোকে সাজানো। (সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় গাছের অভাবে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ার কথা মনে করা যেতে পারে)

৯. গ্রামের স্কুলে মান সম্মত ও মাথা পিছু হারে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

১০. গ্রাম পর্যায়ে মানসম্পন্ন ও মাথাপিছু হারে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা

১১. কৃষি ভূমির উপর চাপ কমাতে এবং আবাসন উন্নত করতে ভার্টিক্যাল ভিলেইজ ব্যবস্থার চালু করা। এই ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং ফাইনান্সিয়াল মডেলিং তৈরি করা। ১২. গ্রাম পর্যায় থেকে সন্ত্রাস দমন। এটা অবিসংবাদিত ভাবে সত্য যে ক্ষমতাবলয় সংশ্লিষ্ট তৃণমূলের কর্মীদের একটি বড় অংশ গ্রাম পর্যায়ে সন্ত্রাসী। এরা বিপদে পড়া মানুষ থেকে বখরা খায়, কৃষক ও ব্যবসায়ীর উৎপাদন ও উপার্জন থেকে চাঁদা খায়। এরা উপার্জন না থাকলে মানুষকে ইচ্ছাকরে বিপদে ফেলে টাকা খায়। এই দলীয় সন্ত্রাস ও দলীয়ভাবে সংঘটিত রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে লালিত অপরাধের লাগামটানাই গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা ও নাগরিক নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দিক।

১৩. গ্রাম থেকে মাদক নির্মূল। গ্রাম পর্যায়ে মাদকের সাপ্লাই চেইনকে স্থায়ীভাবে ভেঙে দেয়া।

১৪. গ্রামীণ ট্রান্সপর্টেশনের নিরাপত্তা সুবিধায় আন্তঃবিভাগীয় এবং আন্তঃবিভাগীয় সড়কগুলোতে ধীরগতির লেইন চাই।

১৫. গ্রামীণ ট্রান্সপর্টেশন সুবিধায় স্কুলগামী বাচ্চাদের সাইকেল ঋণ চাই।

১৬. গ্রামের বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ, স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ দেয়া যাই।

১৭. স্কুল ঝরে পড়া রোধে অন্তত গ্রামীণ স্কুলে ফ্রি ও মানসম্পন্ন টিফিন দেয়া চাই।

দুরদর্শী ও টেকসই গ্রাম উন্নয়নে বহুবিধ করণীয় আছে, ফাঁকা বুলি নয়, চাই বোধগম্য পরিকল্পনা ও তার দুর্নীতিমুক্ত ও মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন।

একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কথা মনে আছে? এই প্রকল্পে বেছে বেছে ক্ষমতাবলয় সংশ্লিষ্ট তৃণমূলের কর্মীদের ঋণের টাকা বিরতণ এবং তা গায়েব করা ছাড়া কোন আশাব্যঞ্জক অর্জন আসেনি। বিচ্ছন্নভাবে দু’একজন সাফল্য পেয়েছেন হয়ত। এই প্রকল্পের কোন ফলো আপ এবং দায়বদ্ধতা ছিল না। এটা একটা লুটের প্রকল্প ছিল যা কৃষক তৈরি করেনি, বরং করেছে লাঠি চাপাতি ও রড বাহিনী। গ্রাম উন্নয়নের নামে এইধরনের লুটের প্রকল্প আমরা আর চাই না, সে যত আকর্ষণীয় নামেই আসুক না কেন!

আমার গ্রাম কখনই যেন শহর না হয়ে উঠে। আমরা গ্রামকে শহুরে বস্তি করতে চাই না, গ্রামকে সুজলা সুফলা রাখতে চাই। নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন গ্রামই চাই আমরা। বস্তির শহর চাই না, প্রাণ ও পরিবেশের সুরক্ষা চাই, কৃষি সুরক্ষা চাই ।

কবি বলেছেন “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য লও এ নগর”।