বিগত এক দশক বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ‘স্বৈরাচার’ কিংবা ‘ফ্যাসিবাদ’। পৃথিবীব্যাপী স্বৈরাচারী সরকারেরা নির্দিষ্ট বিরতিতে ‘নির্বাচন’ দিয়ে থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ জনগণের জন্য এটা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে যে কোনটি ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার এবং কোনটি ‘স্বৈরাচারী’ সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক স্টিফেন এম. ওয়াল্ট জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘ফরেন পলিসি’তে ‘স্বৈরাচারী’ সরকারের ১০টি লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদাহরণের মাধ্যমে এই লক্ষণগুলো চিহ্নিত করেণ। নিম্নে এই দশটি লক্ষণ তুলে ধরা হলো:
১. গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণমাধ্যম বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকে৷ সরকারের সমালোচনা ও ভুল ধরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম৷ ফলে সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাংবাদিকদের দূরে রাখতে স্বৈরাচারী শাসকেরা পত্রিকা, টেলিভিশনকে ভয় দেখিয়ে কোণঠাসা করতে চান৷
২. সরকারপন্থি গণমাধ্যম সৃষ্টি : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে৷ ফলে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা সবক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷ পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে স্বৈরশাসকরা সরকারপন্থি গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন৷ এর ফলে ব্যাপক হারে সরকারের নানা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো সহজ হয়৷
৩. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ : রাষ্ট্রের সকল স্তরে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে স্বৈরাচারী শাসকরা পুলিশ, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সরকারি আমলাদের মধ্যেও দলীয়করণ প্রতিষ্ঠা করে থাকেন৷ এর ফলে জনগণের দিক থেকে ক্ষোভ দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয়৷
৪. সরকার-বিরোধীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি : রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীতাকারীদের ওপর নজরদারির কাজে লাগানো হয়৷ গোয়েন্দা মারফত পাওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে নানাভাবে হেয় করা ও কোণঠাসা করতে অপব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার৷
৫. বিশেষ সুবিধা ও দমনপীড়ণ : স্বৈরাচারী সরকার বা সরকারপ্রধানকে যেসব কর্পোরেট সংস্থা বা ব্যক্তি নানাভাবে সহায়তা করে থাকেন, তাদের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়া হয়৷ বেআইনি উপায়ে কাজ পাইয়ে দেয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে সহায়তা করা হয়৷ এমনকি তাদের সংসদে জায়গাও দেওয়া হয়। অন্যদিকে, যেসব সংস্থা সহায়তা করে না, তাদের ক্ষেত্রে চলে যে-কোনো উপায়ে দেউলিয়া বানানোর প্রক্রিয়া৷
৬. বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ : আদালত স্বাধীন থাকলে স্বৈরাচারী শাসকদের নানা সময়ে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়৷ ফলে শুরু থেকেই স্বৈরাচারী শাসকরা সুপ্রিম কোর্টকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করেন৷ অনুগত বিচারক নিয়োগ দেয়া, বিরোধীদের ছাঁটাই করা থেকে শুরু করে, নানাভাবে চেষ্টা চলে এ নিয়ন্ত্রণের৷ বিরোধীদের দমন করতেও একইভাবে আদালত ব্যবহার করে তারা।
৭. একপাক্ষিক আইন প্রয়োগ : স্বৈরাচারী শাসকদের শাসনামলে ‘আইন সবার জন্য সমান’ বাক্যটি থাকে শুধু কাগজে-কলমে৷ বাস্তবে প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য পাস করা হয় নতুন নতুন আইন৷ বিরোধীদের নানা উছিলায় গ্রেপ্তার নির্যাতন করা হলেও, নিজের সমর্থকদের রাখা হয় আইনের আওতার বাইরে।
৮. অযৌক্তিক ভীতি প্রদর্শন : বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে ভয়াবহ অবস্থা হবে, দেশ রসাতলে যাবে, বিরোধীরা কত খারাপ, ক্রমাগত সে প্রচার চালানো হয়৷ এর ফলে এমন অবস্থা তৈরির চেষ্টা হয় যাতে জনগণের মনে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা যায়
৯. দৃষ্টি সরাতে সংকট সৃষ্টি : ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ধরনের ভীতি তৈরি করে থাকেন স্বৈরাচারী শাসকরা৷ আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, গণতন্ত্রহীনতা ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে কোথাও জঙ্গি সংকট, কোথাও মাদকবিরোধী যুদ্ধ, কোথাও অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এমনকি এক্ষেত্রে তারা নিজের জনগণকে কুরবানি দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না।
১০. নির্বাচনে কারচুপি ও সন্ত্রাসী : আগে জোর করে ক্ষমতায় থাকার উদাহরণ থাকলেও, এখন স্বৈরাচারী শাসকরাও নিয়মিত বিরতিতে নির্বাচন দিয়ে থাকেন৷ জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার প্রমাণ করার জন্য তারা নির্বাচন দেন৷ কিন্তু সে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য যে কোন ধরনের অপরাধেই করার মানসিকতা তৈরি রাখেন।