দ্যা পোস্ট : মিডিয়া ও ক্ষমতার রাজনীতি

দ্যা পোস্ট : মিডিয়া ও ক্ষমতার রাজনীতি

সময় বড় অদ্ভূত জিনিস। বর্তমানে আমরা এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যেখান থেকে ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া স্টিভেন স্পিলবার্গের পরিচালিত এবং হলিউডের টম হ্যাংকস অভিনীত মুভি ‘দ্যা পোস্ট’ বিশেষ আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। আসলেই যখন আমাদের গণমাধ্যমগুলো নিয়ে জনমনে একটা বড় বিভ্রান্তি ও হতাশা দানা বেঁধে উঠেছে ঠিক এই সময়ে এই সিনেমা আরো বেশি পরিমাণে মনযোগ দাবি করে।

মুভিটা মূলত একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, যেখানে রাষ্ট্রের গোপনীয়তা আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দুইটাই মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। রাষ্ট্র নয় বরং প্রেসিডেন্ট তার ব্যক্তিগত ইগো এবং ব্যবসায়ী মহলের ফায়দা রক্ষা করতে গিয়ে একটা ব্যর্থ কিন্তু রক্তক্ষয়ী যু্দ্ধ ভিয়েতনামের উপর চাপিয়ে দেয়। তাদের এই কাজের বলি হয় প্রায় আশি হাজারের মতো তরুণ আমেরিকানের প্রাণ আর কয়েক লক্ষ ভিয়েতনামিজ। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও উপরি মহল চালিয়ে যাচ্ছে একটি যুদ্ধ, জনগণকে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যে আশ্বাস, যুদ্ধের ব্যয়ভারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের উপর, আর প্রাণ হারাচ্ছে তাদেরি স্বজন। এই সংক্রান্ত প্রায় চার হাজার পাতার গোপন নথিপত্রের কিছু অংশ ফাঁস করে আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। তারপর তাদের উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় ব্যারিকেড, প্রকাশনা স্থগিত হয়। ঠিক তাদের এই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের শুরু করা এই বাকি কাজ এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ‘দ্যা ওয়াশিংটন পোস্ট’। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রভাবশালী দৈনিক। এখানে দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের এই কাজকে প্রেসিডেন্ট, প্রশাসন, পলিসি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসেবে দেখলেও এটার ব্যাবসায়িক দিকটা আমাদের এড়িয়ে গেলে চলবেনা।

আমরা দেখি ওয়াশিংটন পোস্টের আর এক কর্নধার ক্যে এর সাথে পলিটিক্যাল হাতি ঘোড়াদের সম্পর্ক এবং কিভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে মিডিয়াকে তাদের কাজের জন্য ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন সময় ম্যানুপুলেট করে এবং এসব ব্যবসায়িক এবং ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক কোন কোন সময় তাদের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে ধারায় এইসবই আমরা দেখতে পাই সিনেমাটিতে

 

পোস্টের কর্তাব্যাক্তি বেন জানতো টাইমস’র একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী তারা, কাজেই টাইমস’র প্রকাশনা বন্ধের পর এই ধরনের একটা নিউজ ছাপানোর মারাত্মক ঝুঁকি থাকলেও এটার ফায়দা  অনেক, একে তো পাবলিক সিম্প্যাথি তাদের পক্ষে আসবে সে সাথে একটা ভালো জনপ্রিয়তাও পাওয়া যাবে। এসব বাদেও প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রের প্রতি এটা একটা সহমর্মিতা স্বরুপ কাজ করবে, ফলত লড়াইটা তাদের একা লড়তে হবেনা, এর সাথে আরো গ্রুপ সংযুক্ত হবে। আর ঐ সময়ে আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় হিপ্পিদের উপস্থিতি বাড়ছিলো ক্রমশ। এখানে আরো একটি ব্যাপার আমরা দেখি ওয়াশিংটন পোস্টের আর এক কর্নধার ক্যে এর সাথে পলিটিক্যাল হাতি ঘোড়াদের সম্পর্ক এবং কিভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে মিডিয়াকে তাদের কাজের জন্য ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন সময় ম্যানুপুলেট করে এবং এসব ব্যবসায়িক এবং ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক কোন কোন সময় তাদের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে ধারায় এইসবই আমরা দেখতে পাই সিনেমাটিতে।

‘দ্যা পোস্ট’ সিনেমার পোস্টার

এর থেকে বুঝা যায় মিডিয়া যখন কর্পোরেটের অংশ হয় তখন এর স্বাধীনতা আপোষের সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়। ফলত অনেক সময় অনেক সত্য আর পাবলিক পর্যন্ত পৌঁছায় না, অনেক সত্য মিথ্যে হয়ে যায়, অনেক মিথ্যা সত্য হয়ে যায়। এই মুভির কয়েকটা সংলাপে আমেরিকার লিডিং পজিশনগুলোতে নারীর অবমূল্যায়ন এর চিত্রটাও কিছুটা উঠে আসে। যেটা আমাদের হুমায়ুন তার এক লেখায় বলেছিলেন, “আমেরিকা ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে কতো বুলি কপচায়, কিন্তু তার পরেও এরা কোনদিন কোন নারীকে প্রেসিডেন্ট বানাবেনা”। বেন’র আরেকটি সংলাপ এখানে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। গোপন নীতিগুলো প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন বেন দেন দরবার করছিলো বোর্ড মেম্বারদের সাথে তখন একটা জায়গায় সে বলে, “যদি তারাই ঠিক করে দেয় আমরা কি ছাপাবো আর কি ছাপাবোনা, তাহলে তো ওয়াশিংটন পোস্টের অস্তিত্ব এমনিতে নাই হয়ে যায়”।

আমেরিকা ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে কতো বুলি কপচায়, কিন্তু তার পরেও এরা কোনদিন কোন নারীকে প্রেসিডেন্ট বানাবেনা

 

সিনেমার শেষে কোর্ট যখন ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষে রায় দেয় তখন আরো একটি সংলাপ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসে। কোর্ট বলে, “পত্রিকা শাসকদের জন্য নয়, শাসিতদের জন্যই কাজ করবে”।

ওভারঅল স্ক্রিপ্ট, স্ক্রিনপ্লে সব বেশ গ্রহণযোগ্য ছিল। মিডিয়া, পত্রিকা, গণমাধ্যম নিয়ে আমরা বর্তমানে যে জটিলাতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এই সময়ে তাই এই মুভি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আমাদের দেশেও বৃহৎ পুঁজির দাস হিসেবে মিডিয়া সবসময়ই কোন না কোন ভাবে ক্ষমতাসীনদের হয়ে কাজ করছে। সেই ক্ষমতা অবৈধ উপায়ে জনগণের সব অধিকার হত্যা করে অর্জন করার পরেও মিডিয়া শাসকদের পক্ষেই থাকছে। আর জনগণের সাথে নিরপেক্ষতার একটা চতুর খেলায় মেতে রয়েছে। মিডিয়া ও ক্ষমতার রাজনীতির দিক থেকে এই সিনেমা একটি ঐতিহাসিক অবদান বলতে হবে। সিনেমাটির উপযোগিতা দিন দিন বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।