মুসলিম নিধন : বিশ্বায়নের কালে দেশে দেশে কি ঘটছে

হামিদ দাবাশি’র বিশেষ লেখা

মুসলিম নিধন : বিশ্বায়নের কালে দেশে দেশে কি ঘটছে

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত মুসলমানেরা মুসলিম এবং অ-মুসলিম শাসকদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত, নিপীড়িত এবং হত্যার শিকার হচ্ছেন। এই বিষয়টি নিয়ে যতটা প্রতিবাদ ও লেখা-লেখি থাকা দরকার তা চোখে পড়ে না। কিন্তু হামিদ দাবাশি এইসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদ দাবাশি বর্তমান দুনিয়ায় জিবিত চিন্তকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিবেকবান কন্ঠস্বর। মূলত কালচারাল ক্রিটিক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। তিনি এর বাইরেও  ধর্মতত্ত্ব ও রাজনীতি ও সংষ্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেন। ইসলামের সাথে পশ্চিমের বিবাদ বিষয়ে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা-লেখি করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক বই-পত্রও লিখেছেন। গত ২২ ডিসেম্বর আল জাজিরাতে তিনি এই লেখাটি লিখেছেন। জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন উম্মে সালমা


পুরো বিশ্বে মুসলমানদের সাথে কি ঘটছে? চীনে মুসলিমদের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন শিবিরে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে এদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। ভারতে নিয়মমাফিক নির্যাতন করা হচ্ছে মুসলমানদের। ইসরায়েলে এদের পাশাপাশি ক্রিশ্চিয়ান ফিলিস্তিনিরাও প্রতিদিনই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও তারা যেন নিগ্রহের বিষয়বস্তু।

আপন মাতৃভূমিতেও মুসলমানদের ভাগ্য অত সুশোভিত নয়। ইরান, সিরিয়া, মিশর এবং বিশেষ করে সৌদি আরবে মুসলমানেরা বসবাস করছে অত্যাচারী, স্বৈরশাসক এবং বর্বর সামরিক জান্তার অধীনে। সেখানে তাদের সর্বাধিক মৌলিক নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার অস্বীকার করা হয়। ইয়েমেনে তাদেরকে গণহারে হত্যা করা হচ্ছে। সৌদি ও তাদের সহযোগী কর্তৃক মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছে ইয়েমেনে। শুধু তাই নয়, যদি কোনো সাংবাদিক তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় তবে তাকে নিজ দেশের দূতাবাসে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়। এটা কি? পুরো বিশ্বজুড়ে কি ঘটছে? এসবের অর্থ কি?

চীনা ক্যাম্প :

চীন দিয়েই শুরু করা যাক। আমরা কিভাবে মুসলিম শিবিরগুলোতে চীনা কর্তৃপক্ষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব, চরমপন্থা, নৃশংসতা অনুধাবন করতে পারি? যদি চীনে জাতিগত নিধনের (ethnic cleansing) ঘটনা ঘটে এবং কেউ কর্ণপাত না করে, তাহলে এর কি কোনো বিহিত হবে? এভাবেই Josh Rogin ওয়াশিংটন পোস্টে শাণিত কণ্ঠে এ প্রশ্নগুলো করেন। তিনি আরও বলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এই যে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তারা কিন্তু ঠিকই পর্যবেক্ষণ করছে চীনা সরকারের এই অভ্যন্তরীণ নিবাসগুলোতে নেটওয়ার্ক বিস্তৃতকরণ যা তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘণসহ তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার জন্যই প্রণীত এক নীল নকশা। এই তাদের সংখ্যা এবং এই নির্যাতনের মতাদর্শগত ধারণাটি হতাশাব্যাঞ্জক। জাতিসংঘ (UN) প্রতিবেদন করেছিল যে এক লাখেরও অধিক উইঘুরবাসীকে আভ্যন্তরীণ চরমপন্থা বিরোধী শিবিরগুলোতে (counter-extremism centres) বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং কমপক্ষে দুই লাখ পুনঃশিক্ষা শিবিরগুলোতে (re-education camps) আটক অবস্থায় আছে।”

জাতিসংঘ (UN) প্রতিবেদন করেছিল যে এক লাখেরও অধিক উইঘুরবাসীকে আভ্যন্তরীণ চরমপন্থা বিরোধী শিবিরগুলোতে (counter-extremism centres) বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং কমপক্ষে দুই লাখ পুনঃশিক্ষা শিবিরগুলোতে (re-education camps) আটক অবস্থায় আছে।

 

বিবিসি’এর আরেকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চীনকে শত শত হাজার হাজার মুসলমানকে বিনা অভিযোগে জিয়ানজিয়ান’র পশ্চিমাঞ্চলে আটক করে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চীনা সরকার এই দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন জনগণ স্বেচ্ছায় এই বিশেষ কারিগরি স্কুলে অংশগ্রহণ করে যারা সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় চরমপন্থার সাথে জড়িত। এই ‘সন্ত্রাসবাদ এবং ধর্মীয় চরমপন্থা’ শব্দটি এই শিবিরগুলোতে চীনা সরকারের মারাত্মক উদ্দেশ্যকে আড়াল করে।

আরেকটি প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, “মুসলমানদের চীনের রি-এডুকেশন ক্যাম্পগুলোতে মদ্যপান এবং শুকরের মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করা হয়।” একই প্রতিবেদন থেকে আমরা আরও জানতে পারি, “তাদের ভীষণ মানসিক চাপ অনুভব করতে হয় যখন তাদের স্বকীয় চিন্তাভাবনাগুলোকে অস্বীকার করে নিজের সমালোচনা করতে হয়। এগুলো নিছক কোনো সংবাদ বিশ্লেষণী প্রতিবেদন নয়। বৃটেনের বৈদেশিক সচিব জেরেমি হান্ট সংসদে উপস্থাপন করেন, “বৃটিশ কুটনৈতিকবৃন্দ যারা জিনজিয়াং প্রদেশে ভ্রমণ করেছেন, (আমরা) এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে অন্তরীণ শিবিরগুলোতে উইঘুর মুসলিমদের সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো ‘ব্যাপকভাবে সত্য’।”

মিয়ানমারে গণহত্যা এবং ব্যাপক সহিংসতা :

এখন আমরা মিয়ানমার প্রসঙ্গে আসি। মিয়ানমারে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচির সতর্ক দৃষ্টির পাহারায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর হত্যাকাণ্ড পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। তারপরেও এ প্রক্রিয়া এখনও ধাবমান গতিতে চলছে। ২০১৬ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশের অন্যতম লক্ষবস্তু। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন আদালতের কর্মচারীবৃন্দ, মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারবৃন্দ কর্তৃক একটি জাতিকে পুরোপুরি বিনাশ (ethnic cleansing) এবং গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের এই সশস্ত্র বাহিনীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন আমরা ভারতের দিকে তাকাই। ভারতে মুসলমানদের ওপর হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমন প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে। বিশেষ করে যখন থেকে ভারতে ব্রিটিশদের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল।

ভারতে মুসলিম গণহত্যার তালিকা ভীষণ ভয়ানক। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় এবং ১৯৮৩ সালে নেলি থেকে ১৯৮৭ সালে হাশিমপুরে এবং একই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধন চলে। এসকল দাঙ্গায় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

ভারতে মুসলিম গণহত্যার তালিকা ভীষণ ভয়ানক। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় এবং ১৯৮৩ সালে নেলি থেকে ১৯৮৭ সালে হাশিমপুরে এবং একই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধন চলে। এসকল দাঙ্গায় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন আমরা ফিলিস্তিনে যাই। মুসলমান এবং খ্রিষ্টীয় ফিলিস্তিনিরা নিজ মাতৃভূমিতে ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিক ইসরায়েলি ছিটমহলের অধীনে জাতিগত নিধন (ethnic cleansing) এর শিকার। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু’র পুত্র সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, “যদি প্রতিটি মুসলমান ইসরায়েলের ভূমি ত্যাগ করে তবে তার ভালো অনুভব হবে।” ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তার এই বংশগত গোষ্ঠীবিরোধী ঘৃণ্য কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেছে এবং গণহত্যার আহ্বানজনিত পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তারপরেও সে তার পিতার আদর্শকেই বহাল রাখছে। অন্যান্য ইহুদি ধর্মীয় যুদ্ধবাজেরা যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের মাটিতে এই ঘৃণ্য অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে।

এখন আমরা বিশ্বের অন্যান্য দিকে আলোকপাত করি। আমেরিকায় আধিপত্যবাদীদের বর্ণবাদী আচরণ এবং ঐতিহাসিক জিনোফোবিয়ার (বিদেশীদের প্রতি অহেতুক ভয়) সবচেয়ে প্রধান সমর্থক ইসরায়েল। এর ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মুসলমানদের এই দেশে অসংখ্যবার আক্রমণের কারণে শত শত হাজার হাজার মুসলমানেরা নিহত হয়।

যখন আমেরিকান নাগরিকবৃন্দ স্বাধীন এবং মুক্তভাব ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচন করে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও আতংকের ঘৃণ্য প্রচারণা চালান। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ধারাবাহিকতায় তার এই কুখ্যাত মুসলিম নিষেধাজ্ঞা মুসলমানদের প্রতি অবমাননাকর আচরণের আইনগত দলিল।

ইউরোপেও খ্রিষ্টধর্মের পাশাপাশি মুসলমানদের প্রতি ঐতিহাসিক ঘৃণা, বর্ণবাদী, জেনোফোবিক এবং প্রোটো-ফ্যাসিবাদী আন্দোলন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রেক্সিট সংকটের মাধ্যমে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে একই অবস্থা বিরাজমান। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন শুধুমাত্র পশ্চিম জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ কারণে সেখানে অ-মুসলিম বর্ণবাদীরা জিনোফোবিক জাতীয়তাবাদীদের ব্যাপক সমর্থন উপভোগ করছে। অখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান এমপি হ্যানসন বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, “তার দেশ মুসলমানদের দ্বারা ছেয়ে গেছে।”

বিশ্বব্যাপী মুসলমানের হাতে মুসলমান হত্যার ঘটনা নেহাত কম নয়। সৌদি আরব এবং এর পার্শ্ববর্তী সংযুক্ত আরব আমিরাত একত্রে জোট পরিচালনা করেছে। যার ফলস্বরূপ, দশ হাজারের মতো ইয়েমেনি নিহত হয় এবং লাখ লাখ অনাহারে পতিত হয়। তবে হ্যাঁ, আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রধান মদতদাতা যারা আরব দেশগুলোতে যুদ্ধোপকরণ সরাবরাহ করে থাকে। তবে আরবরাই বন্দুকের ট্রিগার চেপে ধরছে এবং বোমা ফেলছে।

 

অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক :

বিশ্বব্যাপী মুসলমানের হাতে মুসলমান হত্যার ঘটনা নেহাত কম নয়। সৌদি আরব এবং এর পার্শ্ববর্তী সংযুক্ত আরব আমিরাত একত্রে জোট পরিচালনা করেছে। যার ফলস্বরূপ, দশ হাজারের মতো ইয়েমেনি নিহত হয় এবং লাখ লাখ অনাহারে পতিত হয়। তবে হ্যাঁ, আমেরিকা এবং ইউরোপ প্রধান মদতদাতা যারা আরব দেশগুলোতে যুদ্ধোপকরণ সরাবরাহ করে থাকে। তবে আরবরাই বন্দুকের ট্রিগার চেপে ধরছে এবং বোমা ফেলছে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ (এবং তার রাশিয়া এবং ইরানের সহযোগীরা) হাজার হাজার সিরিয়া নাগরিকদের নিহত হওয়ার জন্য এবং বাদবাকিদের আপন বিধ্বস্ত দেশ হতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রথম এবং সর্বাগ্রে দায়ী।

সিরিয়ায় সংঘটিত গৃহযুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং একাধিক আরব রাষ্ট্রগুলো সমানভাব দায়ী। এর ফলাফল সিরিয়ার অসংখ্য মুসলমানের নির্মম মৃত্যু। তুর্কির সাথে কুর্দিদের যুদ্ধের ফলে অসংখ্য মুসলমান নিহত হয় মুসলমানদের হাতেই। মিশর এবং ইরানেও শাসকবর্গের তাদের নিজেদের নাগরিকদের কারাগারে অথবা রাস্তায় অঙ্গচ্ছেদ বা খুন করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না।

এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলমানদের সাথে যা ঘটছে তার প্রত্যেকটির বহুবিধ এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এখন চীনের পুনঃশিক্ষা শিবিরের কর্মকাণ্ড এবং মিয়ানমারে মুসলমান গণহত্যা, আবার ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন হত্যাকাণ্ড, ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান গণহত্যা এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড— এ ঘটনাগুলোর মধ্যে অবশ্যই সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য খুঁজে বের করা উচিত।

পুরো বিশ্ব জুড়ে মহামারি আকারে মুসলমান নিধন (Muslim Cleansing) চলছে এবং মুসলমান গণহত্যা যে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে তার অধিকাংশ সংঘটিত হচ্ছে মুসলিম শাসক ও স্বৈরশাসক কর্তৃক।

 

কিন্তু ফলাফলতো একই। এই যে পুরো বিশ্ব জুড়ে মহামারি আকারে মুসলমান নিধন (Muslim Cleansing) চলছে এবং মুসলমান গণহত্যা যে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে তার অধিকাংশ সংঘটিত হচ্ছে মুসলিম শাসক ও স্বৈরশাসক কর্তৃক। যার জন্য প্রয়োজন জাতিসংঘের একটি জরুরি বৈঠকের। এখানে কোনো একক কারণ নেই। তারপরেও শুধুমাত্র ঘৃণা এবং ইসলামোফোবিয়ার কারণে মুসলমানেরা মুসলিম হিসেবে অথবা মানুষ হিসেবে অথবা তাত্ত্বিক হিসেবে অথবা বিরোধী দলের এজেন্ট হিসেবে নিজ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের কাছে শত্রু বলেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে এটিকে অবশ্যই প্রতিরোধ এবং নির্মূল করা উচিত।

কেন্দ্র এবং পরিধি:

ইউরোপ এবং আমেরিকায় বর্তমানে মুসলিম জাতির সমূলে বিনাশ (Muslim Cleansing) এর উৎস ইসলামোফোবিয়ার উত্থান কাল থেকেই। যার মূলে ছিল ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের প্রতি ঐতিহাসিক কাল থেকেই ঘৃণার মনোভাব।

বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের প্রতি ঐতিহাসিক ভয় এবং ঘৃণা পরিবর্তিত এবং প্রসারিত হয়ে আজকের মুসলমানদের প্রতি ভয় এবং ঘৃণার জন্ম হয়েছে। ইউরো-আমেরিকার ইসলামোফোবিয়া এই ভাবাবেগের মূলে রয়েছে তাদের জাতিগত ইহুদি-বিদ্বেষ।

তবে যাইহোক, বিশ্বায়নের এই যুগে ইউরোপের ইসলামোফোবিয়া ব্যাধিটি গ্লোবাল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মের সূচনালগ্নে, সমগ্র ইউরোপে ইহুদি এবং মুসলমানেরা ছিল ভয় এবং ঘৃণার মূল উৎস। এই কারণে দেখা যায়, হলোকাস্টে ইউরোপিয়ানদের ইহুদি-বিদ্বেষ মনোভাবের কারণে গণহত্যা ভয়ানক আকারে রূপ নেয়।

কমিউনিজমের শেষ গন্তব্য পুঁজিবাদ ছিল না। তবে পুঁজিবাদের সর্বশেষ ঠিকানা ছিল কমিউনিজম।

 

Samuel Huntington তার বই ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস (১৯৯৩) এ লিখেছেন, মুসলমানেরা প্রায় সম্পূর্ণরূপে (তবে পুরোপুরি নয়) ইহুদিদের জায়গা দখল করেছে যেহেতু তারা সভ্যতার নামকরণ করেছে দ্য ওয়েস্ট বা পশ্চিম।

তবে এটা নিশ্চিত যে মধ্যযুগ এবং বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ক্রান্তিকাল অতিবাহিত হয়েছে আর তা হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিককালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়টা।

Nicholas B Dirks তার বই ‘কাস্টেড অব মাইন্ড : কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড দ্যা মেকিং অব মডার্ন ইন্ডিয়া’ এ দেখিয়েছেন কিভাবে ভারত এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকগত দ্বন্দ্বের ফসল হিসেবে ‘ভারতে বর্ণপ্রথা’র সৃষ্টি হয়। এই ব্রিটিশ শাসনের অধীনেই এই ‘জাতিভেদ প্রথা’ সামাজিক গঠনের বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। আর এর ফলাফল হিসেবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভয়ানক আকারে রূপ নেয়।

অতএব, হিন্দু মৌলবাদ এবং ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান বর্ণবাদের মধ্যে মেলবন্ধন খুব একটা বিষ্ময়কর নয়। সম্প্রতি Aadita Chaudhury যুক্তি সহকারে বলেছেন, “আধিপত্যবাদী এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা উনিশ শতকের আর্য জাতির ধ্যান ধারণায় ফিরে যাচ্ছে।”

চীনে যে সমস্ত কার্যকলাপ ঘটছে তাতে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত ইউরোপ এবং আমেরিকা। শুধু তাই নয়, তারা বিভিন্নভাবে চীনকে সুবিধাজনক প্রোটোকল দিচ্ছে। পশ্চিমা ভাষায় এই উইঘুর বিরোধী (ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধী) প্রচারণাকে সন্ত্রাসবিরোধী এবং শান্তির পক্ষে কার্যকলাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। চীনের এই ধর্মান্ধতা একটি বিষাক্ত জাতিগত উপাদান, যাকে পুঁজি করে চীনা সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিক শাসক সমগ্র চীনা গোষ্ঠীর উপর হ্যান শাসকদের মতো আধিপত্য কায়েম করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

রোবোটিক্স শ্রম এবং ভোক্তা ব্যক্তি উৎপাদনে, চীন অনেক বেশি মনোযোগী। বিশেষত, যান্ত্রিক প্রকল্পের উপর সাংস্কৃতিক অথবা মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তাদের দৃঢ় সংকল্প লক্ষণীয়। চীনের মূল আকর্ষণ হলো হার্বার্ট মারকুজ এর ডিসটোপিয়ান মডেলের একক মাত্রার মানুষ (১৯৪৬)।

এই Dystopean (ভয়ানক কল্পিত) দুঃস্বপ্নটি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং এটি চীনা সমাজতান্ত্রিক দল-কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমা ধাঁচে পুঁজিবাদের রূপ ধারণ করেছে। কমিউনিজমের শেষ গন্তব্য পুঁজিবাদ ছিল না। তবে পুঁজিবাদের সর্বশেষ ঠিকানা ছিল কমিউনিজম। এই সর্বশেষ বাক্যটি আজকে আমাদের মনুষ্যত্বকে বৃহদাকার দৈত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।