মেডেলিন অলব্রাইট— অ্যামেরিকার প্রাক্তন সেক্রেটারি অব স্টেট। লেখক ও চিন্তক হিসেবেও তিনি সমান খ্যাতিমান। ২০১৮ সালে ‘Fascism: A Warning’ নামে একটি বই লিখে দুনিয়াকে আসন্ন ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন বিষয়ে সতর্ক করে দেন। বইটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে ইতিমধ্যে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে বিখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট তাকে ফ্যাসিবাদ নিয়ে পাঁচটি প্রশ্ন করেন। স্বৈরশাসনের জনপ্রিয়তাবাদী দৃষ্টি ভঙ্গি ও এর দুনিয়াব্যাপী বিস্তার নিয়ে তিনি সতর্ক হওয়ার ডাক দিয়েছেন অলব্রাইট। কথা বলেছেন ফ্যাসিবাদের নানান দিক নিয়ে। জবানের জন্য অনুবাদ করেছেন, দেওয়ান মারুফ শুভ।
দ্য ইকোনমিস্ট : ফ্যাসিবাদকে কিভাবে সংজ্ঞায়ন করবেন?
মেডেলিন অলব্রাইট : এমন কোন সার্বজনীন সংজ্ঞা নাই যা দ্বারা ফ্যাসিবাদকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যাবে। আমার বইয়ে আমি কিন্তু ফ্যাসিবাদকে কোন আদর্শ হিসেবে নয় বরং কোন ব্যাক্তি বা দল কর্তৃক কোন জাতিকে ক্ষমতার মাধ্যমে কব্জা করে রাখার আকাঙ্ক্ষা ফ্যাসিবাদ হিসেবে বুঝাতে চেয়েছি। এবং এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতাসীন ব্যাক্তি বা দলের প্রধান যেকোন ধরনের অন্যায় অত্যাচার এবং সহিংসতার সাহায্য নেয়।
বিংশ শতাব্দীর মুক্ত রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ প্রত্যয়টি কতটা গ্রহণযোগ্য? অথবা বর্তমান জমানার এই জটিল রাজনীতি বোঝানোর জন্যে কোন প্রত্যয় নেই বলেই কি আমরা ফ্যাসিবাদ শব্দটিই ব্যবহার করি? ফ্যাসিবাদ এখনো টিকে আছে?
উত্তর কোরিয়া ছাড়া আমি আর কোন রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করছিনা। তবে আমি মুসোলিনি এবং হিটলারের উত্থানের সাথে বর্তমান জমানার রাজনীতির অনেক সাদৃশ্য খুজে পাই। যেমন মানুষের অর্থনৈতিক অসমতা, মূলধারার রাজনীতির প্রতি মানুষের অনাস্থা, পাবলিক ডিস্কোর্সের অবক্ষয়, সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার এবং মুক্ত চিন্তাকে দমনের জন্য অসত্য এবং বেহায়া যুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শাসকদের স্বৈরাচারী আচরণ চারদিকেই আছে। সম্ভবত এই সকল কিছু আবারও ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার কথাই জানান দেয়। তবে আমার বই-এর সাবটাইটেলে “আ ওয়ার্নিং” বলতে আমি আসলেই সাবধান করতে চাইছি সকলকে। আমার সাথের অনেক অনেক মানুষই আজ বেঁচে নেই কারণ সেই সময় একই রকমভাবে তাদের সাবধান করা হয়েছিল কিন্ত তারা তা অগ্রাহ্য করেছিল।
কোন আদর্শ হিসেবে নয় বরং কোন ব্যাক্তি বা দল কর্তৃক কোন জাতিকে ক্ষমতার মাধ্যমে কব্জা করে রাখার আকাঙ্ক্ষা ফ্যাসিবাদ হিসেবে বুঝাতে চেয়েছি।
আপনি কৈশোরে স্বৈরাচার দেখেছেন, ছাত্রজীবনে অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং একজন বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হিসেবে অনেক নেতাদের সাথে কাজ করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে আপনি কিভাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক অথবা তাদের অনুসারীদের সম্মুখীন হবেন?
মিথ্যার বিপক্ষে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে সত্যি এবং ঘৃণার প্রতিক্রিয়া শক্ত প্রতিরোধ হচ্ছে ভালোবাসা। ভেলভেট রেভ্যুলেশনের সময় ভাকলাভ হাভেল, রাস্তায় প্রতিবাদরত কম্যুনিস্টদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘গণতন্ত্রবাদীদের ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ আমরা তোমাদের মত নই’। তবে আজকের দিনে যদি আমরা আইনের প্রতি বিশ্বাস না করি এবং স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রকে আলাদা করতে না পারি তাহলে আমাদের ভুল হয়ে যাবে। ইতিহাস হাতড়ে আমরা দেখতে পাই, অত্যাচারী শাসকেরা নিজেদের অজেয় মনে করেন এবং সাধারণ মানুষের সাহসের চরম অবমূল্যায়ণ করেন। বর্তমান সময়ে বিশ্বের পরিস্থিতি দেখলে আমি উদ্বিগ্ন হওয়ার অনেক কারণ দেখি। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নাই।
উদারপন্থী এবং গণতন্ত্রবাদীদের নিষ্ক্রিয় মনে হয়? হিংস্র রাজনীতির বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান প্রয়োজন নয় কি? নাকি হিংস্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে গেলে তাদের সাথে আমাদের কোন পার্থক্য থাকবেনা?
বাম এবং ডান দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই কঠোর হতে হবে। ফ্যাসিবাদ তখনই মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে যখন কোন সোশ্যাল অ্যাক্টর থাকে না, যখন গণমাধ্যম সবসময়ই মিথ্যা ছড়ায়, যখন আইন নীতিভ্রষ্ট হয়, যখন গণতন্ত্র মিথ্যা হয়ে ওঠে, সকল সংঠন ইবলিশের ক্রীতদাস হয়ে ওঠে এবং শক্ত হাতই তখন শয়তানের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করতে পারে। হোক সে সয়তান ইহুদি, মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ অথবা তথাকথিত বুর্জোয়া। কিন্ত সহিংসতার রাজনীতির প্রতিক্রিয়া মোটেও সহিংস হওয়া উচিৎ না। বরং হওয়া উচিৎ নানা আদর্শের একটা মিলনস্থল, যেখানে সবাই গণতন্ত্রকে আরো বেশি কার্যকর করতে চাইবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেসব বড় বড় নেতাদের প্রশংসা করি যেমন লিংকন, কিং, গান্ধী, ম্যান্ডেলা, এরা সবাই আমাদের মধ্যে থেকে সেরাটাই বলার চেষ্টা করেছেন।
মূলধারার রাজনীতির প্রতি মানুষের অনাস্থা, পাবলিক ডিস্কোর্সের অবক্ষয়, সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার এবং মুক্ত চিন্তাকে দমনের জন্য অসত্য এবং বেহায়া যুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শাসকদের স্বৈরাচারী আচরণ চারদিকেই আছে। সম্ভবত এই সকল কিছু আবারও ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার কথাই জানান দেয়।
অনেকের মতে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর জন্য কোন শক্তিশালী সংগঠনের প্রয়োজন। আপনি তো সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং সংগঠন নিয়ে অনেক কথাও বলেছেন। তারপরও খারাপ সময়ে আপনি সাধারণ নাগরিকের দায়িত্বের কথা বলেন। কেন?
সমস্যাটা হচ্ছে আসলে সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এরা ভুলে যায় কেন এদের তৈরি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা কখনোই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারব না যদি আমরা অতীত ধরে ঝুলে থাকি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ই আমাদের বর্তমান রাজনীতিকে গঠন করতে ভূমিকা রেখেছে। তাই সংঠনগুলো এখনো সত্তর বছর পুরনোই রয়ে গেছে। এদের অবস্থা সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধের মত। সংগঠনগুলোর সংস্কার প্রয়োজন, নতুন নতুন নিয়ম কানুন শিখানো প্রয়োজন। সব কথার এক কথা হচ্ছে, প্রত্যেকটা সংগঠন তেমনই হবে যেমন তাদের পরিচালকেরা হবে। আমি প্রার্থনা করি, প্রত্যকটা নাগরিকের সামরিক দায়িত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা এবং একজন আরেক জনের দেখভাল করা ইত্যাদি কর্তব্যসমূহ বোঝার জন্যে আমাদের যেন আরও একটা বিশ্বযুদ্ধ দেখতে না হয়। তবে সংগঠন যতই সুগঠিত হোক না কেন, কোন সংগঠনই আমাদের সাহায্য করতে পারবেনা যদিনা মানুষের মধ্যে শেয়ার্ড সেন্স অফ হিউম্যানিটি না আসে এবং মানুষ সব সময় প্রতিশোধের নেশায় থাকে। আমরা ইতিহাস থেকে অনেক কিছু শিখেছি; তার মধ্যে একটা হচ্ছে, একজন বিজ্ঞ লোক সবসময়ই নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজানো ইটের ঘর বানাবে, অন্যদিকে একজন ভিতু লোক যত্রতত্রভাবে খড়ের ঘর তৈরি করে।