মৃত্যুমিছিল বোধ হয় একেই বলে! ২০১৮ সালে এই চরাচর থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি জগতের কয়েকজন প্রথিতনামা দিকপাল। তালিকায় আছেন সাহিত্য জগতের রমাপদ চৌধুরী, আফসার আহমেদ, পৌলোমী সেনগুপ্ত, আব্দুর রাকিব, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং চলচ্চিত্র জগতের সুপ্রিয়া চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন প্রমুখ। ৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার মাত্র কয়েক ঘন্টা ব্যবধানে দু’জন সৃজনশীল মানুষের মৃত্যু সংবাদ ব্যথিত করল আমাদের। প্রয়াত হলেন সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত এবং কবি পিনাকী ঠাকুর। বছরের সূচনালগ্নে আমরা হারালাম দুই কৃতি মানুষকে, সারস্বত সমাজে এই মৃত্যুর ধারা কি অব্যাহত থাকবে বছরভর? আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে আপামর সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি।
বিগত কয়েকমাস বার্ধক্যজনিত সমস্যায় অসুস্থ ছিলেন দিব্যেন্দু পালিত। বুধবার, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় সন্ধ্যা ৬:২৩ নাগাদ যাদবপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। চিকিৎসক আহসান হাবিব জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন তার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছিল। গতকাল তা আরও বেড়ে যাওয়ায় অবিলম্বে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। বুকে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শরীরে অক্সিজেন কমে গিয়েছিল। চিকিৎসকগণ সর্বোচ্চ চেষ্টাতেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সংক্রমণ। বৃহস্পতিবার, সকাল ১১:৫০ নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে লেখকের বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। লেখকের একমাত্র সন্তান অর্থনীতিবিদ এবং আইইএস অফিসার অমিতেন্দু পালিত সিঙ্গাপুরে চাকরিরত। তিনি দেশে ফিরেছেন শুক্রবার। খুব শীঘ্র সম্পন্ন হবে লেখকের শেষকৃত্য। মাস দু’য়েক পর লেখক আশি বছরে পদার্পণ করতেন। আশি বছরের জন্মদিন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে উদযাপন করার পরিকল্পনা করেছিল আত্মীয়-পরিজন। লাজুক সম্মতির আভাস দিয়েছিলেন মিতভাষী লেখক। সেই জন্মদিন আর পালিত হবে না।
ব্রিটিশ শাসনাধীন বিহারের ভাগলপুরে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন দিব্যেন্দু পালিত। সেখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেন। লেখালেখি করতেন অল্প বয়স থেকে। তার বয়স যখন ১৬ বছর, ভাগলপুর কলেজে পাঠকালীন ১৯৫৫ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ছন্দপতন’ নামে একটি ছোটগল্প। ১৯৫৬ সালে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোটগল্প ‘নিয়ম’। লেখক হিসাবে নজর কাড়তে শুরু করেন তখন থেকেই। ১৯৫৮ সালে তার পিতা বগলাচরণ পালিত গত হওয়ার পর সংসারের ভার পড়ে ১৯ বছরের দিব্যেন্দুর কাঁধে। ভাগ্যান্বেষণের জন্য তিনি চলে আসেন কলকাতা। আর্থিক অনটন; পাশাপাশি মা-ভাইবোনদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব- জীবন-সংগ্রামে জেরবার দিব্যেন্দু শিয়ালদহ রেল স্টেশনে কাটিয়েছেন বহু অভুক্ত রাত্রি! অস্থায়ী কাজের পারিশ্রমিকে নিজে বেঁচে থাকা এবং পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখা যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল তার। তবু লেখালেখি করার পাশাপাশি পড়াশোনাতে ছেদ পড়তে দেননি তিনি। ১৯৬১ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বছর শুরু হয় মানসম্মত কর্মজীবন; অধুনালুপ্ত ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ ইংরেজি সংবাদপত্রে সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন তিনি। এই সংস্থায় বছরচারেক কাটিয়ে তিনি যুক্ত হন বিপণন এবং বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত পেশায়। ক্ল্যারিয়ন-ম্যাকান অ্যাডভ্যাটাইজিং সার্ভিসেস, দ্য স্টেটসম্যান এবং আনন্দবাজার সংস্থায় কর্মরত ছিলেন বহু বছর। আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন দীর্ঘদিন।
দিব্যেন্দু পালিত যখন ২০ বছরের যুবা, ১৯৬৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘সিন্ধু বারোয়াঁ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সাংবাদিক- সৃজনশীলতার বহু পরিচয়ে ছিলেন প্রতিভাময়, স্বচ্ছন্দ। তার রচনায় বারংবার উঠে এসেছে অসহায়তা, দারিদ্রতা, নাগরিক মানুষের জাগতিক জটিলতা। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস: ‘অন্তর্ধান’, ‘মৌন মুখর’, ‘উড়ো চিঠি’, ‘সেদিন চৈত্রমাস’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘ঘরবাড়ি’, ‘ঢেউ’, ‘সোনালী জীবন’ ইত্যাদি। তার লেখা ছোটগল্প ‘হিন্দু’, ‘জাতীয় পতাকা’, ‘জেটল্যাগ’, ‘চিলেকোঠা’ অনন্যতার দাবিদার। তার রচিত ছোটগল্প ‘ত্রাতা’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘নামতে নামতে’ চলচ্চিত্র। এছাড়াও চলচ্চিত্র, দূরদর্শন এবং বেতার মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে তার কিছু রচনা। বহু ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে তার লেখা। ‘আত্মীয়’, ‘অপেক্ষা’ ইত্যাদি কিছু কবিতাও লিখেছেন তিনি। বেশ কিছু নামী পুরস্কারে তাকে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে রামকুমার ভুয়ালকা পুরস্কার, ১৯৯০ সালে বঙ্কিম পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
গত বছর ২১ ডিসেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি পিনাকী ঠাকুর। তাকে ভর্তি করা হয় কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালে। চিকিৎসায় ধরা পড়ে, সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া নামক এক বিরল রোগে আক্রান্ত তিনি। অবস্থার অবনতি হলে কবিকে ভর্তি করা হয় বারাকপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে, ভেন্টিলেশনে রাখা হয় তাকে। দিনকয়েক পর অবস্থা গুরুতর আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ায় চিকিৎসকগণ পরামর্শ দেন এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করার। বিগত কয়েকদিন তিনি এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে চিকিৎসকদের প্রায় ১০০ ঘন্টার লড়াই বিফল হয়, ৩ জানুয়ারি সকাল ৯:০০ নাগাদ মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ শেষে পরাজিত হয়ে মৃত্যু হয় তার। মস্তিষ্কে মাত্রাতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ তার মৃত্যুর কারণ, জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৫৯ বছরে মৃত্যুকে অকালপ্রয়াণ তো বলা যায়?
১৯৫৯ সালের ২১ এপ্রিল হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। লেখালেখি শুরু করেন আশির দশক থেকে, তবে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন নব্বইয়ের দশকের সূচনালগ্নে। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘একদিন অশরীরী’ প্রকাশের পর সাড়া পড়ে যায় বাংলা কাব্যজগতে। এই কাব্যগ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করেন শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মণীন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ। কবিতা রচনার পাশাপাশি অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। বেশ কয়েকটি নামী ম্যাগাজিন তাকে সসম্মান নির্বাচিত করেছে উপদেষ্টা হিসাবে। অন্ত্যমিল কবিতা রচনায় তিনি একটি স্বকীয় ঘরানা তৈরি করেন। তৎকালীন তরুণ প্রজন্ম তার কবিতা সোৎসাহ গ্রহণ করে। ‘অকালবসন্ত’, ‘কলঙ্করচনা’, ‘আমরা রইলাম’, ‘হ্যাঁ রে শাশ্বত’, ‘শরীরে কাঁচের টুকরো’, ‘কালো রঙের আগুন’ ইত্যাদি তার রচিত যুগোত্তীর্ণ কাব্যগ্রন্থ। ২০১২ সালে ‘চুম্বনের ক্ষত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। বাংলা আকাদেমি পুরস্কার এবং কৃত্তিবাস পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে কবিকে। এছাড়াও চল্লিশ বছরের কবি-জীবনে পেয়েছেন বহু স্বীকৃতি, সম্মাননা। প্রথম জীবনে পিনাকী ঠাকুর ডানলপ কারখানায় চাকরি করতেন। ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিযায়ী জীবন কাটিয়েছেন চাকরিসূত্রে। পরবর্তীকাল থেকে আজীবন তিনি শিক্ষকতা করেন কাব্যচর্চার পাশাপাশি। আজীবন তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে কবির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে, তারপর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলা আকাদেমি চত্বরে। দুই স্থানে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঘন্টাখানেক মরদেহ রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় কবির জন্মভিটে বাঁশবেড়িয়ায়। সেখানে ত্রিবেণী ঘাট মহাশ্মশানে সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য। শোকপ্রকাশ করে কবি সুবোধ সরকার বলেছেন, “নব্বইয়ের দশকের সেরা কবিদের মধ্যে অন্যতম তিনি। তার কবিতা সব দশকেই মাইলফলক।” সাহিত্যিক দিব্যেন্দু ঘোষ বলেছেন, “ওর চলে যাওয়া বাংলা কবিতার অপূরণীয় ক্ষতি।”