ইশতিয়াক আহমেদ, একজন বাংলাদেশি আইনজীবী এবং ভারতীয় জনপ্রিয় অনলাইন স্ক্রলডটইন’র কন্ট্রিবিউটর। তিনি একুশের প্রথম কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর পৌত্র। বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচন ও বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন স্ক্রলডটইন’এ। এখানে লেখাটি জবান’র পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।
ডিসেম্বরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মারা যায়নি। এটি এখানে অনেক আগেই মারা গেছে এবং সম্ভবত তা আর উদ্ধার করা সম্ভব না। এই কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল অনুমেয় ছিল। একমাত্র বিস্ময় এই যে, আওয়ামী লীগ ৮৩ শতাংশ নাগরিক ভোট ও ৯৬ শতাংশ সংসদীয় আসন নিয়ে অপ্রত্যাশিত জয়লাভের পরও শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শহরটাকে লাল রঙে রঞ্জিত করেনি। ক্ষমতাসীন দল ব্যাপকভাবে একটি একতরফা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করেছে, যা খুবটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
নির্বাচন ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ আয়োজন করা হয়েছে, যা বছরের এমন একটা সময় যখন অন্যান্য দেশের সরকার এবং মিডিয়াগুলো ছুটি কাটানোর মুডে এবং নতুন বছরের ইতিবাচক বার্তাগুলো তৈরিতে ব্যস্ত ।
নির্বাচনের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দীর একটি আওয়ামী, যারা গত এক দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছে, যেখানে অধিকার এবং স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে এবং অন্য ডানপন্থী দলটি হল বিএনপি, যারা ২০১৪ সালের সংসদীয় নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু এবার তারা নাগরিক সমাজের ঐক্য ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’র নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়, সেখানে শুধু বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নয়, সকল বিরোধীদের ব্যাপক নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খবরা-খবর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ইন্টারনেট ব্লাকআউট এবং বাক ও অভিব্যাক্তির স্বাধীনতাখর্বকারী কঠোর আইনের ব্যবহার করে। সংবাদমাধ্যমের উপরও কঠোর নিষেদ্ধাজ্ঞা জারি করা হয়। যাইহোক, এটি প্রয়োজন ছিলনা; কেননা কিছু পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল ইতিমধ্যে সরকারের চিয়ারলিডার্স হিসেবে কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল।
নির্বাচন চলাকালীন সময়ে, আপাতদৃষ্টিতে খবরা-খবর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকার ইন্টারনেট ব্লাকআউট এবং বাক ও অভিব্যাক্তির স্বাধীনতাখর্বকারী কঠোর আইনের ব্যবহার করে। সংবাদমাধ্যমের উপরও কঠোর নিষেদ্ধাজ্ঞা জারি করা হয়। যাইহোক, এটি প্রয়োজন ছিলনা; কেননা কিছু পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেল ইতিমধ্যে সরকারের চিয়ারলিডার্স হিসেবে কাজ করা শুরু করে দিয়েছিল। কারণ এগুলোর মালিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই নিজেদের সদস্য।
তথ্য প্রকাশে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চেষ্টা থাকার পরেও কিছু পত্রিকায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে নির্বাচনী-দমনের কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, বিদেশি মিডিয়াও কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, ব্যালট বাক্স পূর্বেই ভরে ফেলা হয়েছে, ব্যালট পেপারে আগেই সিল মারা হয়েছে এভং কিছু ভোটকেন্দ্রের ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নামে নিবন্ধিত ছিল। হাজার হাজার ভোটারের মধ্যেও বিরোধীরা কোথাও যথেষ্ঠ ভোট পায়নি, কোন কোন ক্ষেত্রে তার পরিমাণ ১ হাজারেরও কম। সংক্ষেপে, ক্ষমতাসীন দল তার রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করেছে নির্বাচনী এই সফলতায় পৌঁছাতে যা সমগ্র বিশ্বের স্বৈরাচারীদের জন্য ঈর্ষনীয়।
ভারতীয় সমর্থন
২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর, যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কম ৩৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল, কারও কারও মতে ২২ শতাংশ— যেখানে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলনা। ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সহায়ক ছিল।
নয়াদিল্লী হাসিনার জন্য তার অব্যাহত নিঃশর্ত সমর্থন গোপন করেনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে, ভারতীয় মিডিয়ার বিশাল আবাদী জমিনে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগই সেরা এবং বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়ণ করেছিল। ভারতীয় কূটনীতিক, আমলাতান্ত্রিক এবং স্বৈরশাসকগণ গত বছর একমাস ধরে ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা করে আসছে। ভারতীয় নির্বাচনী-পর্যবেক্ষকগণসহ সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারশেন, কিছু আঞ্চলিক দেশ এবং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক কোঅপারেশন নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলে অনুমোদন দিয়েছে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম বিদেশি নেতা যিনি শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এই অবিশ্বাস্য ফলাফলের জন্য। তার পরপরই পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী যারা বাংলাদেশের সীমান্তের রাজ্যের।
পশ্চিমারা বিষয়টি খেয়াল করছে না
কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারের ক্ষেত্রে অন্ধ’র ভূমিকা পালন করছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে নিন্দা করলেও সে নিন্দানুযায়ী কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তারপরে বাংলাদেশ পারিহা রাষ্ট্র হয়ে যায়নি। এবং সেই সাথে পশ্চিমা ভণ্ডামি এবং উদার গণতন্ত্র সারা দুনিয়ায় প্রকাশ্যে এসেছে, এটি আর হবে না।
প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমা শক্তিগুলো ১৯৭০ এবং ১৯৮০ দশকে বাংলাদেশের সেনা শাসনকে সমর্থন করেছিল। পরবর্তীতে সুশীল সমাজ সমর্থিত সেনাশাসনের সময় সামান্য হস্তক্ষেপে সেনা শাসনের বৈধতা কমে যেতে দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে এই বিষয়টি কাজে লাগিয়েছে এবং জনগণবিরোধী নব্য-জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিল।
সজীব ওয়াজেদ জয় নির্বাচনের তিন দিন আগে বিদেশি মিডিয়ায় বলেন তার মাকে স্বৈরশাসনের যে লেবেল দেয়া হয়েছে তা ‘সম্মান’র, এতেই প্রমাণ হয় বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে অথচ অন্যান্য দেশের মধ্যে এটিতে পরিবর্তন আনতে কোন চাপ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার আলোচ্য আওয়ামী লীগের উন্নয়নের গালগল্প ও ইসলামিজমের বিরোধিতা করা নয়।
তাছাড়া পশ্চিমা ভূরাজনৈতিক চাল ও স্বার্থ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পশ্চাদসরণ করে থাকে, যে কারণে ভারত এবং চীন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও উত্তরাধীকারী সজীব ওয়াজেদ জয় নির্বাচনের তিন দিন আগে বিদেশি মিডিয়ায় বলেন তার মাকে স্বৈরশাসনের যে লেবেল দেয়া হয়েছে তা ‘সম্মান’র, এতেই প্রমাণ হয় বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে অথচ অন্যান্য দেশের মধ্যে এটিতে পরিবর্তন আনতে কোন চাপ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার আলোচ্য আওয়ামী লীগের উন্নয়নের গালগল্প ও ইসলামিজমের বিরোধিতা করা নয়।
নাগরিকদের অবশ্যই পদক্ষেপ নেয়া উচিত
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে জনগণের ‘ভোটাধিকার খর্ব’ স্থিরাবস্থা নিয়েছে। গত এক দশকে তা গুরুত্বপূর্ণ হারে বেড়েছে। যদি এটি প্রত্যাহার করা হয়, যদি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন অর্জন করা হয়, তবেই জনগণ তার ক্ষমতা ফিরে পাবে।
আশা লুকিয়ে আসে সেই সব তরুণ, শ্রমিক, সাধারণ জনগণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীলদের মধ্যে যারা এক দশক শাসনামলে আওয়ামী লীগকে প্রতিরোধ করেছে। যারা নৃশংসভাবে নীপিড়িত হয়েছে। নতুন করে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ করা দেশি-বিদেশি নাগরিক সমাজের দায়িত্ব এবং মিডিয়াকে তার বিবেচনার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং এদের সহযোগী হতে হবে। ২০১৪ সালের চেয়ে কাজটি এখন আরও কঠিন। সরকার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক। এবং নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য সংগঠিত হওয়া ও শান্তিপূর্ণভাবে সমন্বয় করার পরিবেশও প্রতিকূলে।
যাইহোক, যদি বাংলাদেশ উদ্ধারকর্তা এবং সহজ সমাধানের জন্য সময় অপচয় বন্ধ না করে, এবং তাদের অধিকারকে খর্ব করে এমন কাজে বিনিয়োগ করে তবে পরিবর্তন আসবে না। একটি ভঙ্গুর সিস্টেম কখনোই নিজে নিজে ঠিক হয় না এবং গণতন্ত্র কখনোই নির্বাচনের সমান নয়। এই নির্বাচনের থেকে আসা একমাত্র ভালো বিষয়টি হলো ‘এই সরকার যে স্বৈরাচারী’ তার নিশ্চিতকরণ বার্তা এবং বিদ্যমান রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজ এই গণতন্ত্রের জন্য অনুপযুক্ত। বাংলাদেশ আসলে কি করতে চায় নাগরিক এই পুনঃগঠন সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে।